কচুরিপানার বাড়বাড়ন্ত দেখে আঁতকে উঠতে হয়। অতি অল্প দিনে এই উদ্ভিদ দ্রুত বংশ বিস্তার করে। আদিভূমি ব্রাজিল থেকে অভিযান শুরু করে আজ গোটা পৃথিবীব্যাপী এর দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে। কচুরিপানায় যেমন বহতা জলের স্রোত বন্ধ হয়ে নৌ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়, তেমনই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের টার্বাইনে জড়িয়ে তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া বদ্ধ জলে কচুরিপানার জন্য সাপের উপদ্রব এবং মশা-মাছির বাড়বাড়ন্ত দেখা যায়। এ জন্য এক সময়ে অবিভক্ত বঙ্গে সব রাজনৈতিক দলই কচুরিপানা সাফ করার কর্মসূচি তাদের ইস্তেহারে রেখেছিল। গুরুসদয় দত্ত তাঁর ব্রতচারী গানগুলির মধ্যে কচুরিপানা বিনাশের ডাক দিয়েছিলেন।
তবে, এ কালের এক দল বিজ্ঞানী কচুরিপানা নিয়ে হাতেকলমে পরীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছেন যে কচুরিপানা আসলে সম্পদ। আমেরিকার নাসা-র জনাকয়েক বিজ্ঞানী সত্তরের দশক নাগাদ দেখিয়েছিলেন, কলকারখানার দূষিত জল থেকে কচুরিপানার শিকড় এক দিনের মধ্যেই শুষে নিয়েছে নিকেল এবং ক্যাডমিয়ামের শতকরা ৯৭ ভাগ। দূষিত জল থেকে নানা ভারী ধাতু কিংবা ফেনলের মতো বহু জৈবিক অপদ্রব্য নিষ্কাশন করে, হপ্তাদুয়েকের মধ্যে সে জলকে অন্তত ৭৫-৮০ ভাগ দূষণমুক্ত করেছে কচুরিপানা।
কৃষিতে কচুরিপানার ব্যবহার নানা দেশে নানা ভাবে হয়ে আসছে। আফ্রিকা মহাদেশের মিষ্টি জলের সবচেয়ে বড় হ্রদ লেক ভিক্টোরিয়ার আশেপাশের কয়েকটি দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষ এর উপর নির্ভরশীল। সেখানকার চাষিরা স্বেচ্ছায় তা তুলে নিয়ে জৈব সার তৈরি করে সবজি চাষ করছেন। কৃষি গবেষকরা বলছেন, এই সারে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস যথেষ্ট পরিমাণেই থাকে। আর এই সার প্রয়োগে মাটির অনুজীবী, যারা মাটিতে বায়ু চলাচল করে উর্বরতা বাড়ায়, তাদের কোনও ক্ষতি হয় না। আর মাটির আর্দ্রতাও ধরে রাখে। ত্রিপুরাতে চা বাগানে শুষ্ক সময়ে কিছু জায়গায় কচুরিপানা বিছিয়ে সেচ প্রয়োগ করে আর্দ্রতা ধরে রাখার চল আছে। তা ছাড়া কচুরিপানা পচিয়ে যে শতকরা ৬০-৮০ শতাংশ মিথেন গ্যাস পাওয়া যাবে, তা থেকে মিলবে সস্তার জ্বালানি গ্যাস।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলকাতা অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হাইজিন অ্যান্ড হেলথও কচুরিপানা নিয়ে কাজ করেছিল। তামিলনাড়ুর উধাগামন্ডলমের হর্টিকালচার রিসার্চ স্টেশনের প্রধান প্রফেসর এন সেলভারাজ দেখেছেন, ভার্মি কম্পোস্টের জন্য অন্যান্য কৃষিবর্জ্য থেকে জৈবসার হতে যেখানে ৭০ দিন সময় লাগে, সেখানে কচুরিপানা থেকে কম্পোস্ট ৫৫ দিনের মধ্যে হয়ে যায়। তাঁর মতে, বিভিন্ন উদ্যান ফসলের জন্য যেখানে হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১৫ টন জৈবসার লাগে, সেখানে কচুরিপানার কম্পোস্ট লাগে মাত্র আড়াই থেকে তিন টন। সত্তরের দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষাতে দেখা গিয়েছিল যে, কচুরিপানার মূল নির্যাস ধানের কাণ্ডের বৃদ্ধির সহায়ক হলেও, ধানের মূলের বৃদ্ধির প্রতিরোধক। ১৯৭৫-৭৬ সালে গোবরডাঙ্গা রেনেসাঁ ইনস্টিটিউটের দীপক দাঁ-র নেতৃত্বে এই নিয়ে পর্যবেক্ষণ চলছিল। তাঁরা বোস ইনস্টিটিউট থেকে কচুরিপানার নির্যাস জিব্বেরেলিন অ্যাসিড (গ্রোথ হরমোন) নিয়ে এসে পাট, টমেটো, পালং ইত্যাদির উপর প্রয়োগ করে আশাতীত সাফল্য লাভ করেছিলেন। দেখা গিয়েছিল, পাটের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়ে আঁশের পরিমাণ অনেক বেড়েছিল। পালংয়ের পাতা, ডালিয়া ফুলের আকৃতি হয়েছিল অনেক বড়। প্রয়োগের সাত দিনের মধ্যেই এই প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারা গিয়েছিল। কাশ্মীরের ডাল লেকে ‘ফ্লোটিং গার্ডেন’ পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় জায়গা। জলের উপর স্তূপীকৃত পচাপানা আর শ্যাওলার উপর বাগানে দিব্যি সবজি চাষ হচ্ছে। আমাদের এখানে জলাভূমিতে এ ধরনের উদ্যোগের কথা ভাবা যেতে পারে।
আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন ছোট-বড় শহরগুলিতে কলকারখানার বর্জ্য, নর্দমার বা খাটালের পূতিগন্ধময় দূষিত জল সরাসরি গঙ্গায় বা অন্যান্য ছোট নদীতে পড়ে সে জলও বিষিয়ে দিচ্ছে। সেই জন্য সব নদীতে মাছের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু এই দূষিত জল কচুরিপানা সমেত কোনও সংরক্ষিত জলাশয়ে কিছু দিন রেখে, দূষণমুক্ত করে, তার পর নদীতে প্রবাহিত করলে তার জল থাকবে অনেকটা নির্মল।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বিজ্ঞানী ডঃ মোঃ মহিউদ্দিন চৌধুরী দীর্ঘ দিন কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করছেন। সেখানে টার্কি মুরগির খাবারের সঙ্গে এক-চতুর্থাংশ কচুরিপানা পরিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে। গো-খাদ্য হিসেবেও এর চল আছে। এখানেও পুরনো কচুরিপানার মূল পচে যাতে মশা-মাছির বৃদ্ধি না ঘটে, তার আগেই সরিয়ে তাদের কাজে লাগানো যায়। কচুরিপানার এই স্বর্ণ সম্ভাবনাকে অবহেলা করতে দেখে ডঃ মহিউদ্দিনের আক্ষেপ, “হায় রে কচুরিপানা! বাংলার কৃষক তোরে চিনল না।’’