কল্পবিজ্ঞান: ‘স্টার ওয়ার্স’ ছবিতে এক গ্রহের দুই সূর্য
স্টার ওয়ার্স সিরিজ়ের সিনেমাগুলোর কথা মনে আছে? ১৯৭০-এর দশকের শেষ থেকে ওই সিরিজ়ের ফিল্ম সুপারডুপার হিট। কল্পবিজ্ঞান কাহিনি নির্ভর করে তৈরি ওই সব ছবি, সিনেমাপ্রেমিক দর্শকদের এখনও মনে আছে।
কেন কল্পবিজ্ঞান? অনেক কারণে। তার মধ্যে একটা এই যে, ছবির নায়ক লিউক স্কাইওয়াকারদের গ্রহ ছিল টাটোইন। সে গ্রহের দুটি সূর্য৷ অর্থাৎ গ্রহটি একটি নয়, দুটি নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমনটা সাধারণত দেখা যায় না। পৃথিবীসহ সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত সমস্ত গ্রহই একটিই নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে। তাই দুই সূর্যযুক্ত গ্রহ টটোইন শুধুমাত্র কল্পবিজ্ঞানের পাতাতেই সম্ভব বলে মনে করা হত। তবে এ ধারণা বদলাচ্ছে দ্রুত। বাস্তেবও বেশ কয়েকটি গ্রহের খোঁজ মিলেছে, যাদের সূর্যের সংখ্যা দুই। কয়েকটি গ্রহকে আবার তিনটি বা তার বেশি সূর্যকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করতেও দেখা গিয়েছে।
তবে, এই গ্রহগুলির বেশিরভাগই এক্সোপ্ল্যানেট। অর্থাৎ, আমাদের বাসগ্রহ পৃথিবী যে ছায়াপথের অংশ তার চেয়ে অনেক দূরে, অন্য কোনও ছায়াপথে রয়েছে এই গ্রহগুলি।
যেখানে দুই বা তার চেয়ে বেশি নক্ষত্র পরস্পরের সঙ্গে অভিকর্ষের টানে বাঁধা হয়ে আছে, অনেকে দু’জন দু’জনকে ঘিরে পাক খাচ্ছে। অনেক জায়গায় আবার একটা বড় নক্ষত্র আছে, তাকে ঘিরে অন্য নক্ষত্ররা ঘুরছে। বহু আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথ থেকে আসা সঙ্কেত অত্যন্ত উন্নতমানের দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, একাধিক নক্ষত্রের নিজস্ব সৌরজগতের গ্রহগুলির বেশিরভাগই বৃহস্পতি বা তার চেয়েও বড়। সাধারণত এত বড় আকারের গ্রহ গ্যাসীয় হওয়ার কথা।
১৯৯৩ সালে প্রথম দুই নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণরত গ্রহের অস্তিত্বের সন্ধান মিলেছিল। সেই গ্রহ ঘুরপাক খাচ্ছে একটি মিলিসেকেন্ড পালসার (যে সমস্ত পালসার নক্ষত্র বা খুব শক্তিশালি চৌম্বকশক্তির ঘুরন্ত নিউট্রন নক্ষত্র, যাদের ঘোরার সময় ১ থেকে ১০ মিলিসেকেন্ড)। নাম দেওয়া হয় ‘পিএসআরবি১৬২০-২৬’। সেই সঙ্গে রয়েছে একটা সাদা-বামন নক্ষত্র বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ। এই নক্ষত্রমণ্ডলীর উপর পাঁচ বছর নজর রেখে দেখা গিয়েছিল, আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতির চেয়ে ২.৫ গুণ বড় একটা গ্রহ ওখানে আছে। সেই গ্রহ ঘুরছে একটা বেশ লম্বাটে উপবৃত্তাকার পথে।
২০০৫ সালে আরও এক বৃহস্পতির মাপের গ্রহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ‘এইচডি২০২২০৬’ নক্ষত্রমণ্ডলে। এর বড় নক্ষত্রটি আমাদের সূর্যের মতো হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করে শক্তি জোগায়, এদের বিজ্ঞানের ভাষায় মূল-পর্বের নক্ষত্র বা ‘মেন সিকোয়েন্স স্টার’ বলে। সঙ্গে ঘুরছে একটা ব্রাউন ডোয়ার্ফ বা বাদামি-বামন নক্ষত্র। এই ধরনের গ্রহদের বৃত্তাকার-দুই নক্ষত্রের জগৎ বা ‘সারকম-বাইনারি সিস্টেম’ বলে। অনেক গ্রহের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে, যারা একটা স্থিতিশীল কক্ষপথে দু-দটো নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে।
এই সব নক্ষত্রের নিজের জগতের অনেক ধরনের গড়ন হতে পারে। মূল নক্ষত্রের ভর সূর্যের ০.৬৯ গুণ থেকে ১.৫৩ গুণ পর্যন্ত হয়। একই জগতে ঘুরপক খাওয়া দুটো নক্ষত্রের ভরের অনুপাত ১.০৩ থেকে ৩.৭৬ হয়। দুটি নক্ষত্রের নিজেদের মধ্যের কক্ষপথ ০.০২৩ থেকে ০.৫২১ পর্যন্ত কেন্দ্রাপসারী হয়। এদের মাঝে প্রদক্ষিণরত গ্রহদের কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার থেকে বেশ অনেকটা উপবৃত্তাকার হয়ে থাকে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের দুটো-নক্ষত্রের সঙ্গে ঘোরা গ্রহগুলি নক্ষত্রের খুব কাছ থেকেই প্রদক্ষিণ করে। ২০১৬ সালে দুই নক্ষত্রের জগতে বৃহস্পতির চেয়ে ছোট গ্রহের সন্ধান মেলা শুরু হয়। এখনও পর্যন্ত ২৩টি এ ধরনের গ্রহ আবিষ্কার হয়েছে।
দুই নক্ষত্রের জগতের মতো আটটি তিন নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত গ্রহেরও খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নক্ষত্রমণ্ডলী হল ‘এইচডি১৩২৫৬৩’ এবং ‘এইচডি১৩২৫৬৩’। প্রথমটিতে প্রদক্ষিণরত গ্রহটি বৃহস্পতির চেয়ে ভরে ১.৩ গুণ বেশি এবং সে তার মূল নক্ষত্র থেকে ২.৬ এইউ দূরত্বে (এইউ হল পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব) ঘুরছে। এইচডি১৩১৩৯৯ নক্ষত্রজগতের প্রধান নক্ষত্র হচ্ছে এইচডি১৩১৩৯৯। তাকে ঘিরে ঘুরছে আরও দুটি নক্ষত্র, যারা নিজেদের চারদিকে ডাম্বেলের আকার নিয়ে ঘুরছে। আর এই ডাম্বেলের গড়-কক্ষপথ প্রধান নক্ষত্র থেকে ৩০০ মহাজাগতিক দূরত্বে রয়েছে। এই নক্ষত্রমণ্ডলীর গ্রহটি আমাদের বৃহস্পতি থেকে চার গুণ বড়। প্রধান নক্ষত্র থেকে গ্রহটির কক্ষপথ ৯০ মহাজাগতিক দূরত্বে রয়েছে।
চার নক্ষত্রকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে, এমন গ্রহেরও তথ্য মিলেছে। এমনই একটা গ্রহ ‘কেআইসি৪৮৬২৬২৫’। এখন বোঝা যাচ্ছে, তিনের বেশি নক্ষত্রযুক্ত সৌরজগৎ ও তাকে ঘিরে প্রদক্ষিণরত গ্রহের অস্তিত্ব থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। আসলে দুই বা তার বেশি নক্ষত্রের নিজের জগতে হয় মূল নক্ষত্র একটি থাকে, বাকিরা গ্রহদের মতো তাকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করে ; বা দুটো নক্ষত্র যমজ নক্ষত্র বা টুইন স্টার হিসেবে থাকে (যারা নিজেদের চারদিকে ঘোরে বেশ দূরে থেকে) আর এই দুটো ‘দ্বৈত নক্ষত্র’ আবার নিজেদের চারপাশে ঘোরে।
তবে, প্রশ্ন ওঠে, এই ধরনের গ্রহে আদৌ প্রাণের অস্তিত্ব কি সম্ভব? বা যদি কখনও মানুষ এই ধরনের গ্রহে পৌঁছতে পারে, তা হলেও কি গ্রহগুলি বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে? এখনও পর্যন্ত যে গ্রহদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির বেশিরভাগই গ্যাসীয় পিণ্ড। এ ধরনের গ্রহে সারাক্ষণই চলে ভয়ঙ্কর ঝড়। ঠিক যেমন আমাদের সৌরজগতের বৃহস্পতি। এ অবস্থায় প্রাণী বাঁচতে পারে না। তা ছাড়া, এই গ্রহদের কক্ষপথ তাদের মূল নক্ষত্রের খুব কাছে, ফলে উষ্ণতা খুব বেশি। এই অবস্থাও প্রাণের অস্তিত্বের পক্ষে উপযুক্ত নয়। তবে, এই ধরনের অনেক নক্ষত্রের নিজের জগতে ছোট, বাসযোগ্য গ্রহ থাকার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। টাটোইন গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেলেও, সেখানে থাকার স্বপ্ন সার্থক হবে না।