ব্ল্যাক হোল। -প্রতীকী ছবি।
জন্মসূত্রে ভারতীয় নোবেল পুরস্কার জয়ী এক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীকে জিতিয়ে দিল একটি দানবাকৃতি রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল! যার মাথা, শরীরের গোটাটাই ঢাকা রয়েছে খুব পুরু গ্যাসের মেঘে। যেন ‘কম্বল’! ৫৫ বছর পর। যার জন্ম হয়েছিল একেবারেই শিশু ব্রহ্মাণ্ডে। এত দূরে থাকা কম্বলমুড়ি দেওয়া দানবাকৃতি রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল এর আগে আর ধরা পড়েনি আমাদের চোখে।
সেই ‘দুধের শৈশবে’ও এই ব্রহ্মাণ্ডে তা হলে খাই খাই স্বভাবের দানবাকৃতি (সুপার ম্যাসিভ) রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর ছিল? যাদের ভর ছিল সূর্যের কয়েকশো কোটি গুণ! আর সেই অসম্ভব পেটুক দানবাকৃতি ব্ল্যাক হোলগুলির রাক্ষুসে খিদে খুব দ্রুত মেটানোর জন্য ছিল পর্যাপ্ত খাবারদাবারও? ছিল ঘন গ্যাসের জমাট বাঁধা মেঘ? সেই গ্যাসের মেঘেরই কম্বলমুড়ি দিয়ে আমাদের থেকে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছে ব্ল্যাক হোলগুলি!
এমনটা যে হতে পারে, গাণিতিক ভাবে তা প্রথম দেখিয়েছিলেন জন্মসূত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর। ১৯৬৪ সালে। তাঁর ‘থিয়োরি অফ স্ফেরিক্যালি কোল্যাপ্স গ্র্যাভিটেশনাল ইনস্টেবিলিটি’তে। ব্রিটিশ শাসনে থাকা ভারতে চন্দ্রশেখরের জন্ম হয় তামিলনাড়ুতে। পরে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব নেন।
ওই সময় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ চন্দ্রশেখর লিখেছিলেন, ‘‘স্ফেরিক্যালি কোল্যাপ্স গ্র্যাভিটেশনাল ইনস্টেবিলিটি মাস্ট ডেভেলপ অ্যান্ড ব্ল্যাক হোল ফর্মড ওয়েল বিফোর দ্য গ্যাস ক্যান মেক অ্যান ইকুইলিব্রিয়াম কনফিগারেশন।’’
ধরা দিল ভারতীয় বিজ্ঞানীর নামের উপগ্রহের চোখে!
নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরিতে এক্স-রে ও রেডিও তরঙ্গে ধরা পড়া সেই আদিম ব্রহ্মাণ্ডের ব্ল্যাক হোলের ছবি
কিন্তু গত পাঁচ দশক ধরে হাতেকলমে তার প্রমাণ মেলেনি। ব্ল্যাক হোলের ওই খাই খাই অবস্থা থেকে আলো বাইরে প্রায় বেরিয়ে আসতে পারে না বলে। এলেও, তা এত নগণ্য পরিমাণে বেরিয়ে আসে যে, তাকে দেখার মতো প্রযুক্তিই ছিল না আমাদের হাতে। এ বার মহাকাশে থাকা নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরির ‘চোখে’ ধরা পড়ল তেমনই একটি দানবাকৃতি (সুপারম্যাসিভ) রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল। এই প্রথম। যে অবজারভেটরির নামকরণ করা হয়েছিল ওই ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর নামেই। ব্ল্যাক হোলটির নাম- ‘পিএসও-১৬৭-১৩’।
আরও পড়ুন- মহাকাশে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ, ৩ দিন ধরে দেখা গেল আলোর ছটা!
আরও পড়ুন- সত্যিই টেলিস্কোপে ধরা দিল ব্ল্যাক হোল? বিজ্ঞানী মহলে উত্তেজনা তুঙ্গে
প্রায় ১৪০০ কোটি বছরের এই ব্রহ্মাণ্ডের বয়স তখন সবে ৮৫ কোটি বছর। আক্ষরিক অর্থেই, ব্রহ্মাণ্ড তখন ‘দুধের শিশু’। আকারেও ব্রহ্মাণ্ড তখন আজকের তুলনায় নস্যি! এখন তা অতলান্তিক মহাসাগর হলে, চেহারায় ব্রহ্মাণ্ড তখন বড়জোর বাড়ির একটা চৌবাচ্চা!
জন্মসূত্রে ভারতীয় নোবেলজয়ী জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর
রীতিমতো অবাক করে দেওয়া ওই আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি দিনকয়েকের মধ্যেই প্রকাশিত হতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এ। মূল গবেষক ফাবিও ভিতো চিলির সান্তিয়াগোর পন্টিফিসিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গবেষকদলে রয়েছেন অনাবাসী ভারতীয় বিজ্ঞানী আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নীলেশ শেষাদ্রি।
ব্রহ্মাণ্ডের সেই দূরতম ব্ল্যাক হোল: দেখুন ভিডিয়ো
কী দেখেছেন গবেষকরা?
‘আনন্দবাজার ডিজিটালে’র পাঠানো প্রশ্নের জবাবে নীলেশ ই-মেলে জানিয়েছেন, টানা ১৬ ঘণ্টা ধরে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে তাঁরা দূরতম ব্রহ্মাণ্ডে থাকা ওই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলটি থেকে মাত্র তিনটি ফোটন (আলোর কণা) কণা বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। যেগুলি আসলে অত্যন্ত শক্তিশালী এক্স-রে। তুলনায় দুর্বল এক্স-রেগুলিকে এখনও পর্যন্ত দেখা সম্ভব হয়নি। কারণ, ওই দানবাকৃতি, অসম্ভব পেটুক ব্ল্যাক হোলটির চার পাশ ঘিরে থাকা জমাট বাঁধা গ্যাসের মেঘই তাদের শুষে নিচ্ছে। দুর্বল এক্স-রেগুলিকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দিচ্ছে না। আলো বেরিয়ে আসতে পারছে না বলে সহজে আমাদের চোখেও পড়তে পারছে না ব্রহ্মাণ্ডের দুধের শৈশবের সেই সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলি।
নাসার চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি
ব্ল্যাক হোলের আশপাশে বাধ্য, অবাধ্যরা!
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা, দেশের বিশিষ্ট ব্ল্যাক হোল বিশেষজ্ঞ সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, এটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। ৫৫ বছর আগে ভারতীয় বিজ্ঞানী চন্দ্রশেখরই প্রথম গাণিতিক ভাবে দেখিয়েছিলেন, আদিম ব্রহ্মাণ্ডে এই ভাবেই তৈরি হতে পারে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলগুলি। কারণ, তাদের আশপাশে থাকা কণা ও পদার্থগুলি দু’ধরনের হয়। বাধ্য ও অবাধ্য। যারা বাধ্য, তাদের কোনও কৌণিক ভরবেগ (অ্যাঙ্গুলার মোমেন্টাম) থাকে না। তারা ব্ল্যাক হোলকে প্রদক্ষিণ করারও সময় পায় না। একেবারে টুপ করে এসে পড়ে ব্ল্যাক হোলের পেটে। সেই ভাবেই মাত্র এক হাজার সেকেন্ডের মধ্যে তৈরি হয়ে যেতে পারে একটি সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল। আর ব্ল্যাক হোলের আশপাশে যে সব কণা ও পদার্থের কৌণিক ভরবেগ থাকে, তারা কিছুটা অবাধ্য হয়। ব্ল্যাক হোলের অসম্ভব জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে টুপ করে তার মুখে এসে পড়ে না। পড়তে অনেকটাই বেশি সময় নেয়।চন্দ্রশেখরই প্রথম তাত্ত্বিক ভাবে দেখিয়েছিলেন, আশপাশে থাকা বাধ্য কণারা এই ভাবেই আদিম ব্রহ্মাণ্ডে গড়ে তুলেছে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল।
কেন প্রমাণ মেলেনি এত দিন?
সন্দীপের কথায়, ‘‘ওই ব্ল্যাক হোলগুলির চার পাশে থাকা অত্যন্ত ঘন জমাট বাঁধা গ্যাসের মেঘের জন্যই সেটা সম্ভব হয়নি। ওই মেঘের ভিতরের দিকটার কণা ও পদার্থরা তত ক্ষণে রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের পেটে ঢুকে গিয়েছে। পড়ার সময় যে বিকিরণ হচ্ছে, সেটাও শুষে খেয়ে ফেলছে ব্ল্যাক হোল। বাকি বিকিরণটুকু উপরে থাকা অত্যন্ত ঘন গ্যাসের মেঘ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে পারছে না। এমনকী, বেরিয়ে আসতে পারছে না কম শক্তিশালী এক্স-রেও। এ বারও যে দেখা গিয়েছে, তাকে সৌভাগ্যই বলতে হবে। কারণ, ১৬ ঘণ্টা ধরে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে হদিশ মিলেছে মাত্র তিনটি ফোটনের।’’
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: চন্দ্র এক্স-রে অবজারভেটরি, নাসা