‘নতুন জামা কিনে দিয়েছিল শ্রীরূপাদি’

শ্রীরূপাদির আকস্মিক মৃত্যুর যন্ত্রণার মধ্যেই মনে পড়ে যাচ্ছিল অসংখ্য পুরনো স্মৃতি। তখন আমি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। শ্রীরূপাদি আমাকে উজ্জীবিত করে গিয়েছে ক্লান্তিহীন ভাবে ।

Advertisement

মিঠু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:১২
Share:

বিদায়: সল্টলেকের বাসভবনে শ্রীরূপাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বাংলার প্রাক্তন মহিলা ক্রিকেটাররা। নিজস্ব চিত্র

শ্রীরূপা বসু মুখোপাধ্যায়কে দিদি বলে ডাকতাম ঠিকই। আসলে ছিল আমার মা।

Advertisement

নভেম্বর মাসের শেষ দিনটা আমার কাছে সারা জীবন অভিশপ্ত হয়েই থাকবে। সল্টলেকের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে অনূর্ধ্ব-১৬ বাংলার মেয়েদের ট্রায়াল দেখছিলাম। হঠাৎই ফোনে মর্মান্তিক খবরটা পেলাম। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না শ্রীরূপাদি নেই। মঙ্গলবারই মেয়ে অমৃতাকে নিয়ে ইনদওর থেকে ফিরেছিল। শুক্রবার বিকেলেই আবার মেয়ের সঙ্গে শোলাপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই এই দুর্ঘটনা।

অথচ ডায়াবেটিস ছাড়া আর কোনও শারীরিক সমস্যা ছিল না ওর। সেই মানুষটা এ ভাবে যে চলে যেতে পারে, মেনে নেওয়া কঠিন। নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম এই বলে যে, খবরটা ভুল। শ্রীরূপাদির কিছু হতেই পারে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য আমার ভুলটা ভেঙে গেল।

Advertisement

শ্রীরূপাদির আকস্মিক মৃত্যুর যন্ত্রণার মধ্যেই মনে পড়ে যাচ্ছিল অসংখ্য পুরনো স্মৃতি। তখন আমি প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। শ্রীরূপাদি আমাকে উজ্জীবিত করে গিয়েছে ক্লান্তিহীন ভাবে।

সালটা সম্ভবত ১৯৮৩। দুর্গাপুরে পূর্বাঞ্চলের হয়ে খেলতে যাব। কিন্তু হাত একদম খালি। শ্রীরূপাদি হঠাৎ এগিয়ে এসে আমার হাতে পঞ্চাশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ‘‘যা, মন দিয়ে খেল।’’ আমার জামা ছিঁড়ে গিয়েছে। নতুন জামা কেনার মতো টাকা নেই। মন খারাপ করে বসে আছি। শ্রীরূপাদিকে দেখলাম আমার জন্য নতুন জামা নিয়ে হাজির।

আরও একটা ঘটনা ভীষণ মনে পড়ছে। চেন্নাইয়ে (তখন মাদ্রাজ) জাতীয় ক্রিকেট খেলতে গিয়েছি। মাদ্রাজ আইআইটি-র হস্টেলে আমাদের রাখা হয়েছিল। প্রচণ্ড জ্বরে কাবু হয়ে পড়েছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। দলের অনেকে সেই সময় বলেছিল, ‘‘মিঠু তো তামিল জানে না। ও একা একা কী করে থাকবে হাসপাতালে?’’ শ্রীরূপাদি বলল, ‘‘ভাষা না জানলেও মিঠু ঠিক বুঝিয়ে দেবে ওর কোথায় সমস্যা হচ্ছে।’’ শ্রীরূপাদির কথাই শেষ কথা। আমি ভর্তি হলাম হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ফিরে তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ন’রানে তিন উইকেট নিলাম।

শ্রীরূপাদির আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ক্রিকেটারদের কাছ থেকে সেরাটা বার করে আনার। কর্নাটকের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে আমরা ব্যাট করছিলাম। প্রথম ইনিংসে আমার রান ছিল ৪১। শ্রীরূপাদি করেছিল ৪২ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে আমি করেছিলাম ৫৭। দিদির রান ৫৬। পুরো ম্যাচটায় ক্রিজে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ আমাকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছিল। ওর অধিনায়কত্বে সাত বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলা। আমি ছিলাম পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য।

দলের সকলকেই আগলে রাখত মায়ের মতো। কখনও অধিনায়ক হিসেবে। কখনও ম্যানেজার হিসেবে। আর কর্তাদের স্পষ্ট বলে দিত, ‘‘আমি ছাড়া কেউ মেয়েদের পারফরম্যান্স নিয়ে সমালোচনা করতে পারবে না। কেউ কোনও ভুল করলে আমি শুধু বকব।’’ আমার দেখা ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক।

শ্রীরূপাদি ছিল আমাদের মুশকিল আসানও। বিনা সঙ্কোচে দল বেঁধে ওকে বলতাম, তাড়াতাড়ি টাকা দাও, আমরা খেতে যাব। সঙ্গে সঙ্গে হেসে ব্যাগ থেকে টাকা বার করে দিত।

আজ থেকে আর আবদার করার মতো কেউ রইল না।

(লেখিকা: ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বাংলার নির্বাচক কমিটির প্রধান)।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement