একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ সূর্যে। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
কাবুল নয়। লাহৌর-করাচিও নয়। একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে এ বার কেঁপে উঠল সূর্য। আচমকা।
যার কোনও পূর্বাভাস ছিল না। বিস্ফোরণে তোলপাড় হয়ে গেল সূর্যের বায়ুমণ্ডল বা করোনায়। সুনামির সময় যেমন সমুদ্রের জল পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছড়ে পড়ে লাগোয়া এলাকায়, জলের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় উপকূলবর্তী এলাকাগুলিকে, তেমনই এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে আলোড়িত হল সূর্যের বায়ুমণ্ডলের কয়েকটি এলাকা।
সূর্যে যে এমন ঘটনা ঘটে, আচমকা একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয় তার কেন্দ্রের পরমাণু চুল্লি থেকে প্রায় পৌনে কোটি কিলোমিটার দূরে থাকা করোনায় তা এর আগে বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। এই প্রথম সেই ঘটনা যে শুধুই জানা গেল তাই নয়; তা প্রথম চাক্ষুষ করলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরাই। নাসার ‘সোলার ডায়নামিক্স অবজারভেটরি (এসডিও)’-র পাঠানো তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেই এই করোনায় সাম্প্রতিক বিস্ফোরণের খবর মিলেছে।
নজরকাড়া আবিষ্কার ভারতীয়দের: অভিষেক শ্রীবাস্তব (বাঁ দিক থেকে), সুধীর মিশ্র, তন্ময় সামন্ত ও দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। উপরে, গবেষণাপত্র
যার মূল গবেষক বারাণসীর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আইআইটি)’-র অধ্যাপক অভিষেক শ্রীবাস্তব। গবেষকদলে রয়েছেন দুই বাঙালি। এক জন নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ অবজারভেশনাল সায়েন্স (এরিস)’-এর অধিকর্তা সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ছাত্র তন্ময় সামন্ত। গবেষণাপত্রটি মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ।
কী দেখেছেন বিজ্ঞানীরা? দেখুন নাসার ভিডিয়োয়
কী দেখেছেন বিজ্ঞানীরা?
সহযোগী গবেষক দীপঙ্কর বললেন, ‘‘সূর্যের বায়ুমণ্ডলে চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি সুবিশাল মেঘকে আমরা আচমকা ভেঙে পড়তে দেখেছি। আর সেই মেঘটা ভেঙে পড়েছে খুব কাছে থাকা কয়েকটি চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর। তাতে যে সেই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি শুধুই ঝনঝন করে কেঁপে উঠেছে তাই নয়, সেই চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিকে পুরোপুরি ধ্বংসও করে দিয়েছে সেই ভেঙে পড়া মেঘ। আশপাশের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ফলে জন্ম নিয়েছে বিপুল পরিমাণ শক্তির। যা তোলপাড় করে দিয়েছে করোনার ওই অঞ্চল।’’
ভারতীয়দের অভিনবত্ব কোথায়?
মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ (আইসার-কলকাতা)-এর অধ্যাপক বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী জানাচ্ছেন, এই ঘটনা একেবারেই অভূতপূর্ব। এমন আচমকা একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে সূর্যের বায়ুমণ্ডলে, এটা বিজ্ঞানীদের আগে জানা ছিল না। ১৫ বছর আগে যদিও তাত্ত্বিক ভাবে এমন সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল, তা এর আগে কিন্তু বিশ্বের কোথাও কেউই চাক্ষুষ করতে পারেননি। যা দেখতে পেলেন প্রথম ভারতীয়রাই। আর সেই গবেষকদলে রয়েছেন দুই বাঙালিও।
সূর্যের বায়ুমণ্ডলে কেন ঘটে এমন আচমকা বিস্ফোরণ?
দীপঙ্কর ও দিব্যেন্দু দু’জনেই বলছেন, ‘‘এর নিশ্চিত কারণ এখনও জানা সম্ভব হয়নি। কারণ, তা জানতে, বুঝতে গেলে এমন আরও বহু ঘটনা চাক্ষুষ করার প্রয়োজন। সবে একটা ঘটনা দেখা গিয়েছে। আরও দেখতে হবে। কেন আচমকা করোনার উপরের স্তরে চৌম্বক ক্ষেত্রের সুবিশাল মেঘের একটি অংশ ভেঙে পড়ে ওই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটায়, কী ভাবেই বা তা আশপাশের চৌম্বক ক্ষেত্রগুলিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়ে ওই বিপুল পরিমাণ শক্তির জন্ম হয়, তা এখনও বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, সূর্যের পিঠ বা ফোটোস্ফিয়ারের চেয়ে দুম করে কেন প্রায় ১০ লক্ষ গুণ বেড়ে যায় করোনার তাপমাত্রা, তা বুঝতে এই ঘটনা হয়তো সাহায্য করবে আমাদের।’’
কোন ঘটনা অবাক করে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের?
মূল গবেষক অভিষেক শ্রীবাস্তব ও তাঁর ছাত্র সুধীর কে মিশ্র জানাচ্ছেন, করোনার ওই অংশে অমন ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পরিবেশ না থাকা সত্ত্বেও আমরা আচমকা সেকানে একের পর এক ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটতে দেখেছি। এও দেখেছি, সেই একের পর এক বিস্ফোরণগুলি ঘটেছে খুব দ্রুত। যেন একটা বোমার স্প্লিন্টার ছিটকে গিয়ে কাছেই থাকা আর একটা শক্তিশালী বোমা ফাটিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে আর একটা ফাটছে। তার পর আরও একটা...। এটা সত্যি সত্যিই এক অভাবনীয় ঘটনা।
ছবি সৌজন্যে: অধ্যাপক অভিষেক শ্রীবাস্তব
ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস