ভূকম্প-প্রবণ উত্তরাখণ্ড

ভূস্তরের হালচাল বুঝতে মাটির তলায় সেন্সর

রাজধানী-সহ গোটা উত্তর ভারত সোমবার রাতে যে ভাবে কেঁপে উঠেছিল, তাতে আতঙ্কে রাস্তায় নেমে এসেছিল রাজধানী।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০২:১৫
Share:

রাজধানী-সহ গোটা উত্তর ভারত সোমবার রাতে যে ভাবে কেঁপে উঠেছিল, তাতে আতঙ্কে রাস্তায় নেমে এসেছিল রাজধানী। তবে ভূকম্প বিশেষজ্ঞেরা এই কম্পনে মোটেই বিচলিত নন। তাঁদের পূর্বাভাস, উত্তর-পশ্চিম হিমালয়ে অদূর ভবিষ্যতে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।

Advertisement

কেন?

তাঁদের মতে, গোটা উত্তর-পশ্চিম ভারত দাঁড়িয়ে রয়েছে এমন একটি ‘কম্পন অধ্যুষিত’ অঞ্চলে যাকে ভূকম্প বিশেষজ্ঞেরা ‘হটস্পট’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ কি না এই অঞ্চলে প্রতিনিয়তই রিখটার স্কেলে ৪, সাড়ে ৪, ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েই থাকে। আইআইটি খড়্গপুরের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ শঙ্কর কুমার নাথের বিশ্লেষণ, গোটা হিমালয় অঞ্চলই ভূমিকম্পপ্রবণ। তার মধ্যে উত্তর-পশ্চিম হিমালয় তুলনামূলক ভাবে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ। ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প সব সময় হয়েই চলেছে। সোমবার রাতে বড় শহরগুলিতে তা অনুভব করা গিয়েছে বলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

Advertisement

শঙ্করবাবুর বক্তব্য, ‘‘এই এলাকায় বহু বছর আগে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিল। কিন্তু ওই এলাকার ভূস্তর যে ভাবে অস্থির হয়ে রয়েছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে আরও একটি ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে।’’

আরও পড়ুন: সদ্যোজাতদের জন্ডিস রোখার পথ দেখিয়ে চমক ভারতীয়ের

আইআইটি খড়্গপুরের জিওফিজিক্স বিভাগের রেকর্ড বলছে, হিমালয়ের কাশ্মীর অঞ্চলের কাংড়ায় ১৯০৫ সালে ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছিল। ১৯৯১ সালে উত্তরকাশীতে রেকর্ড করা হয়েছে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প। ২০০৫ সালে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সেগুলিতে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও ছিল খুব বেশি। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, যে ভাবে মানুষ বিভিন্ন ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করছে, তাতে ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পই ব্যাপক জীবন ও সম্পত্তিহানি ঘটাতে পারে।

জঙ্গল কেটে যথেচ্ছ নগরায়ণের ফলে পাহাড়ে কী ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে, তা বুঝিয়ে দিয়েছে ২০১৩ সালের প্রকৃতির তাণ্ডব। তাতে কার্যত মুছে গিয়েছে উত্তরখণ্ডের বিস্তীর্ণ এলাকা। তীব্র জলস্রোতে মন্দিরের পিছনে এসে থমকে যাওয়া বড় পাথরের কল্যাণে সে যাত্রা কেদারনাথ মন্দির রক্ষা পেলেও, মারা যায় এক হাজারেরও বেশি মানুষ।

মৌসম ভবনের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, বছর দুয়েক ধরে নেপালে পরপর যে সব ভূমিকম্প হয়েছে, তাতে গোটা হিমালয়ের ভূস্তর আরও অস্থির হয়ে গিয়েছে। এর ফলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের পরেও শক্তিশালী ভূমিকম্পোত্তর কম্পন (আফটার শক) অনুভূত হচ্ছে। গত কালের উত্তরাখণ্ডের পিথোরাগড়ের কাছে হওয়া ভূমিকম্পের পরে ৩.৭ এবং ৩.১ মাত্রার দু’টি ভূমিকম্পোত্তর কম্পন অনুভূত হয়েছে, যা আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে।

মার্কিন ভূতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (ইউএসজিএস), জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া এবং খড়্গপুর আইআইটি-র ভূবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, হিমালয় অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের মধ্যে রেষারেষির জেরেই এই এলাকাটি অতি মাত্রায় ভূমিকম্পপ্রবণ হয়ে উঠেছে। এই রেষারেষির সময়ে ইন্ডিয়ান প্লেটটি যখনই ইউরেশীয় প্লেটের নীচে ঢুকে যাচ্ছে, তখন মাটির নীচে বিশাল পরিমাণ শক্তি মুক্ত হচ্ছে। আর সেই নির্গত শক্তির পরিমাপ কতটা, তার উপরে নির্ভর করছে ভূমিকম্পের মাত্রা।

দু’বছর আগে নেপাল ভূমিকম্পের পরেই উত্তরাখণ্ডের মাটির তলায় কী হালচাল হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে উদ্যোগী হয় কেন্দ্রীয় আর্থ সায়েন্স মন্ত্রক। মন্ত্রকের দেওয়া রিপোর্টের ভিত্তিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বন-পরিবেশ সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি জানায়, গোটা হিমালয়েই ভূগর্ভস্থ মাটির স্তর ইদানীং খুবই অস্থির অবস্থায় রয়েছে।

জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (জিএসআই)-এর সমীক্ষা অনুযায়ী চামোলি ও বাগেশ্বর-সহ উত্তরাখণ্ডের রাজ্যের ১৩টি জেলাকে অতিরিক্ত সংবেদনশীল বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেহরাদুন, চম্পাওট, নৈনিতাল, উধমসিংহ নগর, হরিদ্বারের মতো জেলাগুলি ১০০ শতাংশ সংবেদনশীল এলাকার আওতায় রয়েছে। রুদ্রপ্রয়াগ বা পিথোরাগড়ের মতো জেলাগুলি রয়েছে যথাক্রমে ৯৮.৩ ও ৯৪.৯ শতাংশ সংবেদনশীল এলাকাল আওতায়।

আরও পড়ুন: কৃত্রিম কিডনি বানিয়ে চমক বাঙালির, বাজারে আসতে চলেছে খুব তাড়াতাড়ি

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, এই এলাকায় রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প এলে উৎসস্থলের ১০০ কিলোমিটার বৃত্তে তুমুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। এর জন্য পরিকল্পনাবিহীন নগরায়ণকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত চার দশকে দেহরাদুনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৩০ গুণ। যার চাপ সামলাতে দেহরাদুন ও সংলগ্ন এলাকায় যথেচ্ছ ভাবে জঙ্গল কাটা চালু রয়েছে। পরিকল্পনা ছাড়াই তৈরি হয়েছে অজস্র বহুতল আবাসন।

ভূস্তরে হালচাল বোঝার জন্য মাটির বিভিন্ন স্তরে প্রায় ১০০টি সেন্সর লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে গোটা উত্তরাখণ্ড জুড়ে। যেগুলি থেকে পাঠানো তথ্য সরাসরি পৌঁছে যাবে আইআইটি রুরকি-র তথ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, এই সেন্সরগুলি কাজ করা শুরু করলে, উত্তরাখণ্ডে কোনও ভূমিকম্প ঘটলে তার প্রভাব দিল্লিতে পৌঁছানোর এক থেকে দেড় মিনিট আগে সতর্ক করে দেওয়া যাবে রাজধানী-সহ গোটা উত্তর ভারতের মানুষকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement