চার মেয়ের সঙ্গে গর্বিত মা লিটিনা।
মা হতে চেয়েছিলেন তিনি। সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে নতুন উদ্যমে বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই পথই যে বন্ধ। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন তাঁর মা হওয়ার ইচ্ছায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্তের মধ্যে বাসা বাঁধা ক্যানসারের জীবাণু।
কিন্তু ইচ্ছাশক্তির কাছে অনেক সময় হার মানতে হয় মারণ রোগকেও। আর তাই কোনও বাধাই দমাতে পারল না নটিংহ্যামের লিটিনা কৌরকে। জন্মসূত্রে ভারতীয়। বয়স যখন সবে সতেরোর কোঠায় একদিন জানতে পারেন, রক্তে আস্তানা গেড়েছে অ্যাকিউট মেলয়েড লিউকোমিয়ার জীবাণু। শুরু হল বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট। মুহূর্তে চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। প্রাথমিক ভাবে ভেঙে পরলেন লিটিনা। মা হওয়ার তীব্র বাসনা তাঁকে ফেরাল লড়াইয়ে। তাই ১৭ বার মিসক্যারেজের পরেও চার কন্যার জন্য বাঁচছেন গর্বিত মা। সেদিন আর এদিনে পার্থক্য নেই তেমন কিছুই। শুধু বদলেছে লড়াইয়ের প্রেক্ষিত।
লড়াইটা এখন শুধুই রক্ত কোষে ঘাঁটি গেড়ে বসা মৃত্যু রোগের চৌহদ্দিতে আটকে নেই। বরং ছাড়িয়ে পড়েছে নিজের প্রতিটি রক্তবিন্দু দিয়ে চার মেয়েকে বড় করার মধ্যে। কেমন ছিল সেই লড়াই? লিটিনার মুখেই শোনা গেল সেই যুদ্ধের প্রতিটা পর্ব।
কিরণ ও কাজল। একজন ব্যস্ত চুষিকাঠিতে, অন্যজন দুধের বোতলে মগ্ন
‘‘প্রথম থেকেই জানতাম মা হতে পারব না। কিন্তু তখনও এতটা গভীরে ভাবিনি। ২৩ বছর বয়সে বিয়ে হল আমার। বিয়ের পর যখন পরিবার হল তখন এই সত্যিটা মেনে নিতে পারতাম না। ভেঙে পড়েছিলাম।’’
হয়তো এখানেই হারিয়ে যেতে পারতেন লিটিনা। আর পাঁচ জনের মতো রোগকেই নিজের ভবিতব্য ধরে নিতে পারতেন লিটিনা। কিন্তু হাল ছাড়েননি সাহসিনী। ক্যানসারের বিরুদ্ধে শুরু হয় এক অসম লড়াই।
আরও পড়ুন: পর্দার আড়ালে নয়, বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত এই সৌদি রাজকুমারী
‘‘চিকিৎসকের পরামর্শেই নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। প্রথমে দত্তক নেওয়ার কথা ভাবি। কিন্তু মন থেকে সায় পেলাম না। নিজে মা হতে চাইছিলাম। কিন্তু বাচ্চাদের বাঁচাতে পারছিলাম না। পরপর মিসক্যারেজ হচ্ছিল।’’
উপায় না দেখে অবশেষে আইভিএফ পদ্ধতির দারস্থ হন লিটিনা। আমেরিকার স্টেট ফান্ডেড ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস বা এমএইচএস-এর প্রথম চেষ্টা সফল হয়নি। সেটা ২০১২ সাল। এরপর লিটিনা চলে আসেন ভারতে। ২০১৩ থেকে ২০১৫-এর মধ্যে ভারতে শুরু করেন চিকিৎসা। লিটিনার ডিম্বানু সংরক্ষণ করে সারোগেসির মাধ্যমে শিশুর জন্ম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ছয় ছয়বার উদ্যোগ নেওয়ার পরেও সাফল্য আসছিল না।
কবিতা, কাজল ও কিরণ। মায়ের কোলে ছোট্ট কিয়ারা
যখন প্রায় সমস্ত আশাই ছেড়ে দিয়েছেন সবাই, তখনই ২০১৫-তে কনসিভ করলেন লিটিনা। কিন্তু ভয়টা দানা বাঁধছিল মনের গভীরে। লিটিনার কথায়, ‘‘আমি আর আমার স্বামী রোজই অপেক্ষা করতাম আরও একটা মিসক্যারেজের। কিন্তু একটা সময় বুঝলাম আমরা পেরেছি।’’
লিটিনা জানালেন, সময়টা খুব কঠিন ছিল। গাড়ি চালানো তো বটেই, বাড়ি থেকে বেরনো পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন। কোনওরকম অতিরিক্ত স্ট্রেস নিতে চাননি। সবসময়ই মনের ভিতরে একটা ভয় কাজ করত। সুখবরটাও কাউকে জানাতে পারেননি। তাঁর মিসক্যারেজ নিয়ে আবার লোকে আলোচনা করুক এটা চাইতেন না লিটিনা।
কবিতা ও কাজলের সঙ্গে খেলায় মত্ত বড় মেয়ে কিরণ
কিন্তু এ বার সত্যিই একে একে খুলে যেতে লাগল বন্ধ দরজাগুলো। সেপ্টেম্বরে জন্ম দিলেন প্রথম মেয়ে কিরণের। সি-সেকশন ডেলিভারি হল নটিংহ্যামের কুইন্স মেডিক্যাল সেন্টারে। নভেম্বরে ভারতে সফল হল সারোগেসির চেষ্টাও। জন্ম হল যমজ মেয়ে কাজল আর কবিতার। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফের গর্ভবতী হন লিটিনা। ২০১৬-র জুনে নটিংহ্যামের ওই একই হাসপাতালে জন্ম হয় কিয়ারার। তবে এ ক্ষেত্রে মাত্র ২৮ সপ্তাহে প্রি-ম্যাচিওর অবস্থায় জন্ম হয় কিয়ারার। জন্মের পর ৯ সপ্তাহ তাঁকে থাকতে হয়েছিল নিওনেটাল কেয়ারে। তবে এখন সে দিব্যি সুস্থ। সমস্ত বিপদ কাটিয়ে তিন দিদির সঙ্গে বাড়ি মাতিয়ে রেখেছে মাস সাতেকের কিয়ারা।
আর লিটিনা কৌর? চার মেয়েকে কোলে নিয়ে উজ্জ্বল মুখে লিটিনা বললেন, ‘‘পাঁচ দিনে ৮২টি ন্যাপি কিনতে হয়। আমি খুব খুশি।’’
(ছবি: সংগৃহীত)