আকাশ দেখা, চেনা, জানার শখ মেটাবে কলকাতার মহাকাশ সংগ্রহশালা। -ফাইল ছবি।
কলকাতায় বসেই এ বার ছোঁয়া যাবে চাঁদ, মঙ্গলকে! স্পর্শ করা যাবে চাঁদ, মঙ্গলের দুর্লভ পাথর খণ্ডগুলিকে।
ছোঁয়া যাবে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে থাকা গ্রহাণুদের সাম্রাজ্য- গ্রহাণুপুঞ্জ (‘অ্যাস্টারয়েড বেল্ট’) থেকে ছিটকে বেরিয়ে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা গ্রহাণুদের শরীরের বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য অংশও।
সেই চাঁদের পাহাড়ের পাথর, পাঁচ দশক পর ২০২৪-এ যে মুলুকে ফের মহাকাশচারী পাঠাচ্ছে নাসা।
কলকাতায় বসেই আমি, আপনি এ বার ছুঁতে পারব পৃথিবী থেকে প্রায় সাড়ে ৩৯ কোটি কিলোমিটার দূরের ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলের শিলাখণ্ডও। যে সব শিলাখণ্ডের উপর এখন লাল গ্রহে কড়া নজর রেখে চলেছে নাসার পাঠানো ‘রোভার পারসিভের্যান্স’। অণুজীব বা অন্য যে কোনও রকমের প্রাণের অস্তিত্বের কোনও ‘পদচিহ্ন’ সেখানে মেলে কি না দেখতে। নজর রাখছে কিউরিওসিটি-সহ নাসা এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (এসা)-র আরও কয়েকটি ল্যান্ডার এবং রোভার।
ভারতের প্রথম মহাকাশ সংগ্রহশালা যে চালু হচ্ছে কলকাতাতেই। স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৫তম বর্ষে। আমজনতার জন্য যার দরজা খুলে যাচ্ছে আগামী জানুয়ারিতে। কোভিড পরিস্থিতির জন্য কাজকর্ম মাঝেমধ্যে থমকে যাচ্ছে। না হলে হয়তো চলতি বছরের শেষেই এই সংগ্রহশালা চালু হতে পারে।
যাঁর বহু দিনের স্বপ্ন এই সংগ্রহশালা গড়া, তিনি কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক সন্দীপ চক্রবর্তী।
আইসিএসপি-র জমির একাংশেই গড়ে উঠেছে মহাকাশ সংগ্রহশালা। -নিজস্ব চিত্র।
কোথায়? কবে চালু?
রবিবার ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-কে দেশের প্রথম মহাকাশ সংগ্রহশালা চালুর খবর দিয়ে সন্দীপ বললেন, ‘‘কোভিড পরিস্থিতির জন্য যদি এ বছরের শেষের দিকে না পারি, তা হলে অবশ্যই তা চালু হবে নতুন বছরে পা দিয়ে। জানুয়ারিতে।’’
সন্দীপ জানাচ্ছেন, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী মেট্রো স্টেশনের ঢিল ছোড়া দূরত্বে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসে আইসিএসপি-র ৩৭ হাজার বর্গ ফুট জমির একাংশে নির্মিয়মান পাঁচ তলা ভবনের এক তলায় গড়ে তোলা হচ্ছে এই মহাকাশ সংগ্রহশালা। প্রাথমিক ভাবে ৩ হাজার বর্গ ফুট জমির উপর। সংগ্রহশালা গড়ে তোলার জমি ও তার পরিকাঠামো গড়ে তোলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৪০ লক্ষ টাকা অর্থসাহায্য করেছে।
যদিও ভারতের প্রথম মহাকাশ সংগ্রহশালা গড়ে তোলার জন্য চাঁদ, মঙ্গলের দুর্লভ পাথর আর পৃথিবীর দিকে বিভিন্ন সময়ে ছিটকে আসা বিভিন্ন গ্রহাণুর শরীরের দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য অংশগুলি জোগা়ড় করতে বহু বছর ধরে নিজের উপার্জন, সঞ্চয়ের একাংশ খরচ করে গিয়েছেন সন্দীপ।
মহাকাশ সংগ্রহশালার প্রবেশদ্বারে থাকবে এই নটরাজ মূর্তি। নটরাজের পায়ের তালে তালে সময় এগয় যে! -নিজস্ব চিত্র।
সেই ব্যক্তিগত স্বপ্ন আমার-আপনার হাতের নাগালে পৌঁছে দিচ্ছে চাঁদ আর মঙ্গলের পাহাড়ের পাথর আর গ্রহাণুগুলির শিলাখণ্ডগুলিকে।
কী কী থাকছে সংগ্রহশালায়?
একটা-দু’টো নয়। মহাকাশের রাশি রাশি বস্তুতে ভরা থাকছে কলকাতার সেই মহাকাশ সংগ্রহশালা।
রাশি রাশি সংগ্রহের মধ্যে সন্দীপ বিশেষ কয়েকটির উল্লেখ করেছেন।
তার মধ্যে অন্যতম মঙ্গলের সেই পাথর খণ্ডের একাংশ, ২০১৮ সালে যা আছড়ে পড়েছিল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকায়। সেই শিলাখণ্ডের ৫.৬৮ গ্রাম ওজনের অংশটি সংগ্রহ করেছিলেন সন্দীপ। যার অন্যতম উপাদান লোহা ও টাইটানিয়ামের অক্সাইড।
মিউজিয়ামে থাকছে আমেরিকার আরিজোনার মরুভূমিতে ৫০ হাজার বছর আগে আছড়ে পড়া বিশাল একটি উল্কার অংশ। উল্কাটি আছড়ে পড়ার ফলে ৫০ হাজার বছর আগে আরিজোনা মরুভূমিতে সুবিশাল একটি গর্ত তৈরি হয়েছিল। এখন যার নাম ‘ব্যারিঞ্জার ক্রেটার’। যার গভীরতা ৫৬০ ফুট। সেই গর্তের ভিতর থেকেই পরে পাওয়া যায় সেই উল্কার শরীরের নানা অংশ। তারই একটি অংশ থাকছে কলকাতার মহাকাশ সংগ্রহশালায়। যার ওজন ১৭৩ গ্রাম।
আরিজোনায় ৫০ বছর আগে উল্কা আছড়ে পড়ায় সৃষ্ট গর্ত। ইনসেটে, সেই উল্কাপিণ্ডের অংশ, যা থাকবে কলকাতার মহাকাশ মিউজিয়ামে। -নিজস্ব চিত্র।
থাকছে প্রায় আপাদমস্তক কার্বন দিয়ে গড়া যার শরীর, এমন একটি উল্কাখণ্ডের অংশও। ১৮.৪ গ্রামের। গত বছর সেই উল্কা আছড়ে পড়েছিল মরক্কোর টার্ডায়।
এ ছাড়া দেখা যাবে ২০১৭ সালে আফ্রিকার মালিতে আছড়ে পড়া চাঁদের পাহাড়ের সেই পাথরখণ্ড। ১১১ গ্রাম ওজনের। লোহা, নিকেল, অ্যালুমিনিয়ামের মতো পদার্থ দিয়ে গড়া যার শরীর।
থাকছে ২০১৩ সালে রাশিয়ার চেলিয়াবিনস্কে আছড়ে পড়া বিশাল উল্কার একাংশ। সেই উল্কাপাতের ঘটনায় আহত হয়েছিলেন এক হাজারেরও বেশি মানুষ। সাড়ে ৩ কিলোগ্রাম ওজনের সেই উল্কাপিণ্ড ভেঙে ৪০০টি টুকরো হয়ে গিয়েছিল আছড়ে পড়ার পর। তারই একটি থাকছে কলকাতার মহাকাশ সংগ্রহশালায়। ওজনে ১.২৩৭ গ্রামের।
ম্যাগনেসিয়াম ও লোহার সিলিকেটের এই অংশটিও থাকছে সংগ্রহশালায়। ১৭.৭ গ্রাম ওজনের। এটি সেই উল্কাপিণ্ডের অংশ যা পড়েছিল কেনিয়ায়। -নিজস্ব চিত্র।
এ ছাড়া দেখা যাবে আর্জেন্টিনা, আলজিরিয়া-সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সময়ে আছড়ে পড়া রাশি রাশি গ্রহাণুর আরও বহু অংশ।
কী কী বিভাগ থাকছে মিউজিয়ামে
কলকাতায় ভারতের প্রথম মহাকাশ সংগ্রহশালায় থাকছে মোট ৭টি বিভাগ। ‘মেটিওরাইট সেকশন: ভিজিটার্স ফ্রম স্পেস’, ‘এক্স-রে অ্যাস্ট্রোনমি সেকশন’, ‘স্যাটেলাইটস অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টেশন্স’, ‘বেলুন বোর্ন সায়েন্স’, ‘মিনি প্ল্যানেটারিয়াম’, ‘টেলিস্কোপ মেকিং ওয়ার্কশপ’ ও ‘আয়নোস্ফেরিক রিসার্চ অ্যান্ড স্পেস রেডিয়েশন’।
সন্দীপ জানাচ্ছেন, বাড়ির ছাদে শেষ এপ্রিলের প্রথম বর্ষণেও যে উল্কাখণ্ডের অংশ থাকে প্রচুর পরিমাণে, মহাকাশ সংগ্রহশালায় তা দেখানো হবে দর্শনার্থীদের। দেখানো হবে ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপের নানা দেশের মহাকাশযানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ও যন্ত্রাংশগুলির অবিকল রূপও।
থাকছে দামে সস্তা সেই টেলিস্কোপও। যার লেন্সের ব্যাস ৫ ইঞ্চি। বানিয়েছে আইসিএসপি-ই। যা দিয়ে প্রতিবেশী অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিও দেখা যাবে।
বলা ভাল, কলকাতার মানুষের মহাকাশ পরিক্রমাই হতে চলেছে ভারতের প্রথম মহাকাশ সংগ্রহশালায়।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে- ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’, কলকাতা।