বিজ্ঞানের বন্ধুবিয়োগ
James Randi

বিজ্ঞানী না হয়েও জেমস র‌্যান্ডি গবেষণার সেবা করে গিয়েছিলেন আজীবন

নেচার-এর সম্পাদক জন ম্যাডক্স র‌্যান্ডিকে সঙ্গে নিয়ে যান প্যারিসের অদূরে বুভুনিস্ত-এর ল্যাবরেটরিতে।

Advertisement

পথিক গুহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৭:৩৩
Share:

র‌্যান্ডল জেমস হ্যামিলটন জ়ুইং

গত বছর যত জন দিকপাল আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনি। র‌্যান্ডল জেমস হ্যামিলটন জ়ুইং। নাহ্, বিজ্ঞানী নন তিনি। তবে, তাঁকে বলা যায় বিজ্ঞানের বন্ধু। বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় কথা, তা এক দিকে যেমন কার্যকারণ সূত্রে বাঁধা, তেমনই অন্য দিকে তাতে শিরোধার্য বলে কিছু নেই। চ্যালেঞ্জ, অবিশ্বাস তার মূলমন্ত্র। অন্ধবিশ্বাস বিজ্ঞানের উল্টো পিঠ। বিজ্ঞানী না হয়েও তিনি বিজ্ঞানের সেবা করে গিয়েছেন আজীবন। বলে গিয়েছেন যে, কোনও দাবি যাচাই না করে বিশ্বাস করা ভুল। তাতে পরাবিদ্যা, অপবিজ্ঞান প্রশ্রয় পায়। গুরু বা বাবাদের নানা রকম ভেল্কি স্রেফ বুজরুকি। ম্যাজিক!

Advertisement

হ্যাঁ, ম্যাজিক। জাদুবিদ্যা ভালই জানতেন জেমস র‌্যান্ডি। অথবা, ‘অ্যামেজ়িং র‌্যান্ডি’। ওই নামেই তাঁকে চিনতেন বিশ্ববাসী। জন্ম কানাডার টরন্টো শহরে। ১৯২৮ সালে। কেতাবি বিদ্যে সামান্য। স্কুলে মন বসেনি। ম্যাজিক শেখা, অতএব ভবিতব্যই ছিল। জাদু টানে কাদের? ‘কাদের আবার?’ আত্মজৈবনিক রচনায় লিখেছিলেন র‌্যান্ডি, ‘সেই সব বাউন্ডুলেদের— যাদের জায়গা হয় না সমাজে।’ মন মাতিয়েছিলেন নামী জাদুকর হ্যারি ব্ল্যাকস্টোন। টরন্টোয় আলেকজ়ান্দ্রা থিয়েটারে লুকিয়ে যাঁর খেলা দেখতেন র‌্যান্ডি। তার পর তালিম নিজে নিজে। লোক ডেকে দেখানো। কিছু খুচরো হাততালি। কোথাও বা ধরা পড়ে বেইজ্জত। ঈশ্বরের অবতার বলে যারা নিজেদের ঘোষণা করে, তাদের দেখলে তাড়া করার রোখটাও ওই সময় থেকেই। সে আর এক কাহিনি।

বয়স তখন পনেরো। কে এক জন খবর দিল, শহরের এক চার্চে চলেছে এক অদ্ভুত কাণ্ড। এক পাদ্রি নাকি পড়ে ফেলছেন মানুষের মনের খবর। ব্যাপারটা কী? ধরুন, আপনি একটা কাগজে আপনার মনের কথা লিখে ভরে ফেললেন একটা খামে। এ বার সেই বন্ধ খামটা হাতে নিয়ে পাদ্রি বলে দেবেন, আপনি কী লিখেছেন তাতে। তাজ্জব কি বাত! র‌্যান্ডিকে ছুটতেই হল চার্চে। আর গিয়েই তাঁর অবাক হওয়ার পালা। ও হরি, ম্যাজিক ভাঙিয়ে দিব্যি লোক মজাচ্ছে তো সাধুবাবা! এ জাদু তো জানা আছে ওঁর নিজেরও। বলতে গেলে ভোজবাজিতে হাতেখড়ির আইটেম। কায়দা সহজ। খাম থাকবে অনেক। ধরুন একশোটা। এ বার যখন সতেরো নম্বর লোকটির নাম ধরে ডাকা হবে, তখন পাদ্রি টেবিল থেকে তুলে নেবেন আঠারো নম্বর লোকের খাম। সতেরো নম্বরের খামটা ওঁর আগেই পড়া হয়ে গিয়েছে। সেই যখন ষোলো নম্বর লোকটিকে ডেকেছিলেন। ডেকে বন্ধ খামটা হাতে নিয়ে বেশ দাম্ভিক গলায় পাদ্রি বলেছিলেন, “তোর মনে আপাতত অমুক অমুক ব্যথা। দেখলি তো, আমি সব জানি।” এই বলার কাজটা হয়ে গেলে খামটা খুলে (আসলে যেটা ষোলো নম্বরের খামই নয়, সতেরো নম্বরের খাম) বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া। কি, খুব জটিল মনে হল? মোটেই না। আসল কাজটা তো অ্যাসিসট্যান্টদের। যারা পনেরো নম্বর লোকের লেখা কাগজটা ভরে রাখবে চোদ্দো নম্বর খামে।

Advertisement

বুজরুকি ধরে ফেলার পর হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে র‌্যান্ডি গুটি গুটি টেবিলের তলায়। কাগজের ঝুড়ি থেকে সবেমাত্র ফেলা কাগজটা তুলে নেন। পাদ্রির সামনে তখন এক মহিলা। তিনি ওঁকে শোনাচ্ছেন ওঁরই মনের কথা। ছেঁড়া খাম টেবিলের ওপর মেলে ধরে র‌্যান্ডি চিৎকার করে বলেন, “দেখুন, দেখুন উনি ঠকাচ্ছেন। ওঁর হাতে ধরা খামে নয়, সদ্য ফেলা খামে লেখা ছিল মহিলার মনের কথা।”

তরুণ র‌্যান্ডির মুখে তখন গর্বের হাসি। ভেবেছিলেন সমবেত মানুষজন মুগ্ধ হবেন তাঁর বুদ্ধিতে। নাচবে কাঁধে তুলে। কিন্তু ফল হল উল্টো। রে-রে করে তেড়ে এলেন সবাই। ভিমরুলের চাকে ঘা। কোথাকার এঁচোড়ে পাকা ছেলে, দে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে। এল পুলিশ। হাতে পড়ল কড়া। অপরাধ গুরুতর। ধর্মীয় সভায় ব্যাঘাত। থানায় হাড়-কাঁপানো শীতে পাথরের উপরে বসে থাকা। অপমানে লজ্জায় চোখের কোণে জল। ছাড়া পেয়ে তরুণ র‌্যান্ডির একমাত্র প্রতিজ্ঞা— ‘জীবন অতিষ্ঠ করে তুলব ওদের— যারা জাদুবিদ্যাকে করেছে অপবিত্র’।

প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন জীবনভর। ষাঁড়ের সামনে যেমন লাল শালু, র‌্যান্ডির কাছে তেমন পরাবিদ্যা। তা এই শিকারি বেড়াল ইঁদুর বানিয়েছেন অনেককেই। সবচেয়ে বিখ্যাত শিকার বোধ হয় ইউরি গেলার। হ্যাঁ, মনের জোরে চামচ বাঁকিয়ে যিনি একদা খবরের শিরোনাম কেড়েছিলেন। র‌্যান্ডির কাছে কুপোকাত হন তিনি। ইহুদি এই যোগীবর এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে র‌্যান্ডির নেমন্তন্ন গ্রহণ করে পড়েন বিপাকে। মনের কসরত কাজ করে না মোটে। ল্যাজে-গোবরে লাখ লাখ টিভি দর্শকের সামনে। অতঃপর ওই একই অনুষ্ঠানে চামচ বেঁকিয়ে দেখান র‌্যান্ডি। প্রমাণ করেন সবটাই চোখের ভ্রম।

ব্যবসা লাটে তুলেছিলেন ঢের সাধু-সন্তের। যেমন, পিটার পোপোফ। নিজেকে যিনি জিশুর চেলা বলে জাহির করে ব্যবসা ফেঁদেছিলেন দিব্যি। এতই জনপ্রিয় হয়েছিলেন উনি যে, টিভিতে দেখানো হত ওঁর বাহাদুরি। পোপোফ প্রায়ই আয়োজন করতেন রোগীদের সভা। কঠিন, দুরারোগ্য ব্যাধির মানুষজন হাজির হতেন সেখানে। তাঁদের কারও কারও মাথায় হাত রেখে উনি বলতেন, “বাড়ি যা। ভাল হয়ে যাবি। আপাতত জিশু ভর করেছেন আমার উপরে। আমার মুখ দিয়ে তিনিই কথা বলছেন।” লোক ভেঙে পড়ত এক-একটা অনুষ্ঠানে।

এ রকম অনুষ্ঠান কয়েক বার স্বচক্ষে দেখেছিলেন র‌্যান্ডি। ধরে ফেলেছিলেন কায়দাটা। সভা শুরুর আগে পোপোফের স্ত্রী বা সহকারীরা রোগীদের মাঝে ঘুরে ঘুরে কথা বলেন। আর, কী আশ্চর্য, পোপোফ পরে এসে কেবল ওঁদের সঙ্গেই কথা বলেন, আশীর্বাদ করেন। প্রথম দর্শনেই রোগের নাড়িনক্ষত্র নির্ভুল বলে দেন বলে মানুষ মোহিত হয়ে বিশ্বাস করতেন জিশু সত্যিই ভর করেছেন ওঁর উপর।

চালাকি ধরতে চাল চেলেছিলেন র‌্যান্ডিও। ওঁর পরিচিত এক পোস্টম্যানকে মেয়ে সাজিয়ে এমনই এক অনুষ্ঠানে পাঠিয়েছিলেন। মহিলা সেজে নতুন নাম নিয়ে র‌্যান্ডির চর গিয়ে বসেছিলেন সভার সামনের সিটে। যথাকালে এলেন পোপোফের স্ত্রী। কথা বলে চলেও গেলেন। আর পরে জিশু ভর করার পরে পোপোফ স্বয়ং। বাইরে দাঁড়িয়ে রেডিয়ো রিসিভারে র‌্যান্ডি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলেন পোপোফের স্ত্রী দিব্যি নির্দেশ দিচ্ছেন স্বামীকে বেতারে। কায়দাটা র‌্যান্ডি আঁচ করেছিলেন অনেক আগেই। পোপোফের কানে বধিরদের মতো এক যন্ত্র লাগানো দেখে ওঁর সন্দেহ হয়, ওটা রেডিয়ো রিসিভার ছাড়া আর কিছু নয়। টিভি প্রোগ্রামে ও বই (দ্য ফেথ হিলারস) লিখে পোপোফের কীর্তিকলাপ সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছিলেন র‌্যান্ডি। জানিয়েছিলেন, কী ভাবে ওঁর পাঠানো চরকে মহিলা ভেবে জরায়ুর অসুখ থেকে সেরে ওঠার আশীর্বাদ করেছিলেন পোপোফ। আসলে পুরুষদের জরায়ু থাকে না। দ্য ফেইথ হিলারস ছেপে বেরনোর পর বন্ধ হয়ে যায় পোপোফের অনুষ্ঠান।

ভিজ়িটিং কার্ডে মানুষ লেখে নিজের পদ, ডিগ্রি। আর র‌্যান্ডি লিখেছিলেন, ‘প্রফেশনাল ইমপস্টার’। ‘পেশাদার ভণ্ড’। নিজেকে ‘ডিবাংকার’ বলতে চাননি উনি। বলতেন, ‘ইনভেস্টিগেটর’। তৈরি করেছিলেন সাইকপ বা ‘কমিটি ফর দ্য সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন অব ক্লেইমস অব দ্য প্যারানরমাল’। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সাগান, নোবেলজয়ী ফ্রান্সিস ক্রিক কিংবা মারে গেল-ম্যান, জীববিজ্ঞানী স্টিফেন জে গুল্ড, মনস্তাত্ত্বিক বি এফ স্কিনার, কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ়াক আসিমভ, কলামনিস্ট মার্টিন গার্ডনার সদস্য ছিলেন সাইকপ-এ। তা ছাড়া নিজের নামে র‌্যান্ডি গড়েছিলেন এডুকেশনাল ফাউন্ডেশন। ঘোষণা করেছিলেন ‘ওয়ান মিলিয়ন ডলার প্যারানরমাল চ্যালেঞ্জ’। যে কোনও আধিভৌতিক ক্ষমতা (জ্যোতিষ সমেত) সত্যি প্রমাণ করতে পারলে দশ লক্ষ ডলার পুরস্কার। কেউ জেতেননি ওই প্রাইজ়।

১৯৮৮ সালে বড় আকারে খবর হয়েছিলেন র‌্যান্ডি। বিজ্ঞান জার্নাল নেচার ছেপেছিল ফরাসি গবেষক জ়াক বুভুনিস্ত-এর পেপার। এক রাসায়নিকের অকল্পনীয় লঘু দ্রবণ (এত লঘু যে তাতে রাসায়নিক উধাও) রাসায়নিকের কার্যক্ষমতা দেখাচ্ছে। প্রথাগত বিজ্ঞান এটা মানে না। হোমিয়োপ্যাথি মানে। পেপার ছাপার পর নেচার-এর তৎকালীন সম্পাদক জন ম্যাডক্স র‌্যান্ডিকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্যারিসের অদূরে বুভুনিস্ত-এর ল্যাবরেটরিতে। ওঁদের উপস্থিতিতে কাজ করেনি রাসায়নিক। বুভুনিস্ত তো বটেই, বদনাম কুড়িয়েছিল নেচার-ও। সত্যি মিথ্যে যাচাই না করে পেপার ছাপানোর জন্য। এক বিজ্ঞানী রেগেমেগে লিখেছিলেন, ‘এডিটর, এক ম্যাজিশিয়ান আর তাঁর খরগোশ মিলে পেপার ছাপে নেচার-এ!’

র‌্যান্ডির প্রয়াণের পরে সেই নেচার লিখেছে, “ওঁর মূল বক্তব্য ছিল: নিজেকে ত্রুটিহীন ভেবো না। যত বুদ্ধিমান কিংবা শিক্ষিতই হও না কেন, ঠকতে তুমি পারোই।” সাধারণ মানুষ তো বটেই, বিজ্ঞানীদের কাছে এর চেয়ে বড় উপদেশ আর হয় নাকি?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement