ছবি- নাসার সৌজন্যে।
সূর্য থেকে প্রতি মুহূর্তে ছিটকে বেরনো এক ভয়ঙ্কর হানাদারের আঁতুড়ঘরের হদিশ মিলল এই প্রথম। যে আঁতুড়ঘরে তৈরি হচ্ছে লক্ষ লক্ষ পরমাণু বোমার সমান শক্তি। একই সঙ্গে।
এই প্রথম জানা গেল সূর্যের ঠিক কোথায় এই হানাদারদের জন্ম হচ্ছে। তারা কী ভাবে গায়েগতরে বেড়ে উঠছে। হয়ে উঠছে দীর্ঘমেয়াদি। উত্তরোত্তর নিজেদের বদলে নিচ্ছে গোটা সৌরমণ্ডলের পক্ষে আরও বিপজ্জনক আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার জন্য।
জানা গেল, এদের জন্ম হচ্ছে সূর্যের বায়ুমণ্ডল (‘করোনা’)-এর ঠিক নীচের স্তরে। সূর্যের পিঠের (‘সারফেস’ বা ‘ফোটোস্ফিয়ার’) উপর থেকে কিছুটা উপরে যে স্তরটি রয়েছে (‘ক্রোমোস্ফিয়ার’), তার কিছুটা উপরে। যেখান থেকে একটি লম্বালম্বি রেখা টানলে তা ফোটোস্ফিয়ারের এমন একটি জায়গা ছোঁবে, যে এলাকাটিতে তৈরি হচ্ছে একের পর এক বিশাল সৌরকলঙ্ক বা ‘সানস্পট’।
এই হানাদাররা সূর্য থেকে বেরিয়ে ছুটছে প্রায় আলোর গতিবেগেই। ছুটে আসছে পৃথিবী-সহ বিভিন্ন গ্রহের দিকে। প্রায় সাড়ে ৯ কোটি কিলোমিটার দূরে পৃথিবীতে পৌঁছতে যাদের সময় লাগে বড়জোর এক ঘণ্টা। একই গতিবেগে তারা ছুটে যাচ্ছে সৌরমণ্ডলের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত।
এরা সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরকণা। সৌরবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাদের নাম- ‘সোলার এনার্জেটিক পার্টিকল্স (এসইপি বা সেপ)’। যাদের শরীর গড়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকা ইলেকট্রন আর বিভিন্ন মৌলের আয়ন (ইলেকট্রন খোয়ানো পরমাণু) দিয়ে। এদের শক্তি ১০ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্ট।
নাসার মহাকাশযান ‘উইন্ড’ ও জাপানের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘জাক্সা’র মহাকাশযান ‘হিনোড’-এর যৌথ প্রচেষ্টাতেই সূর্যের এই ভয়ঙ্কর হানাদারের আঁতুড়ঘরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এ। মার্চের প্রথম সপ্তাহে।
সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরকণাদের গোটা মহাকাশে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করছে সূর্যেরই কিছু চৌম্বক রেখা। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করছে সূর্যের মাংস উপড়ে বার করে আনা করোনাল মাস ইজেকশান (সিএমই)। পৃথিবী-সহ গোটা সৌরমণ্ডলে এই সৌরকণাদের ছুটে যাওয়ার আরও একটি ‘বাহক’ সৌরবায়ু (‘সোলার উইন্ড’)। যদিও মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ার পর সৌরকণাদের শরীর কোন কোন মৌল দিয়ে গড়া থাকবে, তাদের পরিমাণের কতটা কী তারতম্য হবে, তা নির্ধারণ করে দিচ্ছে সৌরবায়ু। যা পৃথিবী-সহ গোটা সৌরমণ্ডলের পক্ষে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে সৌরকণাদের।
সূর্য-পরিচয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরকণা-সহ সূর্যের এই সব হানাদারের (সৌরবায়ু, সৌরঝড় বা সোলার স্টর্ম, সিএমই) হাত থেকে আমাদের অহরহ বাঁচিয়ে চলেছে পৃথিবীকে চার দিক দিয়ে ঘিরে থাকা চৌম্বক ক্ষেত্র। যা কাজ করে বর্মের মতো। সৌরকণারা এসে আছড়ে পড়লে ঝনঝন করে কেঁপে ওঠে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। চুম্বকের সমমেরুর বিকর্ষণের জন্য সৌরকণাদের দূরে হঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র। সে জন্যই আমরা ‘অরোরা’ বা মেরুজ্যোতি সবচেয়ে বেশি দেখি পৃথিবীর দুই মেরুতে। চৌম্বক ক্ষেত্রের দু’টি মেরু ভৌগোলিক মেরুদু’টির কাছাকাছি আছে বলে।
কিন্তু চাঁদে, মঙ্গলে বা মহাকাশে এই চৌম্বক ক্ষেত্রের বর্মটা নেই। তাই চাঁদে, মঙ্গলে নামা কোনও মহাকাশচারীর পক্ষে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে এই সৌরকণা। তা সরাসরি ঢুকে যেতে পারে তাঁদের শরীরে। তাঁদের কোষ, কলা, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট করে দিতে পারে। কারণ হয়ে উঠতে পারে দুরারোগ্য ক্যানসারের। যেহেতু এই চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিধি অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করে কৃত্রিম উপগ্রহগুলি তাই ভয়ঙ্কর সৌরকণারা উপগ্রহগুলির গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রগুলিকে অকেজো, অচল করে দিতে পারে। ক্ষতি করতে পারে মহাকাশে পাড়ি জমানো মহাকাশযানগুলিরও।
তাই সূর্যের ঠিক কোথায় এদের আঁতুড়ঘর, তারা কী ভাবে গায়েগতরে বেড়ে উঠে সূর্য থেকে বাইরে ছুটে যাচ্ছে তা জানা-বোঝার প্রয়োজন ছিল। নাসা ও জাক্সার দুই মহাকাশযান সেই দরজাটা খুলে দিল।
অন্যতম প্রধান গবেষক ওয়াশিংটনের জর্জ ম্যাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভিড ব্রুক্স ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’-এর পাঠানো প্রশ্নের জবাবে ই-মেলে জানিয়েছেন, দুই মহাকাশযান এই তথ্যাদি পাঠিয়েছিল ২০১৪ সালে। ‘‘সেই সব তথ্য খতিয়ে দেখে আমরাই প্রথম দেখাতে পেরেছি, সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ারের উপরে ঠিক কোথায় সৌরকণাদের জন্ম হচ্ছে’’, বলেছেন ব্রুক্স।
২০১৪-র ৭ জানুয়ারি এই সৌরঝলকই দেখেছিল নাসা, জাক্সা-র মহাকাশযান। আলোকবর্ণালীর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
ব্রুক্স জানিয়েছেন, সূর্যের পিঠে একটি বিশেষ অঞ্চলের উপরেই এই সৌরকণাদের উৎপত্তিস্থল। সূর্যের পিঠের সেই বিশেষ অঞ্চলটির নাম ‘অ্যাকটিভ রিজিয়ন ১১৯৪৪ (এআর ১১৯৪৪)’। এই এলাকাটিতে ওই সময় প্রচুর পরিমাণে বিশাল বিশাল সৌরকলঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ২০১৪-র জানুয়ারির তিনটি দিন ৪, ৬ এবং ৮ তারিখে ওই এলাকার উপরে সূর্যের করোনায় বহু বড় বড় সৌরঝলক (‘সোলার ফ্লেয়ার’) এবং সিএমই দেখা গিয়েছিল।
মোহনপুরের ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার কলকাতা)’-এর অধ্যাপক সৌরবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী বলছেন, ‘‘এত দিন জানা ছিল সূর্য থেকে এক মুখ খোলা বা উন্মুক্ত চৌম্বক রেখা (‘ওপ্ন ম্যাগনেটিক ফিল্ড’) ধরেই মহাকাশে ছুটে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ে সৌরকণারা। হাইওয়ে ধরে যেমন গাড়ি ছোটে। এই গবেষণার অভিনবত্ব, দেখা গেল আবদ্ধ চৌম্বক ক্ষেত্রগুলির (‘ক্লোজ্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ড’) কোনও ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়ছে সৌরকণারা। অনেকটা যেন মাছের জালের ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়ছে মাছ। এটা কেন হচ্ছে, কী ভাবে হচ্ছে, এ বার সেই গবেষণারও দরজা খুলে দিল সৌরকণাদের আঁতুড়ঘরের হদিশ।’’
আরও একটি অভিনবত্ব রয়েছে এই গবেষণার। আমদাবাদে ইসরো-র ‘ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল)’-র অধ্যাপক দিব্যেন্দু চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘দু’ধরনের খুব শক্তিশালী সৌরকণার জন্ম হয় কোনও সৌরঝলকের পর। একটি ‘ইমপালসিভ সোলার পার্টিকল’। জন্মের কিছু ক্ষণের মধ্যেই তা উধাও হয়ে যায়। সেগুলিও ছিটকে বেরিয়েও আসে মহাকাশে। তবে সেগুলি মহাকাশের বেশি এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। তাদের আয়ুও কম। তাই তা মহাকাশযান, মহাকাশচারী বা পৃথিবীর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে না অন্য ধরনের সৌরকণার সমান শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও। অন্যটি- ‘গ্র্যাজুয়াল সোলার পার্টিকল’। যা জন্মের পর ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তাদের আয়ুও হয় এক দিনের মতো। এরা ছিটকে বেরিয়ে আসে মহাকাশে। ছড়িয়ে পড়তে পারে মহাকাশের অনেকটা এলাকা জুড়ে। তাই এরা খুবই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এই গবেষণা সেই গ্র্যাজুয়াল সোলার পার্টিকল-এরও আঁতুড়ঘরের হদিশ দিয়েছে।’’
সূর্যের আবদ্ধ ও উন্মুক্ত চৌম্বক রেখাগুলি। ছবি- নাসার সৌজন্যে।
নৈনিতালের ‘আর্যভট্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব অবজারভেশনাল সায়েন্সেস (এরিস)’-এর অধিকর্তা দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানাচ্ছেন, এদের আঁতুড়ঘর কোথায় হতে পারে, তার একটা প্রাথমিক ধারণা ছিল বিভিন্ন তাত্ত্বিক গবেষণায়। তবে এই প্রথম দু’টি মহাকাশযান সেই উৎপত্তিস্থলটিকে চাক্ষুষ করল।
দীপঙ্কর ও দিব্যেন্দু (চক্রবর্তী) এ-ও জানাচ্ছেন আগামী বছর অভিযানে যাচ্ছে ইসরোর যে মহাকাশযান সেই ‘আদিত্য এল-ওয়ান’-এর গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে খুবই কার্যকরী হয়ে উঠবে সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল।
ছবি সৌজন্যে- নাসা।