গো-হারান

দ্যুতির ঝলকানিতে রূপান্তরের কলকাতা

কাঁচা-পাকা চুলের ভদ্রলোককে দেখে দৌড় শুরু করলেন বিখ্যাত সাদা শার্ট। চোখাচোখি হতেই একে অন্যকে এমন আবেগপ্রবণ ভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন কত গভীর বন্ধুত্ব! অফুরান ঠাট্টা-ইয়ার্কি। দেখলে মনে হবে, ম্যাচ নয়। পাঁচ মিনিট পর দু’জন বোধহয় পার্টিতে ঢুকবেন।

Advertisement

প্রীতম সাহা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৫ ০২:১১
Share:

কলকাতার দাদাগিরি। নায়কের উল্লাস। জিকোর বিপর্যয়। ছবি উৎপল সরকার, আইএসএল

আটলেটিকো দে কলকাতা-৪ : এফসি গোয়া-০ (দ্যুতি-২, বোরহা, হিউম-পেনাল্টি)

Advertisement

দৃশ্য এক, রবিবার সন্ধে পৌনে সাতটা...

কাঁচা-পাকা চুলের ভদ্রলোককে দেখে দৌড় শুরু করলেন বিখ্যাত সাদা শার্ট। চোখাচোখি হতেই একে অন্যকে এমন আবেগপ্রবণ ভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেন কত গভীর বন্ধুত্ব! অফুরান ঠাট্টা-ইয়ার্কি। দেখলে মনে হবে, ম্যাচ নয়। পাঁচ মিনিট পর দু’জন বোধহয় পার্টিতে ঢুকবেন।

Advertisement

দৃশ্য দুই, রবিবার রাত ন’টা...

ওই আবার দু’জন। আবার কাঁচা-পাকা চুল, আবার সাদা শার্ট। তবে ছবিটা এখন অন্য রকম। একজন গোমড়া। বিহ্বল দৃষ্টিতে মাঠের দিকে তাকিয়ে। সাদা শার্টকে দেখা গেল, আবার জড়িযে ধরছেন। কিন্তু বিহ্বল দৃষ্টির ভদ্রলোক তাতে খুব প্রভাবিত হলেন না।

এঁরা— জিকো এবং আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। দুই টিমের দুই কোচ। যাঁদের রবিবাসরীয় আচার-আচরণ দেখলে, চব্বিশ ঘণ্টা আগের ছবিগুলোকে মিথ্যে মনে হবে। কে বলবে, মাত্র একদিন আগে দুই জেনারেলের গোঁ আর জেদ এতটাই চরমে উঠেছিল যে, সাংবাদিক সম্মেলনে আসতে চাননি জিকো। শেষ পর্যন্ত এসেছেন এবং বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। হাবাসও কূটনৈতিক ধূর্ততায় মঞ্চ আগুনে করে রেখেছিলেন। সে সব এখন কোথায়? আপাত-দৃষ্টিতে তো টেনশনের কোনও চিহ্ন পাওয়া গেল না।

মুশকিল হল, আপাত-দৃষ্টিতেই। ভেতরে-ভেতরে নয়। ম্যাচ শেষের পর আটলেটিকোর কোচ যে ও ভাবে নাচলেন, তাতে কি ব্রাজিলীয় কিংবদন্তির মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার দর্প মিশে ছিল না? বা যখন দ্যুতিকে প্রায় কাঁধে তুলে নিলেন? কলকাতা কোচকে দু’-এক বার ভিআইপি গ্যালারির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে দেখা গেল। সেখানে সস্ত্রীক বসে থাকা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্যে। সৌরভও হাত নাড়লেন সফল কোচের দিকে। যেন বুঝিয়ে দেওয়া, দ্যাখো আমি পেরেছি। তোমার সামনেই তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পেরেছি। জিকোর টিমকে চার গোল মেরে সেমিফাইনালের দিকে টিমকে নিয়ে যাচ্ছি। যেন ফুটবলমহলকেও বুঝিয়ে দেওয়া— এ শহরে অন্য কোনও কোচের জেদ চলবে না। কলকাতা মানে শুধু হাবাসের গোঁ।

মাঠের ভেতরেও তো হাবাসের ফুটবলবুদ্ধি নির্বিষ করে ছেড়েছে জিকোর জেদকে। আইএসএলের শীর্ষে থাকা মেগা টিমের কোচকে বাধ্য করেছে তিন-তিন বার টিম কম্বিনেশন বদলাতে। এতটাই দাপট ছিল মাঠে এ দিন হাবাসের কলকাতার। আর সেই কাজে স্প্যানিশ কোচের দোসর দ্যুতি। হাবাসেরই আমদানি দক্ষিণ আফ্রিকান মিডিও আগের দিন বলছিলেন, ‘‘সমারসল্ট দেওয়া আমাদের দেশে রেওয়াজ।’’ রবিবার প্রথম গোলটা করে তিন বার ‘রেওয়াজ’ পালন করলেন দ্যুতি। কিন্তু একটা ‘সমারসল্ট’ এ দিন ডাগ আউটেও হতে পারত। একটা ভিআইপি গ্যালারিতেও। হাবাস হয়তো ঝুঁকি নিলেন না তাঁর বয়সের কথা ভেবে। আর সৌরভ বোধহয় পারলেন না তাঁর আশপাশে প্রয়োজনীয় জায়গার অভাবে! তবে দু’জনেই নিজেদের সিট ছেড়ে শূন্যে লাফ মেরেছিলেন।

আসলে এ দিন জিকোর গোয়ার ভিত নড়িয়ে দেন একা দ্যুতিই। জোড়া গোল তো করলেনই। সঙ্গে বোরহার গোল আর টিমের পেনাল্টি আদায়ের পিছনেও তিনি-ই। মিক্সড জোনে দাঁড়িয়ে পরে হিউম বলছিলেন, “যে সময় আমাদের পারফরম্যান্স গ্রাফ উপরে ওঠার দরকার ছিল, ঠিক সেই সময়ই দ্যুতি জ্বলে উঠেছে। ও দলের সম্পদ।” কানাডিয়ান স্ট্রাইকারের কথা প্রায় কেড়ে নিয়ে বোরহা বলে উঠলেন, “ফুটবলে দু’টো ব্যাপার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। বয়স আর ব্যাল্যান্স। দ্যুতির সেই দুটোই আমাদের দলের অ্যাডভান্টেজ।”

বোরহার পর্যবেক্ষণ ভুল নয়। এ দিন দ্যুতির দু‘টো ‘ব’ (বয়স আর ব্যাল্যান্স) বেআব্রু করে দিল জিকোর দলের ডিফেন্সকে। গোয়া ডিফেন্সের গড় বয়স তিরিশের বেশি। এটিকে-র স্কোরলাইন আরও ঝলমলে দেখাত যদি রফিক কয়েকটা সহজ সুযোগ নষ্ট না করতেন।

হাবাস? কলকাতা কোচের কাছে এই ম্যাচ শুধু সেমিফাইনালের দিকে আরও এক পা বাড়ানোর লড়াই ছিল না, জিকোর জেদকে বশ্যতা স্বীকার করানোরও যুদ্ধ ছিল। নিটফল, গোয়াকে উড়িয়ে আইএসএলে আটলেটিকো কলকাতা লিগের একটা মোক্ষম আবহে ফের ‘ফার্স্ট বয়’। সমালোচকদের বুঝিয়ে দিলেন, পস্টিগা ফিরে এলেও মার্কিকে এ দিনও দলের বাইরে রেখে তিনি ভুল করেননি। বলে দিলেন, ‘‘মুম্বইকেও চার গোল দিয়েছিলাম। তবে আজকের জয়ের আনন্দই আলাদা।’’ গোয়ার সঙ্গে তাঁর ‘নো কম্প্রোমাইজ’ অ্যাটিটিউড যাতে আরও বিতর্ক উস্কে না দেয়, হয়তো সেই চিন্তায় এ দিক-ও দিক একবার চোখ বুলিয়ে কলকাতা কোচের সূক্ষ্ম সংযোজন, ‘‘ওই ম্যাচে একটা গোল খেয়েওছিলাম। তাই এটা স্পেশ্যাল।’’

সরাসরি বললেন না। কিন্তু মনে মনে আন্তোনিও লোপেজ হাবাস নিশ্চিত জিকোর উদ্দেশ্যে একটা বার্তা পাঠিয়ে রাখলেন।

হে কিংবদন্তি, আমার গোঁ-র কাছে সেই তো তোমার গো-হারা।

আটলেটিকো দে কলকাতা: অমরিন্দর, তিরি, অর্ণব, হিউম (লেকিচ), গ্যাভিলান (আলোন্সো), বোরহা, রিনো, দ্যুতি, নাতো, অগাস্টিন, রফিক (আরাতা)।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement