দীর্ঘ ৭৫ বছর পর কী এমন ঘটনা ঘটল যে প্লুটোকে ‘গ্রহে’র সম্মান থেকে বঞ্চিত করা হল?
‘গ্রহ’ বলা হোক বা না হোক, প্লুটো তো একই রয়েছে। ‘মাদ্রাজ’কে চেন্নাই বা ‘বম্বে’কে এখন মুম্বই বলা হলেও শহর দু’টো তো আর বদলায়নি!
প্লুটোও যেমন ছিল, তেমনই রয়েছে। কিন্তু আসলে প্লুটো কেমন ছিল, সেটাই আমরা ঠিকঠাক জানতাম না। প্লুটো কত বড় বা প্লুটোর ভর কত সে সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণাই ছিল না। ১৯৭৮ সালে, প্লুটো আবিষ্কারের প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরে আমরা জানলাম, প্লুটোর একটি ছোট ভাই আছে, ‘শ্যারন’ তার নাম। ‘শ্যারন’ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারলাম, আসলে প্লুটো আমাদের চাঁদের চেয়েও ছোট। আর যদি বলি, ছোট ভাই ‘শ্যারন’ ঘুরছে প্লুটোর চার পাশে, তা হলে এটা বলা যায় যে প্লুটোও ‘শ্যারনে’র চার পাশে ঘুরছে। কারণ, যে কেন্দ্রটির চার পাশে দু’জনে আবর্তিত হচ্ছে, তা দু’জনের মাঝামাঝি না থাকলেও কারও ভেতরে নয়। এটা কিন্তু অন্য গ্রহের চার পাশে ঘোরা উপগ্রহদের মতো নয়। পৃথিবী ও চাঁদের ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রটি পৃথিবীর ভেতরে। কারণ, পৃথিবী তার চাঁদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ ভারী। সেই হিসেবে, ‘শ্যারন’ আর প্লুটোকে ‘যুগ্ম গ্রহ’ বললেও ভুল হবে না।
আরও পড়ুন- স্বার্থপর লোকটাও হয়ে যাবেন পরোপকারী, বিজ্ঞান তাও সম্ভব করবে!
বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল রহস্য কি ভেদ হল এবার?
ও দিকে, ১৯৫১ সালে, প্লুটো আবিষ্কারের প্রায় ২০ বছর পর জেরার্ড কুইপার প্রস্তাব দিলেন যে, সৌরজগতের গ্রহগুলি গ্যাস ও ধুলোর যে চাকতি থেকে জন্ম নিয়েছিল, সেই চাকতির অবশিষ্ট অংশটি এখনও রয়েছে পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কোটি কিলোমিটার দূরে। আর সেই বলয়ের মত স্থানটি প্রায় সাড়ে ৩০০ কোটি কিলোমিটার বিস্তৃত। এখানে গ্যাস আর ধুলোর ঘনত্ব এত কম ছিল যে বড় কোনও গ্রহ জন্মাতে পারেনি। তাই এই জায়গাটি ছোট ছোট পাথর আর বরফের টুকরোয় ভরা। ঠিক মঙ্গল আর বৃহস্পতির মাঝে গ্রহাণু বলয়ের (Asteroid Belt) মতো। মাত্র দুই দশক আগে, ১৯৯২ সালে এই জায়গাটির (যাকে ‘কুইপার বেল্ট’ বলা হয়) হদিশ পাওয়া যায়। আর সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারি, প্লুটো আসলে এই ‘কুইপার বেল্টে’র মধ্যেই রয়েছে। আর সে ওই ‘বেল্টে’র সবচেয়ে বড় সদস্য।
আসল মজাটা শুরু হল যখন সুইৎজারল্যান্ডের জেনেভা অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র সৌরজগতের বাইরে অন্য একটি তারা, ‘৫১ পেগাসি’র চার পাশে ঘুরতে থাকা একটি বিশাল গ্রহ আবিষ্কার করে ফেললেন। ওই গ্রহটি সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতির চেয়ে প্রায় দশ গুণ ভারী। এর কয়েক বছরের মধ্যেই এই ধরনের আরও অনেক ভিন গ্রহ আবিষ্কার হয়ে গেল। আর এর ফলে জোর বিতর্ক উঠল প্লুটোকে নিয়ে। প্লুটো তো তা হলে অন্য গ্রহদের মতো বলে মনে হচ্ছে না।সূর্যের চার পাশে ঘুরলেই যদি গ্রহ হয়, তা হলে ‘সেরেস’, ‘পল্লাশ’, ‘জুনো’ বা ‘ভেস্টা’কেও তো ‘গ্রহ’ বলা উচিত! প্রায় এক শতাব্দী আগে, এই গ্রহাণুগুলিকে নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছিল, ঠিক সেই ধরনের বিতর্ক শুরু হল প্লুটোকে নিয়ে।
কিন্তু প্লুটোর সময়টা সত্যিই খারাপ চলছিল। এক দিকে যখন প্লুটোকে কটাক্ষ করে একটার পর একটা বৃহস্পতির চেয়ে দশ থেকে বারো গুণ ভারী ভিন গ্রহ আবিষ্কার হয়ে চলেছে, সেই সময়, ২০০৩ সালের ২১ অক্টোবর, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলোজির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন ওই ‘কুইপার বেল্টে’র সীমানার মধ্যে প্লুটোর চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি ভারী একটি গ্রহের আবিষ্কার করে ফেললেন। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারটির ঘোষণা কিন্তু করা হল প্রায় এক বছর পর, ২০০৫ সালের ৫ই জানুয়ারিতে।
যদিও এই নতুন আবিষ্কৃত গ্রহটির পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছিল- ‘2003-UBU-313’, ব্রাউন প্রথমে এই গ্রহটির নাম দিয়েছিলেন ‘লীলা’, তাঁর সদ্যোজাত কন্যার নামে।কিন্তু সমালোচনার ভয়ে, কয়েক দিনের মধ্যেই নামটি পালটে নতুন নাম দেওয়া হয় বহুল- প্রচারিত টেলিভিশন সিরিয়াল “ওয়ারিওর জেনা”র নায়িকা জেনার নামে। আর এই ভাবে প্লুটোর এই প্রতিবেশীর নাম হয় ‘জেনা’। কিন্তু গ্রহ বা গ্রহাণু বা উপগ্রহদের নামকরণের একটি নির্দিষ্ট রীতি রয়েছে। যা নির্ধারণ করে জ্যোতির্বিজ্ঞ্রানীদের সিনেট বা পারলিয়ামেন্ট ‘আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মণ্ডল’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল ইউনিয়ন’। ২০০৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ওই গ্রহটির নাম দেওয়া হয় ‘এরিস’। কিন্তু তত দিনে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান মণ্ডলের ২৬তম সম্মেলন শেষ হয়েছে। আর সেই সম্মেলনের শেষ দিনে, ২৪ আগস্ট, ২০০৬ সালে ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে ‘প্লুটো’ বা ‘জেনা’ কেউই ‘গ্রহ’ নয়। তাদের বলা হবে ‘বামন গ্রহ’ (Dwarf Planet)। বেচারা ‘জেনা’ একটুর জন্যে দশম গ্রহ হওয়ার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিতা হল! আর প্লুটোও হয়ে গেল ‘বামন গ্রহ’। ফলে সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা নয় থেকে আট হয়ে গেল। ইতিমধ্যেই অবশ্য ওই ‘কুইপার বেল্টে’র মধ্যে আরও দু’টি ‘বামন গ্রহে’র সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তারা হল ‘হাউমিয়া’ আর ‘মেকমেক’। ‘এরিসে’র একটি উপগ্রহ ‘ডিস্মোনিয়া’রও সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। ‘সেরেস’, ‘প্লুটো’, ‘এরিস’, ‘হাউমিয়া’ এবং ‘মেকমেক’, এই পাঁচটি এখনও পর্যন্ত স্বীকৃত ‘বামন গ্রহ’। এর মধ্যে ‘সেরেস’ ছাড়া বাকি সবাই ‘কুইপার বেল্টে’র সম্মানিত সদস্য। ভবিষ্যতে ‘কুইপার বেল্টে’ এই ধরনের আরও অনেক ‘বামন গ্রহে’র সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। তাই ‘প্লুটো’ বা ‘এরিস’কে যদি ‘গ্রহ’ হিসাবে ধরা হত, তা হলে ভবিষ্যতে সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা কত হত, তা বোধ হয় শুধু সূর্যদেবই জানেন!
এটা তো গেল ‘কুইপার বেল্টে’ প্লুটোর সাঙ্গপাঙ্গদের কথা, যাদের এখন আমরা ‘কুইপার বেল্ট অবজেক্ট’ বলি। ‘এরিস’ আবিস্কৃত হওয়ার কয়েক মাস পরেই, ২০০৩ সালের ১৪ নভেম্বর সেই মাইক ব্রাউন আর তাঁর দল ‘কুইপার বেল্টে’র সীমানা ছাড়িয়ে থাকা আরেকটি ‘বামন গ্রহে’র মতোই একটি মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কার করলেন। এই গ্রহটির আবিষ্কারের কথা কিন্তু ‘এরিস’ আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করার আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়, ২০০৪ সালের প্রথম সপ্তাহে। চার দিকে হই চই পড়ে যায় ওই আবিষ্কারের কথা শুনে। তার মানে সূর্যের সংসারে গ্রহদের রাজত্ব ‘কুইপার বেল্টে’র মধ্যেই সীমিত নয়। ‘কুইপার বেল্ট’ ছাড়িয়েও ‘গ্রহ’ বা ‘বামন গ্রহ’ বা ‘গ্রহাণু’রা রয়েছে। ‘কুইপার বেল্টে’র সীমানা ছাড়িয়ে সূর্যকে প্রদক্ষিণরত এই বস্তুটির নাম দেওয়া হল- ‘সেডনা’।
প্রায় আট বছর পর ‘কুইপার বেল্টে’র ও পারে আবিস্কৃত হল আরেকটি ‘বামন গ্রহে’র মতো বস্তুর। সেটির পোশাকি নাম- ‘2012 VP 113’। ওই ‘অবজেক্ট’টির আবিষ্কারের ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালে। সেই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বিডেন। আর তাই আদর করে ওই বামন গ্রহটিকে ‘বিডেন’ বলে ডাকা হয়। এর পর আরও কয়েকটি এই ধরনের ‘অবজেক্ট’ আবিষ্কার হয়েছে। ভবিষ্যতে ‘কুইপার বেল্টে’র সীমানার বাইরে আরও অনেকেই আবিষ্কারের অপেক্ষায়।কিন্তু ‘সেডনা’ ও ‘বিডেন’ সহ এই বস্তুগুলি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত সে রকম কোনও তথ্য না পাওয়ায়, এদের এখনও ‘বামন গ্রহ’ বলে গণ্য করা হয়নি। কাজেই সৌরজগতে গ্রহের সংখ্যা এখনও সেই আট।
কিন্তু নেপচুন আবিষ্কারের পর এই গ্রহটির কক্ষপথে বেশ কিছুটা গরমিল ধরা পড়েছিল, ঠিক যেমন নেপচুন আবিষ্কারের আগে ইউরেনাসের কক্ষপথ আর গতিবিধিতে গরমিল ছিল। তাই আবার একটি বড় গ্রহ রয়েছে বলে ভাবা হল। আর সেই কাল্পনিক গ্রহটির নাম দেওয়া হল- ‘প্ল্যানেট-এক্স’। প্লুটোর যা ভর, তাতে নেপচুনের গতিবিধির গরমিলটা মেলানো যায় না। ঝামেলা আরও বাড়ল, যখন প্লুটো আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ ‘বামন গ্রহ’দেরও গতিবিধিতে গরমিল পাওয়া গেল।
এ বার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে সন্দেহ জাগলো!
তা হলে কি ‘কুইপার বেল্টে’র ও পারে বড়সড় কিছু রয়েছে?
কিছু বিজ্ঞানী অনুমান করলেন, এক ‘বাদামি বামনে’র (Brown Dwarf) উপস্থিতি। কিন্তু তা হলে তো তা গ্রহদের ভাই নয়! এ যে খোদ সূর্যের ‘যমজ ভাই’! কারণ ‘বাদামি বামন’ বা ‘ব্রাউন ডোয়ার্ফ’রা তারাদের মতোই জন্মায়, যে ভাবে সূর্যের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু ভর কম হওয়ায় তাদের ভেতরে পারমাণবিক শক্তিটা তৈরি হতে পারে না। আর তার ফলে এই ‘বাদামি বামন’রা খুবই ঠাণ্ডা আর অনুজ্জ্বল। সেই ‘বাদামি বামনে’র খোঁজে নাসা কাজে লাগালো ‘ওয়াইড-ফিল্ড ইনফ্রারেড সার্ভে এক্সপ্লোরার’ বা ‘ওয়াইস’ নামের একটি স্পেস টেলিস্কোপকে। চার দিক ভাল করে খোঁজাখুঁজির পর ‘ওয়াইস’ জানালো, শনির চেয়ে ভারী কোনও কিছু সৌরজগতের শেষ প্রান্তে নেই বা থাকতে পারে না। ‘বাদামি বামন’দের ভর বৃহস্পতির ভরের অন্তত ১৩ গুণ। কাজেই নবম গ্রহ বা ‘প্ল্যানেট-এক্সে’র অস্তিত্বেরই সম্ভাবনা বাড়ল। ‘এরিস’ আর ‘সেডনা’র আবিষ্কর্তা মাইকেল ব্রাউন দেখলেন ‘কুইপার বেল্ট’ পেরিয়ে ‘সেডনা’, ‘বিডেনে’র মতো বস্তুগুলি সূর্যের চার পাশে একই তলে প্রদক্ষিণ করছে। এ ছাড়া তিনি ও তাঁর দল দেখলেন, ওই সব ‘বামন গ্রহে’র মতো বস্তুগুলোর কক্ষপথ কোনও একটা খুব ভারী বস্তুর টানে একই দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। কমপিউটারে হিসেব করে দেখা গেল, ৬টি বামন গ্রহের মতো বস্তুর কক্ষপথ আর গতিবিধি ব্যাখ্যা করা যায়, যদি ‘কুইপার বেল্টে’র থেকে অনেক দূরে পৃথিবীর চেয়ে ভারী কিন্তু নেপচুনের চেয়ে হাল্কা একটি গ্রহ থাকে। এই ধরণের গ্রহকে বলা হয় অতি-পৃথিবী বা ‘সুপার আর্থ’। সৌরজগতের আর কোনও গ্রহ ওই ধরনের না হলেও, অন্য অনেক নক্ষত্রের চার পাশে এই ধরনের অনেক ‘অতি-পৃথিবী’র সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
খুব সম্প্রতি মাইকেল ব্রাউনের এই তথ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মহলে সাড়া জাগিয়েছে। শুরু হয়েছে সেই ‘গ্রহে’র সন্ধান। কিন্তু অত দূরে অত ম্লান একটি গ্রহের সন্ধান পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আশা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’ (জেডব্লিউএসটি) নিশ্চিত ভাবেই এই গ্রহটির অস্তিত্ব প্রমাণ করবে। সত্যি সত্যি পৃথিবীর চেয়ে কয়েক গুণ ভারী কোনও ‘গ্রহে’র যদি আবিষ্কার হয়, তা হলে সেটি ‘গ্রহ’ না ‘বামন গ্রহ’- সেই বিতর্কের অবসান ঘটাবে। আমরা আবার ফিরে পাব ‘ন’য়ে নবগ্রহ’!
আর সেটাই হবে সৌরজগতে গ্রহদের চূড়ান্ত সংখ্যা!
আর সাপলুডো খেলতে হবে না এই সৌরমণ্ডলের গ্রহদের!
ছবি-নাসা।