বিহারের এই প্রত্যন্ত এলাকায় সমাজের প্রান্তবাসী মুশহর সম্প্রদায়ের মহিলারা নারী দিবসের নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
বাড়িটার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সেটি এই এলাকার একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্থানীয় মানুষের একান্ত গর্বের ‘গরমিন্ট অস্পতাল’। জরাজীর্ণ সেই সবেধন নীলমণি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের হাতায় সকাল থেকে একমুখ চওড়া হাসি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন শশীজি। মাথার উপর চড়চড়ে রোদ, আর হাসপাতাল-চত্বরে রোগীর আত্মীয়স্বজনের শশব্যস্ত আনাগোনার মধ্যেও যুদ্ধজয়ের উত্তেজনা ঠিকরে বেরোচ্ছে মাঝবয়েসি মহিলার চোখেমুখে। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা জটলার উদ্দেশে হাত-পা নেড়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন। হাসপাতালের চৌহদ্দির মধ্যে লোকজনের হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ, দেশের অধিকাংশ এলাকার মতোই, বিহারের নেপাল-সীমান্তঘেঁষা পূর্ব চম্পারণ জেলার মধুবনীঘাট গ্রাম পঞ্চায়েতের এই তল্লাটেও অবধারিত একটাই। পরিবারে নিশ্চিত আবির্ভাব ঘটেছে পুত্রসন্তানের। কিন্তু একটু কাছাকাছি গিয়ে কান পাতলে বোঝা যায়, বিষয়টা আদৌ তা নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে অত্যন্ত সাধারণ। মুশহরটোলার পাঁচ প্রসূতির সন্তান জন্মেছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
কিন্তু ১২২ কোটির দেশে পাঁচটি শিশুর জন্মের ঘটনার মধ্যে নতুনত্বই বা কী? ‘খবর’টাই বা কোথায়? প্রশ্ন শুনে মুখের হাসি চওড়া হয় শশীজির। যেন প্রাইমারি ক্লাসের ছাত্রকে বোঝাচ্ছেন, এমন মুখ করে বলেন, “আপনারা শহরের লোক তো, বুঝবেন না ব্যাপারটা। একেবারে নিঃশব্দে একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছি আমরা। এখানকার মুশহরটোলার সন্তানসম্ভবা মায়েদের আমরা সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে এসে প্রসব করাতে পেরেছি। স্মরণাতীতকালের মধ্যে আমাদের এলাকায় এই প্রথম। আন্তর্জাতিক নারীদিবসে মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে যে এত কথা হয়— বিহারের এই প্রত্যন্ত এলাকায় সমাজের প্রান্তবাসী মুশহর সম্প্রদায়ের পাঁচ জন মহিলা যে ঝুপড়ির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সন্তান প্রসবের শতাব্দীপ্রাচীন প্রথার উল্টোদিকে হেঁটে নিজের ও নবজাতকের সুস্থতার কথা ভেবে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবকালীন পরিষেবা নিতে এসেছেন, আমাদের কাছে এটাই নারীদিবসের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞান— ওঁদের ক্ষমতায়নের সবচেয়ে ঝলমলে বিজ্ঞাপন।”
আরও পড়ুন: নারী: রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে প্যাঁচ কষে গেছে জীবন
প্রশ্নকর্তার বিমূঢ় দশা তবুও কাটছে না দেখে পুরো প্রেক্ষাপটটা বোঝাতে শুরু করেন শশীজি। সরকারি তফসিল-মোতাবেক মুশহররা মহাদলিত শ্রেণির মানুষ, কার্যত পিছড়েবর্গের পিছড়েবর্গ। উত্তর-বিহার ও প্রতিবেশী ঝাড়খণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়েছিটিয়ে এঁদের বসবাস। মানবসম্পদ উন্নয়ন ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের দস্তাবেজে এঁদের জন্য বেশ কিছু বিশেষ পরিষেবা ও সুযোগসুবিধের উল্লেখ থাকলেও সমাজের মূলস্রোত থেকে এঁরা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, এতটাই যে, এমনকী দলিতদের মধ্যেও এঁদের জল অচল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রামের বাইরে ঝুপড়ি গড়ে থাকেন। গ্রামবাসীরা এঁদের ছায়াও মাড়ান না। দারিদ্রের সীমা-পরিসীমা নেই। সমাজ জীবন ও উৎপাদনপ্রক্রিয়া থেকে এঁরা ঐতিহাসিক ভাবে কতটা বিচ্ছিন্ন, তা বুঝতে মুশহর শব্দটাই যথেষ্ট। শব্দটা এসেছে মুষ (ইঁদুর) থেকে— সোজা বাংলায় কথাটার মানে, যাঁরা মেঠো ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান চুরি করে খান। চাষবাসের সঙ্গে কস্মিনকালেও কোনও সম্পর্ক নেই, নিজেদের জমি থাকার তো প্রশ্নই নেই। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবিকার কোনও স্থায়ী সংস্থান নেই। নেই বলতে, কিছুই নেই। ৯০ শতাংশ পুরুষ ইটভাটায় বা অন্যত্র জনমজুরি খাটতে গ্রামের বাইরে। বিহারের কুখ্যাত বন্যার কবলে পড়ে মাথার উপরের ঝুপড়িটুকুও হারিয়েছেন অর্ধেকের বেশি অধিবাসী। ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো তো অনেক দূরের ব্যাপার। চিকিৎসা বলতে শিকড়বাকড়-জড়িবুটি, শিশুদের টীকাকরণকে সন্দেহের চোখে দেখা সাধারণ দস্তুর, যার অবশ্যম্ভাবী ফল ব্যাপক অপুষ্টি ও শিশুমৃত্যু। সমাজজীবনের সঙ্গে এই যেখানে সম্পর্ক, সেখানে মায়েদের কাছে সন্তানধারণকালীন বিশেষ সুযোগসুবিধের কতটা পৌঁছে দেওয়া গেল, বা তার কতটার যথাযথ সদ্ব্যবহার হল, সে প্রশ্ন তোলাই কার্যত অবান্তর। “এ-কথা সত্যি যে, পরিস্থিতি আগের তুলনায় পাল্টেছে, খুব ধীরে হলেও তাঁদের সমাজ জীবনের অংশীদার করে তোলার পথে কয়েক পা এগনো গিয়েছে। বিপিএল কার্ড হয়েছে, মুশহরদের একটা অংশ গণবণ্টন ব্যবস্থার সুফল পাচ্ছেন। কিন্তু তাঁদের সামগ্রিক ভাবে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এখনও অনেকটাই পথ হাঁটা বাকি। সেই বড় যুদ্ধটারই ছোট্ট একটা জয় আজকের ঘটনাটা, যা দেখতে ছোট হলেও তাৎপর্যের দিক থেকে পাহাড় ডিঙনোর সমান,”—বলতে থাকেন শশীজি। “সেই মুশহর সম্প্রদায়ের মহিলাদের যে অবশেষে মাতৃত্বকালীন পরিষেবার আওতায় আনা গিয়েছে, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবে রাজি করানো গিয়েছে, আমাদের কাছে এ এক মস্ত বড় ঘটনা। এ যে কত দিনের নিরলস চেষ্টার ফসল, তা শহরের মানুষের পক্ষে একনজরে বোঝা সম্ভব?”—পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে চওড়া হাসি হাসেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা সার্বিক গ্রামীণ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সমিতির কর্মাধ্যক্ষ শশীপ্রসাদ।
আরও পড়ুন: আমার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছাত্রীরা
শুনতে শুনতে ধন্দ লেগে যায়। সত্যিই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা? রাজ্যের রাজধানী পটনা থেকে মাত্রই কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে? মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের সময়সীমা পার হয়ে সাসটেনেব্ল ডেভেলপমেন্ট গোলের দিকে চলেছি? দেশের অর্থনীতি এগোচ্ছে— জাতীয় উৎপাদনের গড় ঊর্ধ্বগামী। উন্নয়নের কার্যক্রমে সমাজের একেবারে নীচের তলার শেষতম মানুষটিকেও সামিল করার পরিকল্পনা হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে নারীদের ক্ষমতায়নে। তারই প্রত্যক্ষ ফল দেখা যাচ্ছে মা ও শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসূচকে। অথচ একইসঙ্গে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ২০১৬ সালের রিপোর্ট এ-ও জানাচ্ছে, বিহারের গ্রামীণ এলাকায় মহিলাদের সাক্ষরতার হার আগের তুলনায় বাড়লেও এখনও ৫০ শতাংশের নীচে। সাবালিকা হয়ে ওঠার আগেই সন্তানধারণ, মহিলাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, গর্ভাবস্থাকালীন ও প্রসবোত্তর স্বাস্থ্য পরিষেবা গ্রহণ, পুষ্টির নিরিখে মায়েদের অবস্থা, নবজাতকদের স্তন্যদান, শিশু-অপুষ্টি, অপুষ্টিজনিত কারণে শিশুমৃত্যুর হার, পারিবারিক ব্যয়-নির্ধারণের ক্ষেত্রে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রভৃতি বেশ কয়েকটি সূচকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। একাধিক সূচকে রাজ্য এখনও জাতীয় গড়ের অনেকটাই পিছনে। তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত মহিলাদের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যে আরও অনেকটাই খারাপ তা বুঝতে এমনকী পরিসংখ্যানেরও দ্বারস্থ হতে হয় না। এই গোটা পরিপ্রেক্ষিৎটা মনে রাখলে এবং সমাজের একেবারে প্রান্তবাসী মুশহরদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রসরতার মলিন প্রেক্ষাপট মাথায় থাকলে বোঝা যায়, সত্যিই কী অসাধ্যসাধন করে ফেলেছেন ওঁরা।
“সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে মুশহররা প্রায় অদৃশ্য একটি জনগোষ্ঠীর ধূসর বাসিন্দা হিসেবে চিহ্নিত হতেন, তাঁদের ঘরের মহিলাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্র অবধি নিয়ে আসতে পারা কোনও সামাজিক বিপ্লবের চেয়ে তাই কোনও অংশে কম তাৎপর্যপূর্ণ নয়,”—একনাগাড়ে অনেক ক্ষণ কথা বলে চলার পর, একটু থেমে, ফের বিজয়ীর হাসি হাসেন শশীজি।
পূর্ব চম্পারণের পাণ্ডববর্জিত সীমানায় আন্তর্জাতিক নারীদিবস উদ্যাপনের ঝকঝকে হাসি।