মানব-মস্তিষ্কের আধুনিকতার দিকে বিবর্তন সম্ভব হয়েছে অন্য বড় প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ায়। ফাইল চিত্র।
অক হল পেঙ্গুইনের মতো দেখতে হাঁসের আকারের সামুদ্রিক পাখি। প্রায় ৫০০ অক পাখির পালক সামুদ্রিক সিলের পেটের চর্বির মধ্যে পুরে আঁটসাঁট সেলাই করে, ভারী পাথরের তলায় ছ’মাস রেখে সম্পূর্ণ হয় গাঁজানো বা ফারমেন্টেশন পদ্ধতি। তৈরি হয় কিভিয়াক, উত্তর কানাডার আদি বাসিন্দা ইনকুটদের পরম্পরাগত বাহারি আহার। কিভিয়াকের স্বাদ উমামি। আমাদের জিব মোট পাঁচ রকমের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে— মিষ্টি, টক, নোনতা, তেতো আর উমামি। কী এই উমামি স্বাদ? জাপানিরা এই স্বাদকে ব্যাখ্যা করেন সুস্বাদু কোনও কিছুর আবেশ বোঝাতে। তা তেতো হতে পারে, মিষ্টিও হতে পারে, আবার টকও হতে পারে। তবে এই স্বাদের অনুভূতি তখন থেকেই শুরু, যখন মানুষ ফারমেন্টেড খাবার খাওয়া শুরু করে। কী ভাবে? প্রায় এক কোটি বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষ গাছ থেকে নেমে নীচে পড়ে থাকা পাকা ও পচন ধরা ফল খেতে শুরু করে। পচা ফল থেকে উৎপন্ন অ্যালকোহলকে বাগে আনার জন্য শরীরে এডিএইচ৪ জিনের প্রকাশ প্রবল হয়। নিয়ান্ডারথালরাও খাবারকে গেঁজিয়ে খাওয়া রপ্ত করেছিল। তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি থাকত আর হজমেরও সুবিধে হত। মাইক্রোবসের উপস্থিতি খাবারের স্বাদকে উমামি করে তোলে। আনাজের মধ্যে টমেটোর স্বাদও উমামি। বেশির ভাগ ক্যালরি যুক্ত খাবারের স্বাদ হয় মিষ্টি, নয়তো নোনতা। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার, ভিনিগারের স্বাদ টক। এই স্বাদ অনুভূতির পুরোটাই জিনের খেলা। তেতো স্বাদের জন্য আমাদের রয়েছে ২৫টি, ইঁদুরের ৩৭টি, কুকুরের ১৬টি জিন। শুধু তা-ই নয়, আরও ১১টি জিন আমরা বিবর্তনে হারিয়েছি, তার মধ্যে দু’টি নিয়ান্ডারথাল ও আধুনিক মানুষের বিচ্ছেদের কিছুটা আগে। তেতো স্বাদের জন্য এত সতর্কতা কেন? বিষাক্ত খাবারের বেশির ভাগ স্বাদই যে তেতো। তেতোর বিশ্লেষণে তাই এতগুলো জিন। মানব বিবর্তনে আগুন জ্বলার সঙ্গেই খাদ্য গ্রহণে আমূল পরিবর্তন এসেছিল, বদলে গিয়েছিল পরিপাক পদ্ধতিও। ধীরে ধীরে প্রয়োজন ফুরিয়েছিল তেতো স্বাদের বিশ্লেষণের। বিবর্তনের প্রয়োজনে নতুন জিনের সমাহারও যেমন হয়েছে, হারিয়েছে অনেক জিন।
সকল মেরুদণ্ডী প্রাণীর স্বাদের বৈচিত্র মূলত টি১আর শ্রেণির তিনটি জিনের উপর নির্ভরশীল। প্রায় ৪০ কোটি বছর আগে জিনগুলি প্রকাশ পেতে শুরু করে। মিষ্টি, টক, উমামি স্বাদের জন্য দু’টি করে জিনের প্রয়োজন হলেও তেতোর অনুভূতির জন্য একটিই যথেষ্ট। টি১আর১ আর টি১আর৩ মিলে উমামি, আর টি১আর১, টি১আর২-এর যুগলবন্দি মিষ্টির অনুভূতি নিয়ে আসে। বিবর্তনে খাদ্যবৈচিত্র স্বাদ বিকাশের প্রধান কারিগর। প্রাণীরা রকমারি নতুন খাবারের আস্বাদ পেয়েছিল আর সময়ের সঙ্গে ঠেকে শিখেছিল খাদ্য, অখাদ্যের পার্থক্য। বিড়ালের টি১আর২ মিষ্টি অনুভূতির জিনটির কার্যকারিতা হারিয়েছে, ভাঙাচোরা জিনটি আজ জিনোমে সিউডোজিনে পরিণত হয়েছে। সিউডোজিন হল ছদ্ম জিন, যা পূর্বের কার্যকারিতা হারিয়ে জিনোমেই রয়ে গিয়েছে। পাখিদের ক্ষেত্রে মিষ্টি অনুভূতির জিনটির জিনোমে কোনও অস্তিত্বই নেই। ডাইনোসরের যুগে উড়ে বেড়ানো কোনও এক পাখির দেহে মিউটেশনের ফলে মিষ্টি জিনটি মুছে যেতে শুরু করে। বর্তমানে বেশির ভাগ পাখির পছন্দের খাদ্য তালিকায় পোকামাকড়-সহ বিভিন্ন ধরনের ফলের বীজ থাকে।
সমস্যাটা হামিংবার্ডের বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ছোট্ট পাখিগুলির পছন্দ মিষ্টি মধু। কিন্তু তাদের জিনোমে মিষ্টি অনুভূতির জিন অনুপস্থিত। পাখিগুলোর জিন মানচিত্র খুলে দেখা গেল, উমামি জিনে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে তারা পুনরায় মিষ্টির অনুভূতি পেতে শুরু করেছিল। পতঙ্গভুক পাখি থেকে যখন হামিংবার্ডের পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়, ঠিক সেই সময়ে মিউটেশনের ফলে তাদের মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে ও মধুর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রকৃতির দ্বারা নির্বাচিত সেই মিউটেশন আজও হামিংবার্ড-সহ অনেক মধুপিয়াসি পাখির ক্ষেত্রে দেখা যায়।
তবে হামিংবার্ডের মিষ্টির অনুভূতি অবশ্যই আমাদের মতো নয়। তারা কৃত্রিম মিষ্টত্ব বা অ্যাসপার্টেম পছন্দ করে না, যা আমরা করে থাকি। আমেরিকার অতিকায় ঠোঁটধারী রঙিন ফলাহারী পাখি টুকান। তাদের মিষ্টির প্রতি আকর্ষণের কারণ এখনও ধোঁয়াশা। বিবর্তনের ধারায় জিন কার্যক্ষম হয়েছে, আবার কার্যকারিতা হারিয়েওছে। হারানো জিনও নিয়ে এসেছে নতুন প্রাপ্তিযোগ।
শুধুমাত্র স্বাদ নয়, জিনের হারানো ও প্রাপ্তির উপর নির্ভরশীল মানব-মস্তিষ্কের বিবর্তনও। এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তেল আভিভ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অধ্যাপক মিকি বেন ডোর ও রান বারফাই চমকে দেওয়ার মতো একটা বিবর্তনের তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। মানব-মস্তিষ্কের আকার ও আয়তন বৃদ্ধির কারণ নাকি বিশালাকৃতি প্রাণীগুলোর লুপ্ত হয়ে যাওয়া। প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে হোমো গণের উৎপত্তির সময় মানব-মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৬৫০ কিউবিক সেন্টিমিটার (সিসি), যা এখন বেড়ে প্রায় ১৩০০ সিসি। সেই সময়ে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর গড় ওজন ছিল ২০০ কিলোগ্রাম। হোমো গণের আবির্ভাবের সঙ্গেই বৃহদাকার প্রাণীগুলো শিকারে বিলুপ্ত হয়। খাদ্যের প্রয়োজনে কৌশলী পূর্বপুরুষেরা ছোট প্রাণীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ছোট প্রাণীগুলোকে শিকারের সেই তাগিদ থেকেই মানব-মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি শুরু হয়েছিল, যা আজ প্রায় দ্বিগুণ।
মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এএসপিএম জিন সক্রিয় হয়। ফক্স পি টু জিনের প্রভাবে শুরু হয় ভাষার প্রকাশ। সেই সঙ্গে একাধিক জিনের প্রকাশ শুরু হওয়ায় মস্তিষ্ক ও মাংসপেশির মেলবন্ধন ঘটে। বিবর্তনের এই ধাপে সাধারণ যন্ত্রপাতি, অস্ত্র বানাতে শুরু করে মানুষ। সঙ্গে শুরু হয় মানব-রক্তে ক্ষতিকর মুক্ত মৌলের নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া।
জিনের হারানো ও নতুন জিনের আবির্ভাবে বদলে গিয়েছে রক্তেরও উপাদান। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল রক্তে মুক্ত মৌলের নিষ্ক্রিয়করণ। মানব-রক্তে মুক্ত মৌলের প্রধান নিয়ন্ত্রক হল ইউরিক অ্যাসিড। ইউওএক্স জিনের অনুপস্থিতির কারণে এপ বা বাঁদর শ্রেণির প্রাণীদের রক্তে ইউরিয়ার পরিমাণ বাঘ, সিংহদের থেকে তিন থেকে দশ গুণ বেশি। ইউওএক্স জিন ইউরিকেস নামক উৎসেচক সংশ্লেষ করে, যা ইউরিয়া বিপাকে প্রয়োজনীয়। মানুষে অনুপস্থিত ইউরিকেস সক্রিয় থাকলে হয়তো বয়সজনিত গাঁটের বাত থেকে মুক্তি মিলত। ২০১৪ সালে জেমস ক্রটজ়ার অ্যানসেস্ট্রাল জিনোম রিকনস্ট্রাকশন-এর মাধ্যমে দেখালেন, প্রায় ন’কোটি বছর আগে এই জিন পূর্ণরূপে কার্যক্ষম ছিল। কিন্তু চার কোটি বছর আগে হঠাৎ এক মিউটেশনের ফলে জিনের কার্যক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। প্রায় দেড় কোটি বছর আগে, অলিগোসিন যুগ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউরিকেস জিন সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সেই সময় পৃথিবীতে শুরু হয় ভয়ঙ্কর তুষার যুগ, সাঙ্ঘাতিক ভাবে কমতে শুরু করে খাবারের জোগান। গবেষণায় জানা যায়, শরীরে অধিক ইউরিয়া থাকলে সুগার থেকে ফ্যাটে রূপান্তর সহজেই হয়। সঞ্চিত ফ্যাট এক দিকে প্রাণীগুলোকে ঠান্ডার সঙ্গে লড়তে সাহায্য করে, অপর দিকে বিকল্প পথে ক্যালরি জোগান দেয়। প্রকৃতির চাহিদা মেনেই এই পরিবর্তন স্থায়ী ভাবে নির্বাচিত হয়েছিল। শুধু ইউরিয়াই নয়, মানব-রক্তে ক্ষতিকর মুক্ত মৌলকে, (যা বয়সের সঙ্গে সঞ্চিত হলে কোষের মৃত্যু হয়) নিষ্ক্রিয় করার জন্য রয়েছে ভিটামিন সি। যদিও ভিটামিন সি সংশ্লেষের প্রয়োজনীয় জিনটিও হারিয়ে গিয়েছে।
অ্যাসকরবিক অ্যাসিডের ডাকনাম ভিটামিন সি। গ্লুকোজ় থেকে চারটি ধাপে সংশ্লেষিত হয় অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, শেষ ধাপে প্রয়োজন ‘গুলো’ নামে একটি উৎসেচকের। গাছেদের এই উৎসেচক সক্রিয় থাকলেও, মানুষের নেই। আমরা ভিটামিন সি তৈরি করতে পারি না। শুধু আমরা কেন, সমস্ত ড্রাই নোজ় প্রাইমেট-সহ গিনিপিগ, এমনকি বাদুড়ও উৎসেচকের অভাবে ভিটামিন সি তৈরি করতে পারে না। সংগ্রহ করতে হয় প্রকৃতি থেকে। জলে দ্রবণীয় ভিটামিন সি শরীর সঞ্চয় করে রাখতে অক্ষম, অতিরিক্ত ভিটামিন শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। ভিটামিন সি-র অভাবে স্কার্ভি নামে এক মারাত্মক রোগের আগমন হয়। বিবর্তনের শুরুতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এই জিনটি প্রায় সকল পর্বের প্রাণীর দেহে সক্রিয় ছিল। সম্ভবত ছ’কোটি বছর আগে কোনও এক সময় মিউটেশনের ফলে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই জিন হঠাৎই হারিয়ে ফেলেছিল। প্যালিয়োসিন যুগে স্তন্যপায়ী প্রাণীরা লেবুজাতীয় ফলের মাধ্যমে ভিটামিন সি-র অভাব পূরণ করেছিল। তবে এই জিন হারিয়ে মানুষ কি সত্যিই ক্ষতিগ্রস্ত? গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভিটামিন-সি সংশ্লেষের সময় তৈরি হয় হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, যা ভেঙে মুক্ত ইলেকট্রন কোষের প্রোটিন-সহ ডিএনএ-কে সাঙ্ঘাতিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অর্থাৎ, ভিটামিন সি তৈরি করতে পারলেও তার মূল্য চোকাতে হত।
বিবর্তনের পথে শুধু নতুন জিন নয়, হারিয়ে যাওয়া জিনগুলোও আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।