মানুষ তো লক্ষ লক্ষ বছর ধরেই উদ্বাস্তু

কল্যাণীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স (এনআইবিএমজি)-এর প্রতিষ্ঠা দিবসে বক্তৃতা দিয়ে স্টোনকিং ব্যাখ্যা করলেন লক্ষ লক্ষ বছরে পৃথিবী জুড়ে মনুষ্য প্রজাতির সম্প্রসারণ।

Advertisement

পথিক গুহ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৪:০৫
Share:

বিশ্ব জুড়ে এখন উদ্বাস্তু এবং শরণার্থী সমস্যা। এর চাপে বিষিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি। আমরা ভুলেই যাচ্ছি যে, নতুন এলাকায় মানুষের বসতি স্থাপন— বিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘হিউম্যান মাইগ্রেশন’— হাজার হাজার নয়, লক্ষ লক্ষ বছরের পুরনো ব্যাপার। আজ কলকাতায় এই মন্তব্য করলেন বিশিষ্ট জিনতত্ত্ববিদ এবং জার্মানিতে ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর ইউল্যুশনারি অ্যানথ্রপলজির অধ্যাপক মার্ক অ্যালেন স্টোনকিং।

Advertisement

কল্যাণীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিক্যাল জিনোমিক্স (এনআইবিএমজি)-এর প্রতিষ্ঠা দিবসে বক্তৃতা দিয়ে স্টোনকিং ব্যাখ্যা করলেন লক্ষ লক্ষ বছরে পৃথিবী জুড়ে মনুষ্য প্রজাতির সম্প্রসারণ। ‘আধুনিক মানুষ’ কোথা থেকে এল? এ প্রশ্নে বিজ্ঞানে শতেক জিজ্ঞাসার মতো বিতর্ক বিদ্যমান। এক দল বিজ্ঞানী বলেন, আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছে পৃথিবীর নানা জায়গায়, নানা সময়ে। আর অন্য দল, যাঁদের অন্যতম স্টোনকিং, বিশ্বাস করেন আড়াই থেকে তিন লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার কোনও এক জায়গা থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ। এই তত্ত্বের পোশাকি নাম ‘আউট-অব-আফ্রিকা’ থিওরি। এই দ্বিতীয় তত্ত্বই এখন মাথাচাড়া
দিচ্ছে। কেন, তা সবিস্তার ব্যাখ্যা করলেন স্টোনকিং।

সে যুগ গিয়েছে, যখন মনুষ্য প্রজাতির কুলজি অন্বেষণের দায়িত্বে ছিলেন কেবল ভূতাত্ত্বিক বা প্রত্নতাত্ত্বিকেরা। স্টোনকিং বললেন, মাটি খুড়ে আস্ত কঙ্কালের বদলে প্রায়ই মেলে টুকরো হাড়গোড়। সে সব থেকে ইতিহাস রচনায় ভুলের সম্ভবনা প্রবল। তার বদলে গত শতাব্দীর শেষ দিকে এসেছে মানুষের জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে কুলজি-রচনা। মানুষ বা যে কোনও প্রাণী তাঁর জিন পায় মা এবং বাবার থেকে। পূর্বপুরুষ বা বংশতালিকা অণ্বেষণে জিন বিশ্লেষণ তাই অনেক বেশি সুবিধাজনক।

Advertisement

প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও ‘আউট অব আফ্রিকা’ থিওরি’ গড়ে ওঠে ১৯৮৭ সালে। এ তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল মানুষের দেহকোষে উপস্থিত মাইটোকনড্রিয়া নামে উপাদানটির বিশ্লেষণে। ওই উপাদানটি সন্তান পায় মায়ের থেকে।
মাতৃকুলের ইতিহাস সন্ধানে মাইটোকনড্রিয়ার ডিএনএ বিশ্লেষণ তাই এক শক্তপোক্ত উপায়।

মহাদেশে-মহাদেশে মনুষ্য প্রজাতির সম্প্রসারণের দু’টো তত্ত্ব আছে। এক দল বিজ্ঞানী মনে করেন, নতুন জায়গায় বসতি স্থাপন করে আফ্রিকা-বহির্গত মানুষ নতুন জায়গার পুরনো প্রজাতিকে ধ্বংস করে ঘরসংসার পাতে। আর এর পাল্টা তত্ত্ব হল সংমিশ্রণ— বহিরাগতদের সঙ্গে প্রাচীনদের যৌনসংসর্গ। স্টোনকিং মনে করেন, আধুনিক মানুষের সঙ্গে প্রাচীন প্রজাতির ‘নিয়ান্ডার্থাল’-দের যৌন সংসর্গ ঘটেছিল। তাঁর মন্তব্য, পুরাতনদের ধ্বংস নয়, ‘এভরিওয়ান ওয়াজ হ্যাভিং সেক্স উইথ এভরিওয়ান এলস।’

মানুষের কুলজি রচনায় ভাষা কি কোনও মাধ্যম হতে পারে? প্রশ্নটা নস্যাৎ করলেন স্টোনকিং। বললেন, ‘‘ভাষা বড় দ্রুত বদলায়। লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাস রচনায় তাই ভাষা বড় দুর্বল উপকরণ।’’ তবে, ভারতের মতো দেশ, যেখানে বহু বর্ণের এবং বহু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস, তা কুলজি রচনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের ভাল ল্যাবরেটারি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বললেন, পার্থপ্রতিম মজুমদারের মতো গবেষকেরা এই বিষয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন।

এনআইবিএমজি-র প্রতিষ্ঠা দিবসে বক্তাদের মধ্যে ছিলেন বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের অধ্যাপক জি পদ্মনাভন। বর্ষীয়ান এই বিজ্ঞানী ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন, দেশজুড়ে ‘উন্নতি’-র নানাবিধ দাবিতে গা না ভাসাতে। ‘‘মানুষের উন্নতির নিরিখে কিন্তু ১৮৮ রাষ্ট্রের মধ্যে আমাদের ভারতের স্থান ১৩১-এ,’’ বললেন তিনি। তাঁর খেদোক্তি কলকাতা শহরকে লক্ষ করেও। ‘‘কলকাতা না বিজ্ঞানকে ভালবাসে, এখানকার মেধাবী ছাত্ররা না
দেশের বিভিন্ন ল্যাবরেটারিতে গবেষণা করে বেড়ায়, তাহলে কেন জিন প্রযুক্তিতে বাঙালি ছাত্ররা নতুন কোম্পানি খুলে বসছে না বেঙ্গালুরুর মতো?’’ তাঁর প্রশ্ন। অনুষ্ঠানে এনআইবিএমজি-র বিভিন্ন কাজকর্ম ব্যাখ্যা করেন ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর সৌমিত্র দাস।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement