সভ্যতার একেবারে আদিযুগে মানুষ ছিল যাযাবর আর শিকারি। প্রকৃতি, বন আর বনের গাছপালা, প্রাণীরা ছিল তাদের একান্ত কাছের। তারা জঙ্গল থেকে খাবার জোগাড় করত, বনের পশু মেরে খেত, বনের মধ্যে কোথাও একটা ছোট্ট বাসা বানিয়ে কিছু দিন বসবাস করত… তার পর চলে যেত নতুন আস্তানার সন্ধানে।
ছবিটা বদলাতে থাকল দ্রুত, যখন মানুষ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল ধীরে ধীরে। তার প্রথম ধাপই ছিল কৃষিকাজ। আর তাকে ঘুরে বেড়াতে হয় না। নিজের খেতে ফসলের চাষ করলেই নিশ্চিন্ত জীবনের সুযোগ। কিন্তু একই সঙ্গে মানুষের জীবনের কয়েকটা একেবারে মূল ব্যাপারও বদলে গেল চিরকালের জন্য। সে সময় কৃষিকাজ ছিল সম্পূর্ণ পরিমাণে জৈব সার, পশু আর মানুষের শক্তির সমন্বয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইংল্যান্ডে সুপার ফসফেট সার প্রস্তুত হয়। এর পরেই রাসায়নিক ভাবে অ্যামোনিয়ার আবিষ্কার গোটা ইউরোপ ও আমেরিকায় রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার ব্যবহারের পথ খুলে দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর কালে বাজার ছেয়ে ফেলে ডিডিটি, বিএইচসি-র মতো কীটনাশক, ২, ৪-ডিএমসিপিএ-র মতো আগাছানাশকরা।
ফলে কৃষি উৎপাদন বেড়ে গেল হু হু করে। ‘গ্রো মোর ফুড’ স্লোগানকে সামনে রেখে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিতে এল সবুজ বিপ্লব। সঙ্গে ছিল নিত্যনতুন সঙ্কর ও উচ্চ ফলনশীল ফসলের বীজ। ফলে ভারতেও ষাটের দশকের সবুজ বিপ্লবের ফলে ফসল উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ল। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের বস্ত্র-বাসস্থানের সংস্থান করল কৃষিকাজ।
কিন্তু পদ্মে যেমন কাঁটা থাকে, তেমনই জমিতে মাত্রাতিরিক্ত আর বেহিসেবি কীটনাশকের ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিকটা প্রতিভাত হল অচিরেই। খাদ্যশস্য এবং ফল-সবজিতে ব্যবহৃত অতিরিক্ত কীটনাশক ও তাদের বাই-প্রোডাক্টগুলি সরাসরি কিংবা জলের মাধ্যমে প্রবেশ করল মানুষ ও পশুদের দেহে। যে হেতু এরা জীবদেহের ফ্যাট টিস্যুগুলিতে জমা হয়, তাই প্রাণীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, এমনকি লিভারে, স্তনগ্রন্থিতে জমা হতে থাকল এই কীটনাশকের অণুগুলি। খাদ্য পিরামিডের ওপরের দিকে থাকা প্রাণীরা অথবা মৃতদেহ-খেকো পাখিরা (শকুন, চিল) ক্ষতিগ্রস্ত হল সবচেয়ে বেশি। শকুন তো আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। উন্নত দেশগুলোতে মানুষজন নড়েচড়ে বসলেন। বিশেষ করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান সরব হল রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের এই ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে। অস্বীকার করার উপায় নেই, এই সচেতনতা বৃদ্ধির নেপথ্যে ছিল প্রকৃতিবিদ র্যাচেল কার্সনের লেখা ক্লাসিক দ্য সাইলেন্ট স্প্রিং। ১৯৬২ সালে প্রথম প্রকাশের পরই গোটা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিল বইটি। ১৯৭২ সালে মার্কিন সরকারের ডিডিটি-র ব্যবহার নিষিদ্ধ করায় অনেকটাই ভূমিকা পালন করেছিল কার্সনের বই। আর সেই থেকেই জৈব কৃষি ও জৈব খাদ্য উৎপাদনের কথা উঠে আসে। এ হল যাকে বলে ‘শিকড়ে ফেরা’। জৈব কৃষির বিভিন্ন দিক, উপায়, পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে গঠিত হয় আইএফওএএম বা ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব অর্গানিক এগ্রিকালচার মুভমেন্টস। প্রথমে ততটা সাড়া না মিললেও ক্রেতাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক থেকে সৃষ্ট রোগব্যাধির ভয়, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার চিন্তা, ধীরে ধীরে জৈব কৃষির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়িয়েছে। শুধুমাত্র উন্নততর এবং রাসায়নিক-মুক্ত ফসলই নয়, জৈব কৃষি এক উন্নততর পরিবেশেরও স্বপ্ন দেখায়।
জৈব কৃষি কী? আইএফওএএম-এর মতে, জৈব কৃষিতে প্রকৃতির নিজস্ব ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হয় রোগ আর পোকার দমনে। ঠিক যেমন পচা লতাপাতা, গোবর, সবুজ সার, বিভিন্ন উপকারী ব্যাকটিরিয়া ও ছত্রাককে প্রয়োজনীয় সার উৎপাদনে লাগানো হয়। গো-খাদ্য বা পোলট্রির খাদ্যও উৎপন্ন হয় জৈব পদ্ধতিতেই। রাসায়নিক সার, কীটনাশক, হরমোন বা জিন-ম্যানিপুলেশন-এর মাধ্যমে ফসল উৎপাদন একেবারে বন্ধ। ফলে উন্নত হবে ফসল, বাঁচবে প্রকৃতি। কার্যক্ষেত্রে জৈব কৃষিকে জনপ্রিয় করার জন্য দেশে দেশে কমিটি স্থাপন হল। আমাদের দেশে বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীনে পরিচালন কমিটি ও এপিইডিএ, জৈব কৃষি বিষয়ে কৃষকদের উৎসাহিত করেন। তাঁরা জৈব খামার গড়তে চাইলে আইএফওএএম বা সংশ্লিষ্ট ফসলের বোর্ড থেকে সার্টিফিকেট নিতে হবে।
তবে ফসল বিক্রি নিয়ে চাষির মাথাব্যথা কম। এপিইডিএ তার দায়িত্ব নেয়। ‘ইন্ডিয়া অর্গানিক’ ব্র্যান্ড নাম নিয়ে দেশে ও বিদেশের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয় সেই ফসল। কিন্তু এই সার্টিফিকেট পেতে চাষিকে কী কী করতে হয়? জমি ও খামারকে প্রথমত রেজিস্ট্রেশন করাতে হবে জৈব খামার তৈরির জন্য। আইএফওএএম থেকে দেখে যাবে এই জমি জৈব ফসল তৈরির উপযোগী কি না। জৈব খামারে অন্তত ৩ বছর আগে থেকে কোনও রকম রাসায়নিক ব্যবহার নিষিদ্ধ। শুধু তা-ই নয়, জমিতে ব্যবহৃত জৈব সার, বীজ, পশুখাদ্য, সেচের জল— সব কিছু পরীক্ষা করে তবে জমিকে জৈব খামারের সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।
পরবর্তীতে ফসল উৎপাদনের প্রতিটি অংশে, ফসল কাটা এমনকি সংরক্ষণের সময়ও আইএফওএএম থেকে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরীক্ষা করা হয় চাষি জৈব খামারের সব নিয়ম মানছে কি না। কোথাও নিয়মের কোনও রকম হেরফের হলে সঙ্গে সঙ্গে ‘জৈব খামার’ উপাধি কেড়ে নিয়ে চাষিকে আর্থিক শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। খামারে যে জৈব সার, গোবর সার ব্যবহার হয়, তারও উৎস ও ব্যবহার সম্পর্কে চাষিকে সচেতন থাকতে হয়। যেমন সচেতন থাকতে হয় ব্যবহার্য বীজ নিয়ে, যা অবশ্যই জৈব পদ্ধতিতে উৎপন্ন হতে হবে। তবে এত কষ্ট করে যে ফসল চাষি উৎপাদন করবেন, তার বাজার কিন্তু বেশ ভাল। শুধু দেশীয় নয়, বিদেশের বাজারে জৈব ফসল ও জৈব খাদ্যের এখন খুব কদর। ২০০৩ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১১,৫০০ কোটি টাকার জৈব খাদ্য বিক্রি হয়। ২০২১ সালের শেষে এই বিক্রি বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬০,০০০ কোটি টাকায়। বর্তমানে সারা বিশ্বের মাত্র ৬ শতাংশ জমিতে জৈব ফসল চাষ হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে কম হয় ভারতে (০.০৩%) আর সবচেয়ে বেশি হয় অস্ট্রেলিয়াতে (১১.৩%)। ভারতের জৈব ফসল সারা বিশ্বের নিরিখে ১ শতাংশেরও কম। তার মধ্যেও সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় বাসমতী চাল। দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, ভারতের জৈব খামারগুলি গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতে, যেখানে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক এমনিতেই খুব কম ব্যবহৃত হয়। জৈব ফসলের বিশ্ববাজার ধীরে ধীরে চাষিদের উৎসাহিত করছে জৈব কৃষিতে। বিশ্বের বিভিন্ন সুপারমার্কেট চেন, এমনকি এ দেশের বড় বিপণিতেও বেশ ভাল ব্যবসা করছে জৈব খাদ্য।
আর এই জৈব কৃষি থেকেই স্বনির্ভর কৃষির শুরু। এখানে ক্ষুদ্র এমনকি প্রান্তিক চাষিরাও নিজেরাই বিভিন্ন জৈব সার প্রস্তুত করেন, যা জমিতে প্রয়োগ করে উন্নত মানের ফসল উৎপাদন করছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে বলাগড়ের মগরাহাটা, ইছাপুর গ্রামের কৃষকদের কর্মকাণ্ড কেস স্টাডি হিসেবে উল্লেখযোগ্য। ২০১৫-১৬ সালে এখানে স্বনির্ভর কৃষির উদ্যোগ নেওয়া হয়ছিল। এখন তাঁরা জৈব উপায়ে ফসল উৎপাদন তো করছেনই, এমনকি বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করছেন, উপকারী জীবাণুদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে রোগ-পোকা দমনে ব্যবহার করছেন— সবটাই নিজের হাতে করছেন। ফলে কৃষিতে বৈচিত্র্য আসছে, পরিবেশ সুরক্ষিত থাকছে। নতুন প্রজন্ম এই স্বনির্ভর কৃষিতে আগ্রহী হচ্ছে। সব মিলিয়ে জৈব কৃষি ও স্বনির্ভর কৃষি এক সুস্থায়ী পথের সন্ধান দেখাচ্ছে।
জৈব কৃষির হাত ধরে স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের প্রধান ডেভিড বিসলে সাবধান করেছেন, অতিমারির ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্য উৎপাদন, সরবরাহ ও বণ্টন ব্যাহত। ফলে দেখা দেবে ভয়ঙ্কর খাদ্যসঙ্কট। সেই সঙ্গে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ায় হানা দেবে দুর্ভিক্ষ। এই সঙ্কট থেকে বাঁচতে শহর নয়, গ্রামের উপর ভরসা করতে হবে, এ কথা অতিমারি শুরু হওয়ার সময় থেকেই বলে চলেছেন তাবড় অর্থনীতিবিদেরা। একুশ শতকেও গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি, যা আরও মজবুত করবে জৈব কৃষি ও স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা।
ধান্যগবেষণাকেন্দ্র, চুঁচুড়ায় কর্মরত মৃত্তিকা বিজ্ঞানী