আখতার আলি
রবিবার বেশ সকালে জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ফোন। সুপ্রভাত জানাতে একটু থমকে বললেন, ‘‘আখতার আর নেই’’। ভারতের প্রাক্তন ডেভিস কাপ অধিনায়কের মৃত্যু সংবাদটা এসেছিল আর এক ডেভিস কাপ অধিনায়ক কিংবদন্তি জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমেই। এর কিছুক্ষণ পরে বেঙ্গল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের কর্তা সুজয় ঘোষ বললেন, আখতার আলির প্রয়াত হওয়ার খবর তিনি পেয়েছেন ভোর ৬টায়। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলাতে যাওয়া ভারতের অন্যতম সেরা আম্পায়ার অভিষেক মুখোপাধ্যায় তাঁকে সুদূর মেলবোর্ন থেকে কাকভোরেই খবরটা দিয়েছেন।
ঠিক এটাই হলেন আখতার আলি। খেলোয়াড় আখতারের মূল্যায়নের ধৃষ্টতা না থাকলেও নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া যায়, এ দেশের এই প্রজন্মের টেনিস মহলে তিনি এরকমই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রয়াত হওয়ার দুঃখ তাই এই শহর, দেশ ছেড়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তেও সময় লাগেনি। আক্ষরিক অর্থে নিজের হাতে তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন ভারতীয় টেনিসের পরবর্তী প্রজন্মকে। রমেশ কৃষ্ণান, লিয়েন্ডার পেজ থেকে শুরু করে এক সময়ে বাংলার অন্যতম সেরা পারেখ বোনরাই (ঋদ্ধিনা ও প্রিয়ঙ্কা) হোক, বা প্রতিভাবান শিবিকা বর্মন, ত্রেতা ভট্টাচার্যরাই হোক, আখতারের ছোঁয়াতেই এঁরা স্বপ্ন দেখেছিলেন। সাউথ ক্লাব, কলকাতা জিমখানা, বিটিএ- কমলা, সবুজ, নীল টেনিস কোর্টগুলোয় খুদেদের হাত ধরে ছিল তাঁর নিজস্ব বিচরণ।
সহজ, সরল, ফলপ্রসু প্রশিক্ষণের জন্যই প্রশিক্ষক আখতার আলি খেলোয়াড় আখতারের থেকে অনেক গুণ বেশি জনপ্রিয়। নানা সময়ে গল্প করতে করতে তিনি বুঝিয়েছেন, কেন ছোটদের কোচিং করানো কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই কী অবলীলায় সাফল্যের সঙ্গে করতে পেরেছেন, শিবিকা-পারেখদের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যাবে। এমনকী সানিয়া মির্জার মতো আন্তর্জাতিক তারকাও যে আখতারের টোটকায় উপকার পেয়েছিলেন, সেটাও তাঁর সঙ্গে এবং তাঁর বাবা ইমরানের সঙ্গে আলাপচারিতায় ফুটে উঠেছে একাধিকবার। হয়ত সেই কারণেই এই শহরের গণ্ডি পেরিয়ে সানিয়ার শহর হায়দরাবাদেও তিনি সমান জনপ্রিয়। সানিয়ার বিয়ের নিমন্ত্রণে গিয়ে সেই জনপ্রিয়তার আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। কলকাতার সাংবাদিক হওয়ায় নিজাম ক্লাবে পা রাখা মাত্র প্রশ্ন এসেছিল, ‘আখতার সাহেব কেমন আছেন?’
সানিয়ার সূত্রেই মানুষ আখতার আলির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের একটি স্মারক ডাক যোগে সানিয়ার পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু শুনলেন, কিছুদিনের মধ্যেই আখতার হায়দরাবাদে যাবেন। সেই স্মারক হাসি মুখের আখতার আলির মাধ্যমেই সযত্নে হাতে এসে পৌঁছেছিল। নিতান্তই সাদামাঠা, ছোটখাটো চেহারার মানুষটি কতটা সহজ, আঁচ পাওয়া গিয়েছিল। পরে একাধিকবার জানতে চেয়েছেন, ‘‘বান্ধবী আর কিছু পাঠাল?’’
‘আখতার সাহেব কেমন আছেন’, এই প্রশ্ন আর শোনা যাবে না। আখতার সাহেব নেই। জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের কাঁধে চেপে তাঁর কফিনবন্দি নিথর দেহ লোয়ার রেঞ্জের বাড়ি থেকে সাউথ ক্লাবের উদ্দেশে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই এই প্রশ্নটারও চির ইতি ঘটে গেল। এর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খবর এল, মাত্র তৃতীয় ভারতীয় মহিলা হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের মূলপর্বে উঠে অঙ্কিতা রায়না ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। ২৮ বছরের এই প্রজন্মের অঙ্কিতাও বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন আখতারি শিক্ষা। একটি ইতিহাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ইতিহাসের জন্ম ঘটে গেল। আর এটাই শেষ হয়ে যাওয়া ইতিহাসটির সাফল্য।