জঞ্জাল ফেলবার জায়গায় স্তুপাকারে বা চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকা প্লাস্টিক যেন জমাট বাঁধা পেট্রল ডিজ়েল। এমন কথা কেন? আসলে আমরা প্লাস্টিক যা কিছু ব্যবহার করি, তার প্রায় সবটাই অপরিশোধিত খনিজ তেল বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়। তা থেকে আবার জ্বালানি তেল তৈরি করা যায়। তাই এমন কথা। সারা পৃথিবীর বার্ষিক তেল উৎপাদনের প্রায় আট শতাংশ এ জন্য ব্যবহৃত হয়— চার শতাংশ প্লাস্টিক পণ্যটির জন্য এবং বাকি চার শতাংশ তা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি হিসেবে। এ ভাবে হাজার হাজার ব্যারেল পেট্রল ডিজ়েল যেন ছড়ানো রয়েছে স্রেফ প্লাস্টিক আবর্জনা হিসাবে।
প্লাস্টিক আবর্জনা আমাদের কাছে সম্পদ হয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা উপযুক্ত প্রযুক্তির সাহায্য নিই। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক থেকে পাইরোলিসিস ও গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে ডিজ়েল, পেট্রল ইত্যাদি জ্বালানি তেল তৈরি করা যায়। প্লাস্টিক থেকে তৈরি জ্বালানি তেলে সালফার থাকে না বললেই চলে। তাই এই জ্বালানি তেল পেট্রল পাম্পের সাধারণ জ্বালানি তেলের চেয়ে উন্নত। গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি বেশ জটিল ও বৃহদাকার। যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতেও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। পাইরোলিসিস প্রক্রিয়া সেই তুলনায় সস্তা। প্রয়োজনভিত্তিক ছোট ছোট ইউনিট বসিয়ে উৎপাদন শুরু করা যায়।
পাইরোলিসিস পদ্ধতিতে নানা ধরনের পলিমার যথা, হাই-ডেনসিটি পলিইথিলিন, লো-ডেনসিটি পলিইথিলিন, পলিপ্রপিলিন, পলিস্টিরিন পলিমার দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র এক সঙ্গে মেশানো অবস্থাতেই জ্বালানি তেল উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়। তবে পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি) বা পলিইথিলিন টেরেপথালেট (পিইটি) পলিমারের তৈরি জিনিসপত্র এই উদ্দেশ্যে ব্যবহারের কিছু অসুবিধে রয়েছে। পিইটি পলিমার যেমন, জলের বোতল ইত্যাদি এমনিতেই প্রায় সত্তর শতাংশ পুনর্চক্রীকরণ হয়, পরিবেশে প্রায় পড়ে থাকে না। পিভিসি-এর ক্ষেত্রেও পুনর্চক্রীকরণ হার যথেষ্ট ভাল।
পাইরোলিসিস পদ্ধতিতে প্রায় অক্সিজেনবিহীন আবদ্ধ পাত্রে প্লাস্টিক ভরে এমন ভাবে উত্তপ্ত করা হয় যে, ভিতরের প্লাস্টিক গলে গিয়ে সরাসরি গ্যাসীয় পদার্থে পরিণত হয়। কিন্তু কখনওই দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে না। এই গ্যাসীয় পদার্থকে ঘনীভূত করলে তা থেকে পাওয়া যায় ডিজেল, পেট্রোলের মতো জ্বালানি; একেবারে তলায় যে অবশেষ থেকে যায়, তা রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। উপযুক্ত অনুঘটক ব্যবহার করলে অনেক কম তাপমাত্রায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে এই প্রক্রিয়াটি ঘটে। আমেরিকা, জাপান, জার্মানি, ব্রিটেন সহ বহু দেশ ইতিমধ্যেই পাইরোলিসিস পদ্ধতিতে প্লাস্টিক থেকে পেট্রল ও ডিজ়েলের মতো জ্বালানি তেল উৎপাদন করছে। ভারতে মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাড়ু, গুজরাত, অন্ধ্রপ্রদেশ ও গোয়া-তে প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের ইউনিট বসেছে। মহারাষ্ট্রের পুণেতে এই ধরনের ইউনিট রুদ্র এনভায়রনমেন্টাল সলিউশনস উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
ভারতে বিষয়টি নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে দীর্ঘ পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। অবশেষে গ্যাস অথরিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর সাহায্যে গত বছরের অগস্ট মাসে ভারতের দেহরাদুনে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পেট্রোলিয়াম এক পাইলট প্লান্ট চালু করেছে। এটি ১০০০ কিলোগ্রাম পলিইথিলিন এবং পলিপ্রপিলিন প্লাস্টিক আবর্জনা থেকে ৮০০ লিটার ডিজেল উৎপাদন করতে পারে। আবর্জনার মধ্যে পলিইথিলিন ও পলিপ্রপিলিন পলিমারের জিনিসপত্র থাকে প্রায় ৭০ শতাংশ। যেমন, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ, খাবারদাবারের মোড়ক, দুধের প্যাকেট, দইয়ের কাপ, জামাকাপড়ের প্যাকেট, গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র ইত্যাদি। এগুলি থেকে ডিজ়েল ছাড়াও পেট্রল বা সুগন্ধিও উৎপাদন সম্ভব। ছয়-আট মাস পর্যবেক্ষণের পর, তাঁদের এই পদ্ধতিটির ক্ষমতা প্রতি দিন ১০,০০০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল উৎপাদনের উপযোগী করে, সারা দেশে ব্যবহারের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের লাইসেন্স দেওয়া হবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পেট্রোলিয়াম-এর ডিরেক্টর অঞ্জন রায়ের মতে, জ্বালানি তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের উদ্যোগ তেল সরবরাহ বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশকেও রক্ষা করবে। ব্যবস্থাটি পুরোদমে শুরু হলে নতুন কর্মসংস্থানও হবে। ভারতে প্লাস্টিক আবর্জনা সমস্যা সমাধানে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
ফেলে দেওয়া পলিইথিলিন, পলিপ্রপিলিন ও পলিস্টিরিন প্লাস্টিকের জিনিসপত্র দিয়ে পাকা রাস্তার একেবারে উপরের স্তর তৈরি করার এক প্রযুক্তি ভারতের কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ উদ্ভাবন করেছে। এ ভাবে তৈরি রাস্তার গুণগত মান বিটুমেন দিয়ে তৈরি রাস্তার মানের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়, বরং রাস্তা দীর্ঘস্থায়ী হয়। খরচও কম পড়ে। কলকাতার নিউটাউনেও এ ভাবে কিছু রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্স প্রকাশিত এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, যদি ১৭০টি সিমেন্ট কারখানায় তাপ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত জ্বালানির মাত্র ১০ শতাংশের পরিবর্তে প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়, তা হলে দেশের সমস্ত প্লাস্টিক আবর্জনা সিমেন্ট কারখানাতেই কাজে লেগে যাবে।
ফেলে দেওয়া পাতলা প্লাস্টিকের ব্যাগ, খাবারদাবারের মোড়ক ইত্যাদি আবর্জনা সত্যিই এক বড় সমস্যা। কাগজ-কুড়ানিরা এগুলি কুড়িয়ে সংগ্রহ করে না; কারণ ওজনে অত্যন্ত হালকা বলে, এগুলি বিক্রি করে সামান্যই আয় হয়। ফলে এগুলি চারপাশে জমছে। সমস্যাটা যেহেতু বিরাট, প্রতি বছর নালা-নর্দমা প্লাস্টিক আবর্জনামুক্ত করতে যথেষ্ট অর্থব্যয় করতেই হয়, তাই এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত মূল্য দিয়ে এগুলি সংগ্রহ করে নেওয়া প্রয়োজন। তা হলেই চারপাশে এত বেশি প্লাস্টিক জমে থাকা বন্ধ হবে। তেলেঙ্গনাতে ফেলে দেওয়া এক কিলোগ্রাম প্লাস্টিকের বদলে এক কিলোগ্রাম চাল কর্মসূচিতে এ জন্যই ভাল সাড়া মিলেছে।
২০১৬-এর মার্চে জাপানের কিয়োতো ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি এবং কেইয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল বিজ্ঞানী একটি পরিত্যক্ত কারখানা থেকে ইডিওনেল্লা সাকাইয়েনসিস নামে এক ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেছেন, যা তার দুটি পৃথক উৎসেচকের সাহায্যে মাত্র ছয় সপ্তাহের মধ্যে পিইটি পলিমার থেকে টেরেপথ্যালিক অ্যাসিড ও ইথিলিন গ্লাইকল উৎপন্ন করতে পারে। এই দুই রাসায়নিক থেকেই আবার পিইটি পলিমার তৈরি করা যায়।
এ কথা বলাই যায় যে, প্লাস্টিক দূষণ বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির একটি। তবে বিজ্ঞানীরাও ছাড়বার পাত্র নন। তাঁরাও বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই দূষণ কমানের চেষ্টা করছেন। এক সময় প্লাস্টিক ছিল বিজ্ঞানের অন্যতম বড় দান। প্লাস্টিকের মাহাত্ম্যে মানুষ ছিল মুগ্ধ। বর্তমানে সেই বিজ্ঞানই কাজে লাগছে প্লাস্টিকরূপী দৈত্যকে ধ্বংস করতে।