সৌরালোক কব্জা করে অন্ধকার তাড়ানোর লড়াই

বছর দশেক আগের বলিউডি ছবি ‘স্বদেশ’-এ এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। বিদ্যুৎহীন গ্রামে ঘরে আলো জ্বলে উঠতে দেখে প্রৌঢ়ের নিভু-নিভু জ্যোতির চোখও যেন জ্বলে উঠল। সরকারি বিদ্যুৎ না-পৌঁছলেও গ্রাম্য ঝর্নার জলে ডায়ানামো বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এই অসম্ভব কাণ্ড ঘটান বিদেশফেরত ইঞ্জিনিয়ার মোহন ভার্গব— যে ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০২:১৭
Share:

এই সেই সৌর আলো।

বছর দশেক আগের বলিউডি ছবি ‘স্বদেশ’-এ এমন দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। বিদ্যুৎহীন গ্রামে ঘরে আলো জ্বলে উঠতে দেখে প্রৌঢ়ের নিভু-নিভু জ্যোতির চোখও যেন জ্বলে উঠল।

Advertisement

সরকারি বিদ্যুৎ না-পৌঁছলেও গ্রাম্য ঝর্নার জলে ডায়ানামো বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এই অসম্ভব কাণ্ড ঘটান বিদেশফেরত ইঞ্জিনিয়ার মোহন ভার্গব— যে ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান।

সৌরালোক কব্জা করে বাংলার গাঁ-ঘরে এ বার তার থেকেও বড় চমক দিতে চলেছেন প্রবীণ সৌরবিজ্ঞানী শান্তিপদ গণচৌধুরী। একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের গবেষণায় নামমাত্র খরচ ও সরঞ্জামে গ্রামের ঘরে আলো জ্বালার এক কৌশল বার করে ফেলেছেন তিনি। দিনভর নামমাত্র আলোয় স্যাঁতসেঁতে ঘরে থেকে নানা ধরনের অসুখে কাবু গ্রামীণ জনতার জীবনে যা আশার আলো হয়ে উঠতে পারে। মাসখানেকের মধ্যে সুন্দরবন, বর্ধমান ও ত্রিপুরার মোট ৩০টি গ্রামে এমন আলো চালু করা হচ্ছে।

Advertisement

সরকারি সূত্র বলছে, বাংলার ৬০ শতাংশ গ্রামেই এখনও সব ঘরে আলো জ্বলে না। ব্যাটারি চালিত সোলার লাইটেও গাঁটের কড়ি গচ্ছা দিতে হয় বহু পরিবারকে। রাতে যারা সোলার লাইট জ্বালান, দিনের বেলায় ব্যাটারি খরচ এড়াতে তাঁরা ঘরে পারতপক্ষে আলো জ্বালান না। গ্রামের কাঁচা ঘরে সাধারণত ছোট ছোট জানলা-ঘুলঘুলির রেওয়াজ। চোর-ডাকাতের ভয়ও ঘরে বড় জানলা না-রাখার কারণ। ফলে, দিনের বেলায় আঁধারেই ডুবে থাকে ঘর-বাড়ি। ডাক্তারদের দাবি, আলোর অভাবে স্যাঁতসেঁতে ঘরে থাকতে থাকতে গ্রামের মানুষের অনেকেই হাঁপানি, শ্বাসকষ্টে কাবু হন। সূর্যের আলোর অভাবে ভিটামিন ডি-র খামতিও দেখা যায়। ফলে, ছোটদের বিশেষ করে মেয়েদের হাড়ের গঠন কমজোর হয় বলে অভিমত ডাক্তারদের। এ সব মাথায় রেখেই কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রকের একটি প্রকল্প, কম খরচে দিনে গ্রামের ঘরে আলোর সংস্থান করতে উদ্যোগী হয়েছে।

কলকাতার কালিকাপুরের অপ্রচলিত শক্তি গবেষণা কেন্দ্রে নিরীক্ষার শেষে দেখা যাচ্ছে, একটি ঘরের ছাদে অ্যাক্রিলিকের একটি গম্বুজাকৃতি খাপ বসিয়েই বন্দি হচ্ছে সূর্যালোক। ঘরের ভিতরেও একই ধরনের আর একটি খাপ হল আলোর বাল্‌ব। দু’টি খাপের মাঝে একটি সাধারণ পাইপ। পাইপের ভিতরে আয়নার মতো আলোর প্রতিফলন ঘটাতে চকচকে একটি পরত বা ‘রিফ্লেক্টর’ রয়েছে। ছড়িয়ে থাকা সৌরালোক এই ‘রিফ্লেক্টর’-এই জমাট বাঁধছে। ঘরের ভিতরে বাল্‌বের সঙ্গে লেগে থাকা দড়িতে টান মারলেই ‘ম্যাজিকে’র মতো জ্বলছে, নিভছে আলো। ছাদের উপরের গম্বুজ এবং তার ঢাকনি ঝড়-জল সহ্য করার মতো পোক্ত পদার্থ দিয়েই তৈরি।

সরকারি সূত্রের খবর, চার লক্ষ টাকা খরচে সফল এই গবেষণায় এক-একটি ঘরে সরঞ্জামের খরচ পড়ছে বড়জোর ২০০ টাকা। এক বার বসালে আলো জ্বলবে দশ বছর। তবে শুধু দিনেই জ্বলবে। রাতে আলো জ্বালাতে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।

‘স্বদেশ’ ছবির শাহরুখ খানের কীর্তির সঙ্গে এই আলোর ফারাক কোথায়? রাজ্যের ‘গ্রিন এনার্জি ডেভলপমেন্ট অথরিটি’-র কর্তা শান্তিবাবুর বক্তব্য, চলচ্চিত্রটিতে যা দেখানো হয়েছিল, তাকে বলে পিকো হাইডেল পাওয়ার। গ্রীষ্মে গ্রাম্য ঝোরা শুকিয়ে এলে তাতে কিন্তু আলো জ্বলবে না। কিন্তু মেঘলা দিনে সামান্য দৃশ্যমানতা থাকলেও কাজ করবে এই ‘জাদু আলো’। বাস্তবিক, ছিটেফোঁটা সূর্যালোকের দেশ ফিনল্যান্ডে ঘরে আলো ঢোকানোর একটি কসরত থেকেই এ দেশে এই কৌশল বার করেন শান্তিবাবু। গবেষণাগারে দেখা গিয়েছে, একটি ৫০ বর্গ ফুটের ঘরে এই আলোয় অনায়াসে ছুঁচে সুতো পরানো যাচ্ছে। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সাহায্যে এই নয়া প্রযুক্তির দিনের বেলার ‘সোলার লাইট’-এর প্রসারে ইতিমধ্যে তোড়জোড় শুরু করেছেন কয়েক জন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement