ঘেরাও বনকর্মীরা।
বেলা গড়িয়েছে বেশ। রাস্তাঘাট, ইতস্তত দোকানপাট, ঘর-বাড়ির স্তব্ধ চেহারা দেখলে তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। অনেকটা অকাল দুপুরের মতো নিঝুম।
গলির মোড়ে, কদাচিৎ দলবদ্ধ গ্রামবাসী। হাতে খেটো বাঁশ। না হয় পুরুষ্ঠ ভাঙা ডাল। গ্রাম প্রহরার এই অচেনা চেহারায় গোপালনগরের ব্যারাকপুর কিংবা কানাপুকুরকে দেখে মনে হচ্ছে, আচম্বিত বর্গি হানা ঠেকাতে নিশ্চুপ প্রস্তুতি নিয়ে আছে গ্রামবাসীরা।
কি ব্যাপার?
ফিসফিস করে উত্তর আসছে‘‘একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।’’ কেন?
“হনুমান, দেখলেই তেড়ে আসছে। কামড়েও দিচ্ছে।”
সমস্বরে নিজেদের অভিজ্ঞতা সাজিয়েও দিচ্ছেন ওঁরা। কারও আঁচড়, কারও বা কামড়ের চিহ্নও তুলেও ধরছেন।
সেই হনুমান।
আর ওই দুই গ্রামের আম-জীবনের ছন্দটাই যে ছিঁড়ে গিয়েছে সেই কামড়ে, আপ্রাণ বোজানোর চেষ্টা করছেন তা-ও।
অথচ, বনগাঁর অদূরে ওই সড়কের দু-ধারের গ্রামগুলিতে হনুমানের আনাগোনা তো নতুন কোনও ঘটনা নয়। এ যাবৎ এমনই জেনে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরাই জানাচ্ছেন, এত দিন ওরা আসত বাগানের ফল-মূল খেয়ে ঈষৎ লাফঝাঁপের ‘স্বাভাবিক’ অত্যাচার শেষে ফিরেও যেত আশপাশের গাছগাছালি, বাঁশবাগানে। বিপত্তিটার শুরু সপ্তাহ কয়েক আগে।
বড়সড় একটি পুরুষ হনুমান। মাথার এক পাশে তার পুরনো কাটা দাগ। কোনও কারণে সেটিই আপাতত দুই গ্রামের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মরিয়া হয়ে গ্রামের ওই যুবকেরা বলছেন, “কেউ হনুমানটা ধরে দিতে পারলে আমরা সবাই মিলেই না হয় চাঁদা তুলে তাঁকে ১০০১ টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করব।” মরিয়া হয়ে তাঁরা গ্রামের গাছের গুঁড়ি কিংবা লাইট পোস্টে সে পোস্টার সাঁটিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু সেই উন্মত্ত হনুমানকে ধরে এমন সাহস দেখানোর বান্দা দু-গ্রামে নেই। কেন বন দফতর?
অভিযোগ দায়ের করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দেরিতে হলেও জনা কয়েক কর্মী দড়ি-দড়া, খাঁচা নিয়ে এসেও ছিলেন। কিন্তু সে ফাঁদে পা দেওয়ার মতো মুর্খামি করেনি সেই পবনপুত্র।
রেগেমেগে গ্রামবাসীরা সেই সময়ে আটকে রেখেছিলেন বনকর্মীদেরই। স্থানীয় রেঞ্জ অফিসার পরিমলকান্তি সরকার বলছেন, “ভারী সমস্যা, কী করি বলুন তো! দিন কয়েক আগে ঘুম পাড়ানি গুলিতে একটা হনুমানকে কাবু করা গেল ঠিকই কিন্তু গ্রামবাসীদের দাবি এটা ওই কানাপুকুরের ত্রাস নয়।” তাঁরা খাঁচাও পেতেছেন বার কয়েক। তাতে কলাটা, মুলোটার পাশাপাশি রুটি-পাঁউরুটিও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সে পথে পা বাড়ানোর চেষ্টাই করেনি অতিকায় পোড়ামুখোটা।
রাস্তা অবরোধ ক্ষুব্ধ জনতার।
লাঠি হাতে পাহারা গ্রামে।
গ্রামবাসীদের তাই আর বনকর্মীদের উপরে তেমন ভরসা নেই।
গ্রামের একটা বেসরকারি স্কুলেও নাকি দিন কয়েক টানা তালা ঝুলেছিল। ‘অপু দুর্গা শিশু শিক্ষা নিকেতন’-এর প্রধান শিক্ষক নিশীথ মণ্ডল বলছেন, “কে ঝুঁকি নেবে মশাই। বাচ্চাকাচ্চাদের কেউ পাঠাতেই চাইছিল না ক’দিন। আমরাও আর জোর করিনি।” এখনও সে স্কুলের ক্লাস হচ্ছে দরজা ভেজিয়ে রেখেই। পালা করে পাহারা দিচ্ছেন শিক্ষকেরাই।
গ্রামের দোকানপত্র আধ-খোলা। বিভূতিভূষণ স্মৃতি ঘাটের কাছে দোকান পলাশ দত্তের। আতঙ্কিত পলাশবাবু কিছুটা পেটের দায়েই দোকান খুলেছেন। বলছেন, “কী করব পেট তো চালাতে হবে। জানেন, দোকানের বাইরে চা করছিলাম। হনুমানটি দোকানের মধ্যে এসে বিস্কুটের বয়ামটা নিয়ে হেলেদুলে চলে গেল। তোলাবাজি ছাড়া একে কী বলব বলুন!” অন্য এক দোকানি পিঙ্কি কররায়চৌধুরী বলেন, “আমার দোকান থেকে তো বয়াম তুলে রাস্তায় আছাড় মেরে ভাঙল ওই হনুমনাটা। কী করব, দেখতে হল!” অসহায় শোনায় তাঁর গলা। এমনকী, রাস্তার কল থেকে পাড়ার মহিলারা জল আনতেও এখন ভয় পাচ্ছেন। সেখানেও তাণ্ডব চালাতে পারে সে এমনই আশঙ্কা।
আশঙ্কাটা অবশ্য অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই ওই হনুমানের কামড়ে জখম হয়েছেন বহু মানুষ। স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলেই চিকিৎসকেরাও চেনা গলায় বলছেন, ‘কী হনুমান কামড়েছে নাকি!’ কিন্তু আর কত দিন? কানাপুকুরের ওই যুবককুল স্বগতোক্তির মতো প্রশ্ন করছেন।
ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।