Science News

আর ‘বোকা’ বনতে হবে না আবহবিদদের? অঙ্কে ইঙ্গিত অগ্নিজের

এ বছর আন্তর্জাতিক অঙ্ক অলিম্পিয়াড (আইএমও)-এ অগ্নিজ বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে তাক লাগিয়েছে ১৭ বছর বয়সেই। হয়েছে প্রথম। পেয়েছে স্বর্ণপদক। গণিত নিয়ে উদ্ভাবনী কথা বলার জন্য অগ্নিজের লেখা প্রথম বইটিও সাড়া ফেলেছে। লিখছেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহ-উপাচার্য, ও ফলিত গণিতের 'স্যর রাসবিহারী ঘোষ' অধ্যাপক (প্রাক্তন) দিলীপ সিংহ।যাঁরা হাসাহাসি করতেন, তাঁদের অনেকেই জানতেন না, নিখুঁত পূর্বাভাসের জন্য যে সব সর্বাধুনিক যন্ত্র থাকা প্রয়োজন, ওই সময় আলিপুরের আবহাওয়া অফিস তো দূরের কথা, দিল্লিতে মৌসম ভবনেও ছিল কি না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:৪০
Share:

অগ্নিজ বন্দ্যোপাধ্যায়।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে এক সময় খুব হাসাহাসি হত। বলা হত, আলিপুরের আবহাওয়া দফতর যদি বলে বৃষ্টি হবে, তা হলে পরের দিনটা হয় শুকনো খটখটে! যদি বলে, কালকের তাপমাত্রা বাড়বে, আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটাও থাকবে না, তা হলে পরের দিনটা ধুয়ে যাবে বৃষ্টিতে। কোথাও কোথাও রাস্তাঘাট ডুবে যাবে হাঁটু-সমান জলে! এটা অবশ্য তিন-চার দশক আগেকার কথা। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি।

Advertisement

যাঁরা হাসাহাসি করতেন, তাঁদের অনেকেই জানতেন না, নিখুঁত পূর্বাভাসের জন্য যে সব সর্বাধুনিক যন্ত্র থাকা প্রয়োজন, ওই সময় আলিপুরের আবহাওয়া অফিস তো দূরের কথা, দিল্লিতে মৌসম ভবনেও ছিল কি না, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

ওই সময় যাঁরা হাসাহাসি করতেন, তাঁরা আজ আরও বেশি লজ্জায় পড়ে যেতে পারেন! গণিতের খুব বড় একটা 'জাদুর খেলা' তাঁরা জানতেন না বলে।

Advertisement

সেই জাদুর খেলাটা যে কথার কথা নয়, বরং অঙ্কের জোরালো সমর্থন রয়েছে তার পিছনে, গণিতের অনেক গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে সেটাই বলেছে অগ্নিজ বন্দ্যোপাধ্যায়। যে এ বছর আন্তর্জাতিক অঙ্ক অলিম্পিয়াড (আইএমও)-এ সবাইকে তাক লাগিয়েছে ১৭ বছর বয়সেই। হয়েছে প্রথম। পেয়েছে স্বর্ণপদক। করেছে 'পারফেক্ট স্কোর'। সাড়ে ৪ ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় (কার্যত, পরীক্ষা) মোট ৪২ নম্বরের মধ্যে ৪২ পেয়েছে অগ্নিজ। তার আধ নম্বরও কাটা সম্ভব হয়নি পরীক্ষকদের!

হাই স্কুল স্তরে ১০৪টি দেশের ৫৯৪টি গণিত-প্রতিভাকে নিয়ে এ বছর ৫৯তম আন্তর্জাতিক অঙ্ক অলিম্পিয়াডের প্রতিযোগিতা হয়েছিল রোমানিয়ার ক্লু-ন্যাপোকায়। প্রায় কাছাকাছি সময়েই অগ্নিজের প্রথম বইটিও বেরিয়েছে। যার নাম- 'উইয়ার্ড ম্যাথ্স: অ্যাট দ্য এজ অফ ইনফিনিটি অ্যান্ড বিয়ন্ড'। বইটি অগ্নিজ লিখেছে তার ছোটবেলার যাবতীয় কৌতূহল মেটাতেন যিনি, সেই বিজ্ঞান-লেখক ডেভিড ডার্লিং-এর সঙ্গে। কলকাতায় জন্ম অগ্নিজের। এখন থাকে স্কটল্যান্ডে।

উইয়্যার্ড ম্যাথ (Weird Math) বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশের সময় ভাই আর ডেভিড ডার্লিংয়ের সঙ্গে অগ্নিজ। গ্লাসগোয়

আর ‘বোকা’ বনতে হবে না আবহবিদদের?

অগ্নিজ ওই 'দুষ্টু' অঙ্ক কষেই দেখেছে, আবহাওয়া, পরিবেশের যে অবস্থা বা 'শর্ত'গুলিকে ধরে আবহবিদরা পূর্বাভাস দেন, তা সামান্য বদলে গেলে, ২৪, ৪৮, ৭২ বা ৯৬ ঘণ্টা পর যা হওয়ার কথা, তা অনেক বেশি ভাবে বদলে যায়। তার মানে, আবহবিদদের একেবারে 'বোকা' বানিয়ে দেয়! অগ্নিজ তাই তার প্রাণের দোসর অঙ্ককে 'দুষ্টু' বলেছে। বহু দিন আগে গণিতবিদ লোরেঞ্জ এ কথাটা বলেছিলেন। অগ্নিজ এও বলেছে, পূর্বাভাস দেওয়ার সময় আবহাওয়ার যে 'শর্ত'গুলিকে তাঁদের হিসেবের মধ্য়ে ধরেছেন আবহবিদরা, তার সামান্য রদবদলের নিরিখে তাঁদের পূর্বাভাস আগামী দিনগুলিতে তাঁদের কতটা বেশি 'বোকা' বানাতে পারে, এ বার সেটাও আঁচ করতে পারবেন আবহবিদরা। যার অর্থ, প্রকৃতির খামখেয়ালের কাছে 'বোকা' বনে যাওয়ার জন্য এখনকার মতো অতটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়তে হবে না আবহবিদদের।

আরও পড়ুন- অঙ্কে বিশ্বজয় বঙ্গসন্তানের, নিখুঁত স্কোরে আনলেন সোনা​

আরও পড়ুন- কলকাতায় ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করে গেলেন সোনার ছেলে অগ্নিজ​

১৭ বছরের অগ্নিজ ইতিমধ্যেই টের পেয়ে গিয়েছে, যাকে মারে, তাকে বাঁচিয়েও দিতে পারে অঙ্কই! সেটাই অঙ্কের 'মাদারিকা খেল'!

বাবা শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভাই আরিয়ানের সঙ্গে অগ্নিজ (বাঁ দিকে), দুর্গাপুরে মামার বাড়িতে

‘এলোমেলো করে দে, লুটেপুটে খাই...’

গণিতের ভাষায়, এর নাম 'কেওস' (Chaos)। ওই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আমরা শুরু করতে জানি, শেষ করতে জানি না! কথাটা তিনি অবশ্য অন্য অর্থে বলেছিলেন। জীবনে আমরা সব কিছুই আমাদের ইচ্ছা মতো শুরু করতে পারি। কিন্তু কোথায় গিয়ে পৌঁছব, গন্তব্যে পৌঁছতে আমাদের কোন কোন পথ ধরে যেতে হবে, তা আগেভাগে পুরোপুরি সঠিক ভাবে আঁচ করতে পারি না। তবে গণিতের কোনও সূত্র থাকলে সেটা করতে পারি। ধরুন, আপনি ঠিক করে রাখলেন, সকাল সকাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে নৈহাটিতে আপনার আত্মীয়ের বাড়িতে পৌঁছে গিয়ে দুপুরের ভাত খাবেন। যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, তখন চারপাশ শুকনো খটখটে। বাড়ি থেকে বেরনোর মিনিট পনেরোর মধ্যে হঠাত আকাশ অন্ধকার করে এসে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি বলে বৃষ্টি! টানা ২ ঘণ্টা। চার দিকের রাস্তা জলে ডুবে গেল। ট্রেন বন্ধ হয়ে গেল বেশ কিছু ক্ষণের জন্য। এই অবস্থায় আপনার আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার প্ল্যানটাই ভেস্তে গেল। কারণ, গেলে তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে। কী ভাবে ফিরবেন? সেই চিন্তায় কী ভাবে তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরে আসা যায় সেটাই ভাবতে লাগলেন! যেন প্রকৃতি অঙ্ককে দিয়ে তার কাজটা করিয়ে নিল। বলতে চাইল, ''এলোমেলো করে দে, লুটেপুটে খাই''!

তিতলির দাপট! অন্ধ্রপ্রদেশে

আরও পড়ুন- ক্যানসার বধের নিখুঁত ‘মিসাইল’ বানিয়ে চমক বালিগঞ্জের অম্বরীশের​

আরও পড়ুন- নেট ব্যাঙ্কিং এ বার নিরাপদ হবে? দিশা দেখালেন বঙ্গতনয়া

অসীম হওয়ার ‘ইচ্ছাপূরণ’ কোনও দিনই সম্ভব নয় বৃহত্তম সংখ্যার!

অগ্নিজ তার প্রথম বইয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই জানিয়েছে, সত্যি-সত্যিই সীমানা রয়েছে সসীম সংখ্যার। তা যতই আয়তনে বাড়ুক, যতই চেহারায় বাড়-বাড়ন্ত হোক তার, যতই তার সীমানা বাড়ুক, যতই তার দিকে অসীম হয়ে ওঠার হাতছানি থাকুক, সেই সংখ্যা যতই বৃহৎ থেকে বৃহত্তর আর তা থেকে বৃহত্তম হয়ে উঠুক, দিনের শেষে তার আর অসীম হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। সে সসীমই থাকে, থাকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যেই!

সংখ্যাদের মধ্যেও ‘বৃহ্ত্তম’ হয়ে ওঠার লড়াইটা কিছু কম নয়!

তার মানে, তাকে সীমার মাঝেই 'অসীম' হওয়ার গোপন ইচ্ছেটা পুষে রাখতে হচ্ছে। আর সেই ইচ্ছাপূরণের কোনও সম্ভাবনাই নেই, কোনও কালে। অসীমতার কোনও নিজস্বতা নেই। কিন্তু বৃহত্বের নিজস্বতা আছে। স্বাতন্ত্র আছে। আমি যে ভাবে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি, আপনি সেই ভাবে আপনাকে নিয়ে সেই স্বপ্নটা দেখেন না। আপনার বৃহত্ব নিয়ে আমার ধারণাটা যা, আমার বৃহত্ব নিয়ে আপনার ধারণাটা তার থেকে একেবারেই আলাদা। আমার বৃহত্বে আমি মহান! আপনার বৃহত্বে মহান আপনি! অগ্নিজ বলতে চেয়েছে, বৃহত্তম সংখ্যা, তা যতই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যাক না কেন, তার একটি অনতিক্রম্যতা রয়েছে। বড় হতে হতে, বড় হতে হতে, সে শুধুই বিশাল থেকে সুবিশাল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু নিজেকে অতিক্রম করে সে কখনই অসীম হয়ে উঠতে পারে না।

১৭ বছর বয়সের ছেলে অগ্নিজের কাছ থেকে আমাদের এটা খুব বড় প্রাপ্তি। অগ্নিজ চমকে দিয়েছে, হ্যাঁ, দর্শনেও।

কক্ষপথে গ্রহ, উপগ্রহ ঘোরে গানের ছন্দে, তালে তালে

ডেভিড ডার্লিং-কে সঙ্গে নিয়ে লেখা বইয়ে অগ্নিজ পিথাগোরাসের বলে যাওয়া কথাগুলিকে খুব সহজে বর্ণনা করে বুঝিয়ে দিয়েছে, গ্রিক গণিতজ্ঞের সঙ্গে এ ব্যাপারে অন্তত তার তেমন মতবিরোধ নেই। পিথাগোরাস বলেছিলেন, এই সৌরমণ্ডলের সব কিছুর মধ্যেই গানের ছন্দ্, সুর, তাল ও লয় মিশে রয়েছে। সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে গ্রহ। গ্রহগুলিকে প্রদক্ষিণ করছে উপগ্রহগুলি। সুর্য নিজের চার দিকে ঘুরছে। গ্রহগুলিও নিজেদের কক্ষপথে লাট্টুর মতো ঘুরছে। এই সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে গানের সুর। সেই গান খুব সুরেলাও বটে! তার মনমাতানো সুর, তাল, লয় রয়েছে। আর সেগুলিকে সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়। ডার্লিং ও অগ্নিজের মনে ধরেছে পিথাগোরাসের বলে যাওয়া সেই কথাগুলি। পিথাগোরাস বলেছিলেন ঋণাত্মক এক (-১)-ই হল সেই সংখ্যা, যার থেকে সব সংখ্যার জন্ম হয়েছে। অগ্নিজ খুব সুন্দর ভাবে পিথাগোরাসের সেই বিশুদ্ধ গাণিতিক ধারণাকে বর্ণনা করে বোঝাতে চেয়েছে, তারও তেমনটাই মনে হচ্ছে।

১৭ বছর বয়সী অগ্নিজ যে ভাবে গণিতের সমুদ্রে ডুব দিয়ে মণিমুক্তো তুলে আনতে শুরু করেছে, তাতে তাকে সাবাশ জানাতেই হয়। আরও দু’টি বই বেরতে চলেছে অগ্নিজের। ‘উইয়্যার্ডার ম্যাথ্‌স’ এবং ‘উইয়্যার্ডেস্ট ম্যাথ্‌স’। আমাদের অপেক্ষায় থাকতে বাধ্য করল অগ্নিজ!

অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী

ছবি সৌজন্যে: অগ্নিজ বন্দ্যোপাধ্যায়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement