Wrestler's Protest at Jantar Mantar

বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ, পুলিশের সঙ্গে বিবাদ, কুস্তিগিরদের দখলে রাজধানী

বিজেপি সাংসদ তথা জাতীয় কুস্তি সংস্থার সভাপতি ব্রিজ ভূষণ শরন সিংহকে গ্রেফতারির দাবিতে গত ২৩ এপ্রিল থেকে দিল্লিতে ধর্নায় বসেছেন কুস্তিগিররা। সেই ধর্না ৪ মে পড়ল ১১তম দিনে। মাঝে ঘটেছে অনেক কিছুই। তবে কেউ এখনও গ্রেফতার হননি।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০২৩ ২১:৩৭
Share:

ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর করার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা এখন বদলে গ্রেফতারির দাবি তোলা হয়েছে। — ফাইল চিত্র

জাতীয় কুস্তি সংস্থার প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরন সিংহকে গ্রেফতারে দাবিতে গত ২৩ এপ্রিল থেকে ধর্নায় বসেছেন দেশের প্রথম সারির কুস্তিগিররা। সেই ধর্না বৃহস্পতিবার পড়েছে ১১তম দিনে। এর মধ্যে বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছে দেশ। ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর করার দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তা এখন বদলে গ্রেফতারির দাবি তোলা হয়েছে। এর মাঝে কুস্তিগিরদের পক্ষে অনেকে সওয়াল করেছেন। অনেকে বিরোধিতা করেছেন। বুধবার পুলিশের সঙ্গে কুস্তিগিরদের খণ্ডযুদ্ধও হয়েছে।

Advertisement

গত ২৩ এপ্রিল প্রায় তিন মাস পর আবার দিল্লির যন্তর মন্তরে ধর্নায় বসেন দেশের নামী কুস্তিগিররা। ব্রিজভূষণ শরন সিংহকে গ্রেফতারের দাবিতে আবার ধর্না শুরু করেন তাঁরা। পাশাপাশি দিল্লি পুলিশের দিকেও অসহযোগিতার অভিযোগ তোলেন। দাবি করেন, মহিলা কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতন করা হলেও তাঁদের অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও এফআইআর দায়ের করা হচ্ছে না।

সে দিনই দিল্লির কন্নট প্লেস থানায় ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়। কিন্তু পুলিশ এফআইআর দায়ের করতে চায়নি। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে কুস্তিগিররা ধর্না শুরু করেন। অলিম্পিক্সে পদকজয়ী সাক্ষী মালিক জানান, সরকারি প্যানেলের কাজকর্মে তাঁরা ক্ষুব্ধ। ব্রিজভূষণের সম্পর্কে কোনও রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সাক্ষী বলেন, “আমরা সেই রিপোর্ট চাই যেখানে মহিলা কুস্তিগিরদের বয়ান রয়েছে। সেটি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। এটা স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ এর মধ্যে এক নাবালিকার অভিযোগও রয়েছে।’’

Advertisement

আন্তর্জাতিক মঞ্চে একাধিক পদকজয়ী বজরং পুনিয়া বলেন, “ব্রিজভূষণ গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখান থেকে কোথাও যাচ্ছি না।” বিনেশ ফোগাট জানালেন, বার বার চেষ্টা করেও সরকারের থেকে কোনও উত্তর পাচ্ছেন না। বলেছেন, “যত দিন না বিচার পাই আমরা এখানেই খাব এবং ঘুমাব। ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং বাকি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি গত তিন মাস ধরে। কমিটির তরফেও কোনও উত্তর দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের ফোন ধরা হয় না। দেশের হয়ে এত পদক জিতেছি। তার পরেও আমাদের কেরিয়ার খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।”

তাঁদের এই ধর্নায় সব রাজনৈতিক দলকে যুক্ত হওয়ার ডাক দেন বজরং। তিনি বলেন, ‘‘এ বার আমরা চাই যে কংগ্রেস, বিজেপি, আম আদমি পার্টির মতো সব দল আমাদের সমর্থন করুক। পাশে দাঁড়াক। সবাইকে স্বাগত। কারণ, আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের নই। এই লড়াই কুস্তিগিরদের জন্য লড়াই।’’ সাক্ষী বলেন, “আমরা সেই রিপোর্ট চাই যেখানে মহিলা কুস্তিগিরদের বয়ান রয়েছে। সেটি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। এটা স্পর্শকাতর বিষয়, কারণ এর মধ্যে এক নাবালিকার অভিযোগও রয়েছে।’’

২৫ এপ্রিল দিল্লি পুলিশকে নোটিস পাঠায় সুপ্রিম কোর্ট। ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করার আবেদন জানিয়ে মামলা হয়েছিল শীর্ষ আদালতে। একই দিন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনেন কুস্তিগির বিনেশ ফোগট। তাঁর দাবি ছিল, হেনস্থার শিকার হওয়া মহিলা কুস্তিগিরদের পরিচয় ফাঁস করে দিয়েছে দিল্লি পুলিশ। শুধু তাই নয়, জাতীয় সংস্থার কয়েক জন কর্তা নাকি অভিযোগ প্রত্যাহার করার জন্য আক্রান্তদের ভয় দেখাচ্ছেন। এমনকি তাঁরা নাকি ঘুষও দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

সে দিন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘অভিযোগ গুরুতর।’’ নোটিস জারি করে ২৮ এপ্রিলের মধ্যে দিল্লি পুলিশকে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশও দেন তিনি।

এর মধ্যেই অভিযোগ অন্য একটি অভিযোগ ওঠে। ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে যৌননিগ্রহের অভিযোগে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটির সদস্য তথা প্রাক্তন কুস্তিগির ববিতা ফোগাট ফাইনাল রিপোর্ট দেখছিলেন। কিন্তু ববিতার অভিযোগ সেই রিপোর্ট পুরোটা দেখার আগেই কেড়ে নেন রাধিকা শ্রীমান। তিনিও ওই তদন্ত কমিটির এক জন সদস্য।

যে কমিটি তদন্ত করছে, সেখানেই এমন বিভেদ ঘটায় অবাক হন সকলেই। সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে ববিতা তখন বলেন, “রিপোর্টটা সবে পড়তে শুরু করেছিলাম। কয়েকটা পাতাই মাত্র পড়েছি। কিছু বিষয় নিয়ে আমার আপত্তিও ছিল। এমন সময় রাধিকা শ্রীমান এলেন এবং আমার হাত থেকে রিপোর্টটা কেড়ে নিলেন। তিনি বলেন, আমি ফোগাট পরিবারের অংশ। তারা আন্দোলন করছে। সেই কারণে আমি রিপোর্ট পড়তে পারব না।”

ববিতাদের এই কমিটিতে ছিলেন মেরি কম। তাঁর নেতৃত্বেই তদন্ত হয়েছে। রাধিকা কমিটিতে ছিলেন মেরি কমের প্রতিনিধি হয়ে। ববিতা সেই ঘটনার পরে বলেন, “চেয়ারম্যান মেরি কমের হয়ে কমিটিতে ছিলেন রাধিকা। আমাকে তিনি বলেন যে, চেয়ারম্যান এই রিপোর্টে সেই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।” রাধিকা যদিও এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “আমি এমনটা কেন করব? এই কাজ করে আমার কী লাভ হবে? সত্যি বলতে ববিতা রিপোর্টটি চার-পাঁচ বার পড়েছেন এবং সম্মতি দিয়েছেন। রিপোর্টে লেখা সব কথা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে ববিতাকে। রিপোর্টে যা লেখা রয়েছে, সেটার পক্ষে প্রমাণও আছে। কোনও ভাবে ওই রিপোর্টকে ভুয়ো বলা যাবে না।”

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও চলে আসেন কুস্তিগিরদের নিশানায়। গত ২৭ এপ্রিল এক সাংবাদিক বৈঠকে ২০১৬ রিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ জয়ী সাক্ষী বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মোদী স্যর বারবার করে বেটি বাঁচাও এবং বেটি পড়াও-র উপরে জোর দিয়ে থাকেন। উনি সকলের মনের কথা শোনেন। তিনি কি আমাদের মনের কথা শুনবেন?’’ সেখানেই না থেমে সাক্ষী আরও বলেন, ‘‘পদক জেতার পরে তিনি নিজের বাড়িতে আমাদের সকলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রত্যেককে সম্মান জানিয়ে নিজের মেয়ে বলে আমাদের পরিচয় দিয়েছিলেন। আজ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমাদের মনের কথাও শুনুন।’’ যদিও সাক্ষী তার সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর কানে এই খবর গিয়ে পৌঁছয়নি। আমরা তাঁর সঙ্গে দেখা করে বিষয়টি জানাতে চাই।’’

সেখানেই থেমে থাকেননি সাক্ষী। তিনি আক্রমণ করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকেও। সাক্ষীর মন্তব্য, ‘‘আমি স্মৃতি ইরানিকে প্রশ্ন করতে চাই, তিনি এখন নীরব হয়ে রয়েছেন কেন?’’ যোগ করেন, ‘‘গত চার দিন ধরে আমরা রাস্তায় শুয়ে রয়েছি। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। দিল্লি পুলিশ আমাদের খাবার বা অনুশীলন করার অনুমতি পর্যন্ত দিচ্ছে না। আপনি এখনও নীরব কেন? আপনি একবার এখানে আসুন, আমাদের কথা শুনুন। আমাদের সমর্থন করুন।’’

কুস্তিগির বিনেশ বলেন, ‘‘আমাদের কাছে সেই মানুষগুলির ফোন নম্বর নেই, যাঁদের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের এই অবস্থার কথা জানাতে পারি। তাই সংবাদামাধ্যেমের মারফত আমরা তাঁর কাছে এই বার্তা পাঠাতে চাই।’’ বিনেশ যোগ করেন, ‘‘মনের দিক থেকে আমরা মৃতপ্রায় হয়ে গিয়েছি। আশা করি, আমাদের কান্না এ বার তাঁর কানে পৌঁছবে।’’ বিনেশ আরওো বলেন, ‘‘উনি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান করেন। অথচ আমাদের মনের কথা শোনার মতো একটা মিনিটও কি তাঁর কাছে নেই।’’ যোগ করেন, ‘‘এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের আর কিছু নেই যে, দেশের মেয়েরা রাস্তায় বসে রয়েছে এবং একজন অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য কুস্তি ছাড়ার কথা ভাবতে শুরু করেছে!’’

প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন অলিম্পিক্সে সোনা জয়ী শুটার অভিনব বিন্দ্রা। তিনি টুইট করেন, ‘‘খেলোয়াড় হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করি। এটা অত্যন্ত দুঃখের যে, জাতীয় কুস্তি সংস্থার প্রশাসকদের বিরুদ্ধে হেনস্থার প্রতিবাদে রাস্তায় বসে রয়েছেন। আমি এদের সঙ্গেই রয়েছি।’’

এর পরে অলিম্পিক্স পদকজয়ী কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়ান প্রাক্তন ফিজিয়ো পরমজিৎ মালিক। তাঁর দাবি ছিল, ব্রিজভূষণ যৌননিগ্রহ করতেন। সেটার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন বলে ২০১৪ সালে চাকরি গিয়েছিল বলেও দাবি পরমজিতের। এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পরমজিৎ বলেন, “সংবাদমাধ্যমের কাছে আমি জানিয়েছিলাম যৌননিগ্রহের কথা। ২০১৪ সালে সেই কথা বলার পর সাই থেকে আমাকে এবং স্ত্রীকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। গীতা ফোগাটের ব্যক্তিগত ফিজিয়ো হিসাবে আমি সাই-তে গিয়েছিলাম। পরে আমাকে সাইয়ের ফিজিয়ো হিসাবে নেওয়া হয়।”

পরমজিৎ জানান যে, সেই সময় ব্রিজভূষণের হয়ে কাজ করতেন ধীরেন নামে এক ব্যক্তি। তাঁদের বিরুদ্ধে যৌননিগ্রহের অভিযোগ লিখিত ভাবেও জমা দেওয়া হয়েছিল বলে দাবি পরমজিতের। যদিও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরমজিৎ বলেন, “অলিম্পিয়ান, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে পারছে না। আমি তো পারবই না। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।”

২০১৪ সালে লখনউয়ের সাইয়ে ছিলেন পরমজিত। তাঁর কাছে চার-পাঁচ জন মহিলা কুস্তিগির যৌননিগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। সেই অভিযোগ জানাতে গিয়েই তাঁর চাকরি গিয়েছিল। সাই থেকে বার করে দেওয়া হয়েছিল পরমজিতের স্ত্রী কুস্তিগির সুমন কুণ্ডুকে।

এর পর কুস্তিগিররা বিবাদে জড়ান পি টি ঊষার সঙ্গে। ২৭ এপ্রিল এক অনুষ্ঠানে ঊষা বলেন, “খেলোয়াড়দের উচিত হয়নি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করা। ওদের উচিত ছিল কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার অপেক্ষা করা। খেলা এবং দেশের গর্বের জন্য ওদের এই প্রতিবাদ সঠিক নয়। নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে চলছে ওরা। এতে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে।” প্রতিবাদে কুস্তিগির সাক্ষী মালিক বলেন, “পিটি ঊষার কথায় আমরা ব্যথিত। একজন মহিলা হয়েও উনি আমাদের প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছেন না। কী অন্যায় করেছি আমরা? শান্তিতে এখানে বসে ধর্না দিচ্ছি। বিচার পেলে নিশ্চয়ই এ কাজ করতাম না।” কুস্তিগির বিনেশ ফোগাট জানান, ঊষাকে একাধিক বার ফোন করলেও তিনি ধরেননি। বিনেশের কথায়, “জানি না উনি কোনও চাপের মধ্যে রয়েছেন কিনা।”

সে দিনই কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর জানান, কুস্তিগিরদের সমস্যা মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের বলেন, “যন্তর মন্তরে অনেকে বসে রয়েছে। কেউ ওদের সঙ্গে কথা বলেনি। আমি হিমাচল প্রদেশে সব কাজ ছেড়ে ওদের সঙ্গে ১২ ঘণ্টা কথা বলেছি। রাতে সাংবাদিক বৈঠক করেছি। একটা কমিটি তৈরি করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার ক্রীড়াবিদদের পাশেই রয়েছে এবং সাহায্য করেছে। অন্যায়ের সঙ্গে কোনও আপস করা হবে না।”

বিক্ষোভের মধ্যে কুস্তিগিররা পাশে পান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাকে। ২৮ এপ্রিল দুপুর ১.৩০টা নাগাদ টুইট করে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, “যে সব কুস্তিগিররা প্রতিবাদ করছে তাদের পাশে আমাদের দাঁড়ানো দরকার। ওরা সবাই এক হয়ে কথা বলছে। আমাদের ক্রীড়াবিদরা দেশের গর্ব। ওরাই আসল চ্যাম্পিয়ন। প্রকৃত দোষী যে রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন, তাঁকে প্রকাশ্যে আনা উচিত। ন্যায়বিচার হওয়া দরকার। সত্যের জয় হোক।”

শুধু ক্রীড়াবিদ হিসাবে নয়, মহিলা হিসাবেও কুস্তিগিরদের পাশে থাকার বার্তা দেন সানিয়া। তিনি লেখেন, “শুধু ক্রীড়াবিদ হিসাবে নয়, একজন মহিলা হিসাবেও ওদের ধর্না দিতে দেখা কঠিন। ওরা আমাদের দেশকে সম্মান এনে দিয়েছে। তখন আমরা ওদের সঙ্গে উৎসব করেছি। আপনিও যদি সেটা করে থাকেন, তা হলে এই কঠিন সময়েও ওদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। এটা খুবই স্পর্শকাতর বিষয় এবং গুরুতর অভিযোগ। আমি চাই সত্য প্রকাশ্যে আসুক এবং ন্যায়বিচার পাক সবাই। দেরি না হয়ে যায়।”

সে দিন রাতে অবশেষে জয় হয় কুস্তিগিরদের। ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে রাতের দিকে দু’টি এফআইআর দায়ের করে দিল্লি পুলিশ। দু’টি এফআইআর-ই ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন নির্যাতনের ভিত্তিতে দায়ের করা হয়। দিল্লি পুলিশের থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন এক নাবালিকা। তাই একটি এফআইআর ‘পকসো’ ধারা মেনে সেই নাবালিকার অভিযোগের ভিত্তিতে দায়ের করা হয়। দ্বিতীয় এফআইআরের ক্ষেত্রে বাকি কুস্তিগিরদের যৌন নির্যাতনের অভিযোগের কথা মাথায় রেখে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের জন্য দায়ের করা হয়। দিল্লির কনট প্লেস থানায় মোট সাতটি অভিযোগ করেছিলেন কুস্তিগিররা।

ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে যে এফআইআর দায়ের করা হবে তা সে দিন সকালেই জানা গিয়েছিল। দিল্লি পুলিশের তরফে আইনজীবী তুষার মেহতা সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় এবং বিচারপতি পিএস নরসিংহের বেঞ্চকে জানিয়েছিলেন, শুক্রবারই এফআইআর দায়ের করা হবে অভিযুক্ত কুস্তি সংস্থার কর্তা তথা কাইজারগঞ্জের বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে। সেই প্রতিশ্রুতিই রক্ষা করা হয়।

এর মধ্যে পি টি ঊষার মন্তব্যের প্রতিবাদ আসতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। সমাজমাধ্যমের পাতায় একটি টুইট করে অভিনেত্রী পূজা ভট্ট লেখেন, ‘‘দেশের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্বদের ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হয়েছে। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কিছু হয় না। তার পরেও পিটি ঊষার মতো কিংবদন্তিদের কাছ থেকে এমন কথা শুনতে হচ্ছে তাঁদের।’’ পূজার পাশাপাশি প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়ান বলিউড অভিনেত্রী স্বরা ভাস্কর এবং অভিনেতা সোনু সুদও। টুইটারে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করে স্বরা লেখেন, ‘‘দেশের সেরা খেলোয়াড়দের যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ও ন্যায় বিচার চাইতে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। এটা লজ্জাজনক। আর সরকার সমানে বিজেপি বিধায়ককে আড়াল করে যাচ্ছে।’’ সোনু লেখেন, ‘‘আমার বিশ্বাস, আমাদের দেশের কুস্তিগিররা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই কুস্তি জিতবেন। জয় হিন্দ।’’

এর মধ্যেই দুই বোন ববিতা এবং বিনেশের মধ্যে লেগে যায়। ২৯ এপ্রিল ধর্নামঞ্চে গিয়েছিলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গান্ধী। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী সন্দীপ সিংহ। এই ঘটনা নিয়ে সমাজমাধ্যমে ববিতা লেখেন, ‘‘প্রিয়ঙ্কা তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে নিয়ে ধর্নামঞ্চে গিয়ে কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা মহিলা কুস্তিগিরদের ন্যায়বিচার চাইছেন। কিন্তু সন্দীপ নিজেই তো এক দলিত মহিলার শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত। তিনি কী ভাবে মহিলাদের হয়ে কথা বলছেন।’’

এই মন্তব্যের পাল্টা একটি টুইট করেন বিনেশ। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘তুমি যদি মহিলা কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়াতে না পারো, তা হলে আমি অনুরোধ করব, দয়া করে আমাদের আন্দোলন দুর্বল করে দিয়ো না। হাতজোড় করে অনুরোধ করছি। এত বছর পরে মহিলা কুস্তিগিররা প্রতিবাদ করছে। তুমিও তো এক জন মহিলা। আশা করি তুমি আমাদের কষ্টটা বুঝবে।’’ ববিতার দিদি গীতা অবশ্য কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়ান। তিনি টুইটে লেখেন, ‘‘আমি প্রত্যেক দেশবাসীকে অনুরোধ করছি, আপনাদের যে মেয়ে-বোনেরা নিজেদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, তাঁদের পাশে দাঁড়ান। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এর সঙ্গে রাজনীতি মেলাবেন না। সবাই এসে একসঙ্গে প্রতিবাদ করুন।’’

এর পরে চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করেন অভিযুক্ত ব্রিজ ভূষণ। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পর্কে একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্রিজ ভুষণ বলেন, ‘‘প্রথমে ওরা অভিযোগ করল আমি ১০০ নাবালিকাকে যৌন নিগ্রহ করেছি। এখন বলছে আমি ১০০০ নাবালিকাকে যৌন নিগ্রহ করেছি। আমি কি রোজ শিলাজিত দিয়ে বানানো রুটি খেতাম?’’ তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন ব্রিজ ভুষণ। তিনি জানিয়েছেন, সব ধরনের তদন্তে সহযোগিতা করবেন তিনি। কিন্তু পদত্যাগ করবেন না। কারণ, তা হলে কুস্তিগিরদের অভিযোগকেই মান্যতা দেওয়া হবে।

৩ মে কুস্তিগিরদের সঙ্গে দেখা করেন ঊষা। তার পরেই তাঁর গলায় উল্টো সুর। ঊষা কুস্তিগিরদের সঙ্গে দেখা করার পর বজরং পুনিয়া বলেন, “যখন উনি ওই কথা বলেছিলেন তখন খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। আজ এসে আমাদের বললেন, ওঁর মন্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। জানিয়েছেন, উনি আগে একজন ক্রীড়াবিদ, তার পরে প্রশাসক।” বজরং যোগ করেন, “আমরা ওঁকে জানালাম যে ন্যায়বিচার চাই। সরকার, বিরোধী দল বা কারও সঙ্গে আমাদের ঝামেলা নেই। আমরা এখানে বসে আছি কুস্তির ভালর স্বার্থে। সমস্যা যদি মিটে যায় এবং অভিযোগ প্রমাণিত হয় তা হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”

ঊষা কি সরকার বা আইওএ-র তরফে কোনও সমাধান নিয়ে এসেছিলেন? বজরং বলেন, “সে ব্যাপারে কোনও কথা হয়নি।” তবে ঊষার সঙ্গে কথা বলে যে তারা তৃপ্ত, সে কথাও জানিয়েছেন। বলেছেন, “উনি যদি কোনও প্রতিশ্রুতি দেন, তা হলে নিশ্চয়ই সেটা রক্ষা করবেন। কিন্তু আমরাও জানিয়ে দিয়েছি, যত দিন না বিচার পাচ্ছি তত দিন প্রতিবাদ চলবে।”

ঊষা দেখা করার দিন রাতেই ঘটে যায় ধুন্ধুমার। ৩ মে মধ্যরাতে হঠাৎ পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে শুরু হয় কথা কাটাকাটি। শেষ পর্যন্ত তা হাতাহাতিতে পৌঁছয়। বিক্ষোভকারী কুস্তিগিরদের অভিযোগ, দিল্লি পুলিশের একটি দল মত্ত অবস্থায় বুধবার সন্ধ্যা থেকেই তাঁদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করতে শুরু করেন। রাতে তাঁরা আচমকাই এসে মারধর করেন এবং মহিলা কুস্তিগিরদেরও গালিগালাজ করেন। তাঁদের দাবি, এতে দুই আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। এক জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।

বিনেশ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “সারা দিন বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাটি ভিজে থাকায় আমরা বিক্ষোভস্থলে খাট পাতার চেষ্টা করছিলাম। তখনই পুলিশ আমাদের উপর হামলা করে। একজনও মহিলা পুলিশকর্মী ছিলেন না। এই সময় ধাক্কধাক্কিতে কেউ কেউ মাথাতেও আঘাত পান।” এর পরেই কান্নায় ভেঙে পড়েন বিনেশ। তিনি বলেন, “আমরা কোনও দাগি আসামি নই যে পুলিশ আমাদের সঙ্গে এরকম আচরণ করবে। এই দিনটি দেখার জন্যই কি আমরা দেশের হয়ে এত পদক জিতলাম?”

বজরং সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, “সারা দেশের মানুষের আমাদের পাশে এসে দাঁড়ানো উচিত। দিল্লি পুলিশ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ না করে আমাদের উপর বলপ্রয়োগ করছে।” বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি পদক জেতা বজরং বলেন, “আমি সরকারকে অনুরোধ করব যেন আমার সব পদক ফিরিয়ে নেওয়া হয়।”

পুলিশের দাবি ছিল অন্য। দিল্লি পুলিশের ডিসিপি প্রণব তয়াল বলেন, “বুধবার রাতে আপ নেতা সোমনাথ ভারতীর নেতৃত্বে কয়েক জন অনুমতি ছাড়াই বিক্ষোভস্থলে এসে উপস্থিত হন। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই তাঁরা পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন। সোমনাথ এবং তাঁর লোকেদের সমর্থন জোগান বিক্ষোভরত কুস্তিগিরেরা। পুলিশ যথাসময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে অনভিপ্রেত ঘটনা রুখতে সক্ষম হয়েছে।” ডিসিপি আরও জানান, সোমনাথ এবং তাঁর দুই সমর্থককে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়েছে।

ঘটনার পর দিল্লি পুলিশ যন্তরমন্তর এলাকা সিল করে দেয় এবং কাউকে বিক্ষোভের জায়গায় ঢুকতে অনুমতি দেয়নি। এএনআইকে ডিসিপি প্রণব বলেন, “কুস্তিগিরদের লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বলা হয়েছে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে যথাযথ পদক্ষেপ করা হবে। যেই পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ তাঁর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানো হবে।”

৪ মে সকালে ধর্নামঞ্চের কাছে একটি বিলাসবহুল হোটেলের রেস্তরাঁয় স্ত্রীর সঙ্গে বজরংয়ের নৈশভোজের ছবি সামনে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে আন্দোলন ঘিরে। তার জবাব দেন বজরং। বলেন, ‘‘অনেক গুজব ছড়াচ্ছে। এ-ও বলা হচ্ছে যে, রাতে নাকি ধর্নামঞ্চে কেউ থাকে না। সংবাদমাধ্যমের অনেকেই রাতে আমাদের সঙ্গে থাকছেন। তাঁরা তো সবটাই দেখতে পাচ্ছেন।’’ কেন বিলাসবহুল হোটেলে স্ত্রী সঙ্গীতা ফোগটকে নিয়ে বজরং গিয়েছিলেন, তারও জবাব দিয়েছেন তিনি। বজরং বলেছেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে অনেক মহিলা আছে। তাদের শৌচাগার ব্যবহার করতে হয়। জামাকাপড় বদলাতে হয়। সেটা তো আর রাস্তায় হবে না। সেই কারণেই হোটেল ব্যবহার করতে হয়েছে।’’ একই কথা শোনা গিয়েছে সাক্ষীর মুখে। তিনি বলেছেন, ‘‘দিল্লি পুলিশ গুজব ছড়াচ্ছে। ওরা বলছে রাতে নাকি এখানে কেউ থাকে না। যে কোনও দিন ধর্নামঞ্চে এসে দেখে যেতে পারেন আমরা আছি কি না।’’

বিনেশ জানিয়েছেন, তাঁদের আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে অনেক সাধারণ মানুষ আসছেন। কিন্তু তাঁদেরও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে দিল্লি পুলিশ। তিনি বলেছেন, ‘‘একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে কয়েক জন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু পুলিশ তাদের বলেছে যে আমরা দুপুরে ধর্নায় বসি আর রাতে চলে যাই। সেটা শুনে কেউ ওদের বলে যে পুলিশ মিথ্যা কথা বলছে। তার পরে ওরা আমাদের সঙ্গে দেখা করে। আমাদের আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে পুলিশ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement