প্রতীকী চিত্র। — এপি।
(আমরা কতজন আক্রান্ত, তার হিসেব নিয়েছি, এখন জানা দরকার আক্রান্তের ভিতরের হিসেব)
ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে যখন কোভিড-১৯ মহামারী হিসেবে চিনে দাপটে বিরাজ করছে, তখন আমি কলকাতায় আসি। বেশ গরমের একটা সকালে ঘুম ভাঙতে হোটেলের জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম আকাশে চিলের ওড়াউড়ি।
কেমন চক্রাকারে ডানা মেলে উড়ছে ওরা গ্রীষ্মের বাতাস সাঁতরে। আমি এক শীতলা মন্দিরে গিয়েছিলাম। ‘শীতলা’, যে দেবী যজ্ঞাগ্নির শীতল ভস্ম থেকে উদ্গত হয়েছেন। জুন মাসের মাঝামাঝি যখন শহর দগ্ধ হয়, তিনি তখন শীতল করেন। না, কেবল আবহাওয়া নয়, মানুষের অন্তর্দাহকেও তিনি শীতল করেন। বিশ্বাস, তিনি বসন্ত রোগের মতো কালান্তক ব্যাধি থেকে রক্ষা করেন। মহামারী থেকে বাঁচান।
শীতলা মন্দিরটি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের কাছেই। মন্দিরের ভিতরে দেবীর বিগ্রহ— গাধার পিঠে আরূঢ়া, হাতে ভাণ্ড, যা থেকে নির্গত আরক দিয়ে তিনি মারীকে নিরাময় করেন। এই ভাবেই প্রায় হাজার বছর ধরে দেবী চিত্রিত। এই মন্দিরটিও কম-বেশি আড়াইশো বছরের পুরনো, মন্দিরের পূজারীই জানালেন। সেই সময়ে এই দেবীর উদ্ভব হয়, যখন এক শ্রেণির ব্রাহ্মণ গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঘুরে ঘুরে ‘টিকা’ দেওয়ার উপযোগ বুঝিয়ে চলেছেন। গুটি বসন্তে আক্রান্ত রোগীর গুটি থেকে জীবাণু সংগ্রহ করে তা নীরোগ মানুষের ত্বকে প্রবেশ করিয়ে ক্ষতস্থান কাপড় দিয়ে বেঁধে দিতেন তাঁরা।
আরও পড়ুন: করোনার দৈব শিকার: স্বয়ং মা শীতলাই লকডাউনে
ভারতের এই টিকাদানকারীরা এই পদ্ধতি শিখেছিলেন আরব চিকিৎসকদের কাছ থেকে। আরবরা আবার এই জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিলেন চিনাদের কাছ থেকে। আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চিনের চিকিৎসকরা খেয়াল করেন, যাদের একবার গুটি বসন্ত হয়েছে, তারা আর এই রোগে আক্রান্ত হয় না। সেই সব লোকেদেরই নতুন রোগীদের শুশ্রুষার ভার দেওয়া হয়। তাঁরা বোঝেন, একবার এই রোগাক্রান্তদের নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। গুটি বসন্তের মামড়ি শুকিয়ে গুঁড়ো করে রুপোর নলের মাধ্যমে তাঁরা শিশুদের নাকে তা ঢুকিয়ে দিতেন। এ ভাবেই চলত গুটি বসন্ত প্রতিরোধের কাজ।
জীবন্ত জীবাণু দিয়ে এই ভাবে টিকাকরণ বেশ ঝুঁকির কাজ ছিল। গুঁড়োর মাত্রা একটু এদিক-ওদিক হলেই শিশুটির রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকত। একশো জনের মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে তেমনটা হতোও। সব ঠিকঠাক থাকলে শিশুটির শরীরে রোগ দেখা দিত অল্প মাত্রায়, কিন্তু সে সারা জীবনের জন্য সুরক্ষিত থাকত। অষ্টাদশ শতকে আরবে এই পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়। ১৭৬০-এর দশকে সুদানে মহিলারা এক অদ্ভুত প্রথা চালাতেন। ‘তিশতেরি এল জিদ্দেরি’। এর অর্থ—‘গুটি বসন্ত রোগকে কেনা’। একজন মা আর একজন মায়ের সঙ্গে রীতিমতো দরাদরি করতেন রোগাক্রান্ত শিশুর গুটি থেকে সংগৃহিত রস কেনার জন্য। এই টিকাকরণ ছিল দস্তুরমতো জটিল কাজ। অভিজ্ঞ চিকিৎসকরাই বুঝতে পারতেন, কোন ক্ষত থেকে পুঁজ সংগ্রহ করতে হবে, কতটা করতে হবে। ইওরোপে এই রোগকে বলা হত ‘ভ্যারিওলা’, ল্যাটিন থেকে জাত এই শব্দের অর্থ ‘দাগওয়ালা’ বা ‘ব্রণযুক্ত’। এই রোগের প্রতিরোধ পধতিকে বলা হত ‘ভ্যারিওলাইজেশন’।
আরও পড়ুন: ২১ দিনের লকডাউন এর পর আরও ২৮ দিন! হু-র এই বিজ্ঞপ্তি কি সঠিক?
কনস্ট্যানটিনোপলের ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের স্ত্রী লেডি মেরি ওর্টলি মন্টেগু ১৭১৫ নাগাদ এই রোগে আক্রান্ত হন। তাঁর শরীরে দাগ থেকে যায় বসন্তের। পরে তুরস্কের গ্রামাঞ্চলে তিনি ভ্যারিওলাইজেশনের কাজ দেখতে পান। তিনি এক বন্ধুকে লেখা একটি চিঠিতে জানান: “এক বৃদ্ধা গুটি বসন্তের রস নিয়ে হাজির হতো, জিজ্ঞাসা করত কোন শিরায় টিকা নিতে চান। একটা সূচের ডগায় যতটুকু ধরে, ততটুকুই সে শিরায় প্রবেশ করাত।” রোগী কয়েক দিনের জন্য জ্বরে শয্যা নিত, কিন্তু সেরে উঠলে দেখা যেত তার শরীরে কোনও রোগলক্ষণ নেই। লেডি মন্টেগু লক্ষ করেছিলেন, টিকাপ্রাপ্তদের মুখে বড় জোর কুড়ি-তিরিশটা দাগ দেখা দিত। কিন্তু আট দিনের মাথায় সে সুস্থ হয়ে উঠলে তার চিহ্নমাত্র থাকত না। তিনি লিখেছিলেন, প্রতি বছর কয়েক হাজার মানুষ এই চিকিৎসা প্রাপ্ত হতো। রোগটিও সবিশেষ ছড়াত না। চিঠিতে লেডি মন্টেগু লিখেছিলেন, “আমি এই নিরীক্ষায় আস্থাশীল। এটা নিরাপদ। আমি আমার শিশুপুত্রকেও এই টিকা দিয়েছি।” হ্যাঁ, তাঁর পুত্র কখনও বসন্ত রোগাক্রান্ত হয়নি।
নিজের ছেলেকেও টিকা দিয়েছিলেন লেডি মন্টেগু। —ফাইল চিত্র।
লেডি মন্টেগুর এই পর্যবেক্ষণের পরে কয়েক শতাব্দী কেটে গিয়েছে। আমরা জীববিজ্ঞান ও মহামারী-প্রতিরোধ বিদ্যায় অবিশ্বাস্য সব আবিষ্কার করেছি। তবু, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত অতিমারী আমাদের সামনে একটা প্রহেলিকা খাড়া করে রেখেছে। কেন এই রোগ তার প্রাথমিক ভরকেন্দ্র চিনের উহান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের ইটালিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল? যেখানে ভারতে তার বিস্তার নগণ্য বললেই চলে। কোন পশু বা জীবদের থেকে এই রোগ মানুষের শরীরে প্রথম সংক্রমিত হল?
কিন্তু তিনটি প্রশ্ন সবার আগে নজরে আসে। কারণ এগুলির উত্তর আমাদের চিকিৎসা পদ্ধতিকে, বিশেষ করে রোগীকে আইসোলেট করে চিকিৎসা করার পদ্ধতিটিকেই বদলে দিতে পারে। প্রথমত, আমরা ‘ডোজ-রেসপন্স কার্ভ’ বিষয়ে কতটা জেনেছি? সংক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় যদি রোগী এই জীবাণুর অধিকতর সংস্পর্শে আসে, তা হলে কী হবে? দ্বিতীয়ত, ভাইরাসের এই প্রাথমিক ‘ডোজ’ আর রোগের ভয়াবহতার মধ্যে কি কোনও সম্পর্ক রয়েছে—অর্থাৎ, রোগের সামনে যত বেশি যাওয়া যাবে, ততই কি বিপদের ঝুঁকি বাড়বে? এবং তৃতীয়ত, রোগাক্রান্তের শরীরে এই ভাইরাস কীভাবে কাজ করে, তার কোনও পর্যবেক্ষণ হয়েছে কি? অর্থাৎ, সংক্রমণের ওঠা-নামা সম্পর্কে কোনও সম্যক ধারণা রয়েছে কি, যা দিয়ে রোগের তীব্রতা নির্ধারণ করা যাবে এবং অন্যের শরীরে এর সংক্রমণের দ্রুততা বা মাত্রা কী হবে, তা নির্ণয় করা যাবে? কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রাথমিক দিনগুলোয় সংক্রমণের গতির দিকে আমরা লক্ষ রেখেছিলাম। মহামারী ছড়িয়ে পড়লে জনতার মধ্যে এই ভাইরাসের প্রকোপকেও আমরা মাপতে শুরু করেছি।
পরিসংখ্যানের অভাবের কারণে বেশির ভাগ এপিডেমিওলজিস্ট বাধ্য হয়ে এমন একটা মডেল অনুসরণ করছেন যে, এই নতুন করোনাভাইরাস একটা বাইনারি বিষয়—মানুষ হয় রোগে আক্রান্ত, নয়তো অনাক্রান্ত, রোগলক্ষণ যুক্ত মানুষ অথবা রোগলক্ষণ মুক্ত বাহক ইত্যাদি। সম্প্রতি ‘ওয়াশিংটন পোস্ট ‘ একটা অনলাইন সিমুলেশন প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে, একটা শহরে কিছু বিন্দু ঘোরা-ফেরা করছে। এই বিন্দুগুলি মানুষ। কিছু বিন্দু ধূসর রংয়ের আর কিছু লাল। ধূসর বিন্দুগুলি অ-সংক্রমিত আর লাল বিন্দুগুলি সংক্রমিত মানুষের প্রতীক। কোনও কোনও লাল বিন্দু আবার গোলাপিতে রূপান্ত্রিত হচ্ছে। এর অর্থ—তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু যখনই কোনও লাল বিন্দু কোনও ধূসর বিন্দুকে স্পর্শ করছে, সেই মুহূর্তে তা লাল হয়ে যাচ্ছে। এই ভাবে একসময়ে দেখা যায় পুরো ক্ষেত্রটাই (এখানে শহর) লাল বর্ণ ধারণ করছে। সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আর আইসোলেশন বিন্দুগুলিকে পরস্পরের কাছে আসতে বাধা দিচ্ছে। ফলে, ক্ষেত্রটির লাল হয়ে ওঠাটা বিলম্বিত হচ্ছে।
এটা একটা জনগোষ্ঠীর উপরে ভাইরাসের প্রকোপের একটা বার্ড’স আই পর্যবেক্ষণ। ‘আছে’ এবং ‘নেই’, ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর ভিত্তিতে দেখা। একজন চিকিৎসক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে, এই বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমি ভাইরাস ইমিউনোলজিতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। সেই বিন্দু থেকেই আমি জানতে চাই, এই বিন্দুগুলির মাঝখানে কী ঘটে চলেছে? লাল বিন্দুগুলিতে ভাইরাসের মাত্রাটা ঠিক কী? এক্সপোজারের মাত্রাটাই বা কেমন—ঠিক কতক্ষণ ‘সংস্পর্শে’ থাকলে সংক্রমণ নিশ্চিত? ঠিক কতক্ষণে একটা ধূসর বিন্দু লাল হয়ে থাকে, অর্থাৎ একজন মানুষের সংক্রমণের চরিত্র সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে বদলায়? এবং প্রতিটি সংক্রমণে রোগের তীব্রতা কেমন?
এডস, সার্স, গুটি বসন্ত ইত্যাদি সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলি নিয়ে চর্চা করে আমরা এই রোগগুলির জটিলতা সম্পর্কে জানতে পেরেছি, তাদের গতিবিধি এবং তাদের প্রতিরোধ সম্পর্কেও জানতে পেরেছি। ১৯৯০-এর দশকে গবেষকরা পরিমাপ করতে সমর্থ হন একজন আক্রান্তের শরীরে কী পরিমাণ এইচআইভি রয়েছে। একটা নিশ্চিত প্যাটার্ন এর ফলে উঠে আসে। সংক্রমণের পরে রক্তে ভাইরাসের পরিমাণ এক তুঙ্গ সীমায় পৌঁছয়, যাকে ‘পিক ভাইরেমিয়া’ বলা হয়। সর্বোচ্চ পিক ভাইরেমিয়া-যুক্ত রোগী দ্রুত অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁদের এই ভাইরাস প্রতিরোধের কমে আসে। এই তুঙ্গ অবস্থাটা যেমন বোঝা সম্ভব, তেমনই বোঝা সম্ভব এর ‘সেট পয়েন্ট’-কে, অর্থাৎ প্রাথমিক ভাবে তুঙ্গে পৌছনোর পরে ভাইরাস কাউন্ট কখন স্থিতাবস্থায় আসে। এ থেকে ভাইরাস ও তার মানব ‘হোস্ট’-এর মধ্যেকার গতিসাম্যও বোঝা যায়। যে সব মানুষের ‘সেট-পয়েন্ট’ বেশি, তাঁরা দ্রুত এডস আক্রান্ত হন। যাঁদের কম, তাঁদের ‘স্লো-প্রগ্রেসর’ বলা হয়। ভাইরাসের এই ‘ভার’-কে বাইনারি মূল্যে বোঝা যাবে না। এ থেকে রোগের প্রকৃতি, গতিবিধি এবং সংক্রমণ ক্ষমতা বোঝা যায়। প্রতিটি ভাইরাসের নিজস্ব চরিত্র রয়েছে। এইচআইভি-রও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বর্তমান। এ থেকে একটা ক্রনিক সংক্রমণ ঘটে এবং তা বিশেষ ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টিকারী কোষগুলিকে আক্রমণ করে। তেমনই অন্যান্য ভাইরাসগুলির আচরণের নিজস্ব প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়।
প্রতিরোধ-তত্ত্বের দিক থেকে দেখলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যদি আপনার শরীর আপনার বয়স, আপনার জিন বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য বিষয় অনুপাতে ভাইরাস আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে, তা হলে ধরতে হবে আপনার ‘সেট পয়েন্ট’ কম। যদি তা-ই হয়, তা হলে প্রশ্ন এই—সেই সব টিকা-প্রাপ্ত শিশুদের মতো প্রাথমিক ভাবে অল্প মাত্রার সংক্রমণ কি কম ‘সেট পয়েন্ট’-এ নিয়ে যায়? তেমন ক্ষেত্রে আপনার প্রতিরোধ শক্তি অধিক মাত্রায় রোগ সংক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, বিপুল মাত্রার সংক্রমণের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী ভাইরাস শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ঘাঁটি গেড়ে বসে। তখন সমস্যা গুরুতর হয়ে দাঁড়ায়।
ভাইরাল এক্সপোজারের গুরুত্ব এবং তার সামনে মানুষের প্রতিরোধহীনতা নিয়ে আমেরিকার সিয়াটেলে ফ্রেড হাচিনসন ক্যানসার রিসার্চ সেন্টার এবং ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক দল এক বিস্তারিত গবেষণা করেছে। ২০১৮-য় ব্রায়ান মেয়ার নামে এক এপিডেমিওলজিস্ট ও সংখ্যাতত্ত্ববিদ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জীববিজ্ঞানীদের একটি গবেষক দলে যোগ দেন। এই গবেষকরা এমন এক সমস্যা নিয়ে কাজ করছিলেন, যা রীতিমতো দুরূহ। মেয়ার মধ্য তিরিশের এক স্বল্পবাক ও মৃদুভাষী যুবক। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় জানিয়েছেন, “প্রাথমিক ডোজ থেকে প্রায়শই কিছু বোঝা যায় না। কারণ, কেউ সংক্রমিত হলেই বোঝা সম্ভব তিনি সংক্রমিত হয়েছেন।” বেশির ভাগ সংক্রামক রোগকেই একটু দূর থেকেই দেখা যায়। একজন রোগী যতক্ষণ না রোগাক্রান্ত হচ্ছেন, কিছু বোঝা সম্ভব নয়। ততক্ষণে সংক্রমণের মুহূর্তটি পার হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু গবেষকরা উগান্ডার কাম্পালায় এক অভাবনীয় উৎসের সন্ধান পেলেন এক দল সদ্যোজাত শিশু ও তাদের মা-দের মধ্যে। কয়েক বছর আগে সোরেন গান্ট নামের এক শিশু চিকিৎসক এই মহিলাদের পরীক্ষা করেন এবং এক বছর ধরে তাদের লালারস সংগ্রহ করেন। এ থেকে তাঁরা দেখতে পান, কতজন মহিলা এইচএইচভি-৬ নামের একটি ভাইরাসে আক্রান্ত, যা সদ্যোজাতের শরীরে জন্মের পরেই সংক্রমিত হয়। এই সংক্রমণে জ্বর দেখা দেয় এবং আক্রান্তের শরীর লাল দাগে ভরে যায়। এ থেকে বোঝা সম্ভব হয়, কী পরিমাণ ভাইরাস এক সদ্যোজাতকে আক্রান্ত করতে পারে। গান্ট, মেয়ার ও তাঁদের সহযোগীরা প্রথম থেকেই মানব শরীরে ভাইরাস সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বোঝার একটা পন্থা বের করেছিলেন। মেয়ার আমাকে জানান, “আমাদের পরিসংখ্যান এটা নিশ্চিত ভাবে জানায় যে, এইচএইচভি-৬ সংক্রমণের ক্ষেত্রে একটা ডোজ-রেসপন্স সম্পর্ক রয়েছে। আপনি যত বেশি ভাইরাস ছড়াবেন, তত বেশি মানুষ তাতে সংক্রমিত হবেন।” মহামারী তত্ত্বের দর্শনটাকে মেয়ার উলটে দিতে সমর্থ হন।
সংক্রমণের আর একটা প্রকারভেদ রয়েছে— ডাক্তারি পরিভাষায় যা ‘হোস্ট ইমিউন রেসপন্স’। ভাইরাস আক্রমণ আর দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা—এ দু’টি হল বিপরীতমুখী শক্তি। রাশিয়ান ইমিউনোলজিস্ট ইলিয়া মেচনিকফ বিংশ শতকের গোড়ায় বিষয়টিকে ‘স্ট্রাগল’ বা ‘সংগ্রাম’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁর বইয়ের জার্মান স্পংস্করণে যা ‘ক্যাম্ফ’ বলে চিহ্নিত। মেচনিকফ জীবাণু এবং প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে এক নিরন্তর লড়াইকে কল্পনা করেছিলেন। এই ‘ক্যাম্ফ’ আসলে জমি দখলের লড়াই। জীবাণুর ‘শক্তি’ কতখানি? তার বিপক্ষে কাজ করে জিনগত বৈশিষ্ট্য, এক্সপোজার, প্রতিরোধের ভিত্তি ইত্যাদি ‘হোস্ট ফ্যাক্টর’—তারাই বা কতটা সীমায়িত রাখতে পারে জীবাণুর আক্রমণ? এবং তার পর, এই প্রাথমিক সাম্যাবস্থা কোন দিকে ঢলতে শুরু করে, জীবাণুর দিকে না ‘হোস্ট’-এর দিকে?
এর পরের প্রশ্ন— কোনও বড় ধরনের ভাইরাল ‘ডোজ’ কি গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে কাজে আসে? এ ক্ষেত্রে লি ওয়েনলিয়াংয়ের উদাহরণ মনে রাখা প্রয়োজন। তেত্রিশ বছর বয়সের এই চিনা চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ কোভিড-১৯-এর প্রথম দিককার শিকার। তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে তোলা একটি ছবিতে তাঁর লাল হয়ে যাওয়া ঘর্মাক্ত মুখ, মাস্কের অন্তরালে তাঁর শ্বাস নেওয়ার আর্তি ভোলা সম্ভব নয়। আর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু জিয়া সিসি নামের এক ২৯ বছর বয়সি ডাক্তারের, যিনি উহানের ইউনিয়ন জিয়াংবেই হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ‘টাইমস’ পত্রিকা জানাচ্ছে আর এক চিনা স্বাস্থ্যকর্মীর কথা। ২৯ বছর বয়সি এই নার্স উহানে কাজ করতেন। তিনি এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাঁর দৃষ্টিবিভ্রম শুরু হয়। তাঁর মনে হতে থাকে, তিনি যেন মৃত্যুর কিনারে বিচরণ করছেন।
কুড়ি থেকে তিরিশ বছর বয়সি যাঁরা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁরা একটা সীমিত জ্বর-জাতীয় অসুস্থতাই বোধ করছেন—প্রাথমিক সংক্রমণের পরিমাপ থেকে কি এ কথা ধরে নেওয়া যায়? আমেরিকার দু’জন ই আর চিকিৎসক, যাঁরা জরুরিকালীন চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওয়াশিংটন স্টেটের বাসিন্দা একজনের বয়স চল্লিশের কোঠায়। উহান এবং ইটালির পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্য মৃত্যুর হার কম। কিন্তু এর মানে কি তাঁদের একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম চেহারায় এই সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে? কারোর কারোর ক্ষেত্রে তা ভয়াবহ আকার নিচ্ছে? বেলোর কলেজ অফ মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং টিকা-বিষয়ক বিজ্ঞানী পিটার হোটেজ সিএনএন-কে জানিয়েছেন—“আমরা জানি, এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু, কী ভাবে প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা অল্পবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তা আমরা সঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।” অন্যান্য ভাইরাস নিয়ে গবেষণা হয়েছে। পশুদের উপরে ইনফ্লুয়েঞ্জার সংক্রমণ নিয়ে নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সংক্রমণের প্রকাশের পরিমাপ সম্ভব। দেখা গিয়েছে, যে সব ইঁদুরকে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের অধিক মাত্রায় ডোজ দেওয়া হয়েছিল, তারা সেই রোগে বেশি কাবু হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও বলা যায়, ডোজ ও রোগের মাত্রার পারস্পরিকতা একেকটির ক্ষেত্রে একেক রকম ভাবে দেখা দিয়েছে।
(কৌতূহলের বিষয় এই যে, একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গিয়েছে, শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী রেসপিরেটরি সিনসাইশিয়াল ভাইরাসে্র প্রাথমিক সংক্রমণ তুলনামূলক ভাবে কম তীব্র আকার নিচ্ছে। আবার অন্য একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, তা শিশুদের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।)
করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা যেটুকু জেনেছি তা হল এই যে, এই ভাইরাস ইনফ্লুয়েঞ্জার প্যাটার্ন অনুসরণ করতে পারে। ২০০৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সার্স সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস, যাকে কোভিড-১৯-এর ‘ভাই’ বলা চলে, তা প্রাথমিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে কণ্ঠনালীর গভীরে অবস্থিত ন্যাসোফ্যারিংস অঞ্চলে ক্রিয়াশীল ছিল, যা থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের ভাবহ অসুখ ঘটতে পারে। প্রায় সমস্ত সার্স রোগী, যাঁরা অপেক্ষাকৃত কম মাত্রায় বা বোঝা যায়নি এমন মাত্রায় সংক্রমিত হয়েছিলেন ন্যাসোফ্যারিংসে, তাঁরা দু’মাসের চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে যান এবং তাঁরা এখনও জীবিত রয়েছেন। কিন্তু যাঁদের সংক্রমণের মাত্রা বেশি ছিল, তাঁদের মধ্যে মৃত্যু-হার ছিল ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। এই প্যাটার্ন রোগীদের বয়স ও অন্যান্য শর্ত নিরপেক্ষ ভাবে অনুসৃত হয়েছে। আর একটি ভাইরাস-ঘটিত অসুখ ক্রিমিয়ান-কঙ্গো হেমোরেজিক জ্বরের ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্তে আসা গিয়েছে। গোড়ায় সংক্রমণের মাত্রা যত বেশি থাকবে, তত দ্রুত মৃত্যুর দিকে রোগী এগিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘এটা দয়ালু ভাইরাস, তবু মৃত্যুর সংখ্যা বিরাট দাঁড়াতে পারে, সাবধান!’
সংক্রমণের মাত্রা আর সংক্রমিত রোগের মধ্যেকার সব থেকে জোরালো সম্পর্ক দেখা গিয়েছে সম্ভবত হামের মতো অসুখ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে। রোটারডামের ইরাসমাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস বিশেষজ্ঞ রিক ডে সোয়ার্ট আমাদের সাবধান করে জানিয়েছেন, “হাম আর কোভিড-১৯ দু’টি সম্পূর্ণ পৃথক রোগ, সম্পূর্ণ পৃথক দু’টি ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট এবং এই ভাইরাস দু’টির চরিত্রও আলাদা। কিন্তু, হামের ক্ষেত্রে প্রাথমিক সংক্রমণের সঙ্গে রোগের মাত্রার সম্পর্ক স্পষ্ট। এবং যদি প্রতিরোধ তত্ত্বের দিক থেকে বিষয়টিকে দেখা যায়, তো বোঝা যাবে ভাইরাস আর প্রতিরোধ ক্ষমতার মধ্যে একটা দৌড় প্রতিযোগিতা চলছে। যে সব ভাইরাস তাদের লক্ষ্য কোষগুলিকে পেয়ে গিয়েছে তাদের সঙ্গে প্রতিরোধ সংবেদের একটা প্রতিযোগিতা। যদি শুরুতেই ভাইরাস শক্তিশালী হয়ে থাকে, তা হলে রোগের মাত্রাও বাড়বে।”
১৯৯৪-এর একটি সমীক্ষা থেকে সোয়ার্ট দেখিয়েছেন, গবেষকরা কিছু বাঁদরের শরীরে বিভিন্ন মাত্রায় হামের ভাইরাস প্রবেশ করান। দেখা যায়, যাদের শরীরে বেশি মাত্রায় তা প্রবিষ্ট হয়েছিল, তাদের রক্তে ভাইরাসের পরিমাণও বেশি। মানুষের ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণটি পাওয়া যায় আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির দক্ষিণে অবস্থিত দেশগুলি থেকে। সোয়ার্ট জানান, “বাড়ির লোক মারফত যদি কেউ হামে আক্রান্ত হন, যেখানে সংক্রমণের মাত্রাটি সব থেকে বেশি, যদি আপনি রোগাক্রান্ত শিশুর সঙ্গে এক বিছানায় থাকেন, তা হলে রোগের মাত্রাও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু যদি খেলার মাঠ থেকে কোনও শিশু এই রোগে সংক্রমিত হয়, তা হলে রোগের মাত্রা তুলনামূলক ভাবে কম থাকে।’’
আরও পড়ুন: এক বছর ৩০% বেতন পাবেন না মন্ত্রী-সাংসদরা, নেবেন না রাষ্ট্রপতি-রাজ্যপালরাও
আমি সংক্রমণের এই বিষয়টি নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাস তত্ত্ববিদ ও রোগ প্রতিরোধ বিশেষজ্ঞ ড্যান বারোচের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। বারোচের গবেষণাগারে সার্স-কোভ-২-এর টিকা নিয়ে কাজ চলছে। এই ভাইরাস থেকেই কোভিড-১৯-এর জন্ম। বারোচ আমাকে জানান, মেকাক প্রজাতির বাঁদরদের উপরে এ বিষয়ে সমীক্ষা চলছে। যা থেকে সার্স-কোভ-২-এর প্রাথমিক টিকা প্রদান এবং পরে তাদের ফুসফুসে ভাইরাসের সংক্রমণের তুলনা করে দেখা হচ্ছে। তাঁর মতে, এদের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকতেও পারে। সোয়ার্ট বললেন, “ মানুষের ক্ষেত্রে যদি এই যুক্তি অনুসরণ করি, আমরা একই সম্পর্ক দেখতে পাব। এবং এই যুক্তি অনুসারে অধিক মাত্রার ভাইরাস রোগের মাত্রাকেও বাড়াবে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই এই মুহূর্তে অনুমানের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাথমিক ডোজ ও রোগের তীব্রতার মধ্যেকার সম্পর্ক এখনও পর্যবেক্ষণ-সাপেক্ষ।“
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর নিয়ে ভাবা যাক। আমরা কি কোনও কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর আক্রমণের মাত্রাকে ট্র্যাক করে রোগের গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করতে পারি? আক্রান্তের শরীরে সার্স-কোভ-২-এর কাউন্ট বিষয়ে আমাদের আরও গবেষণার প্রয়োজন। একটি অপ্রকাশিত জার্মান সমীক্ষায় লক্ষণ-যুক্ত এবং লক্ষণ-রহিত—দু’রকমের রোগীর লালারসে অবস্থানরত ভাইরাসের পরিমাণ মাপা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এটা জানানো হয়েছিল যে, লক্ষণ-রহিত রোগীদের শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ লক্ষণ-যুক্তদের তুলনায় সামান্য বেশি ছিল। কিন্তু সেই সময়ে মাত্র সাত জন রোগীকে সমীক্ষা করা হয়েছিল। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল ভাইরোলজির ডিরেক্টর সান্ড্রা সিসেকের অধীনে এই সমীক্ষা চলছিল। সান্ড্রা আমাকে জানালেন, বেশি সংখ্যক রোগীর উপরে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখা গেল, এই দুই প্রকার আক্রান্তের মধ্যে ভাইরাসের পরিমাণগত তেমন কোনও পার্থক্য সবিশেষ নেই। “লালারস পরীক্ষা করে আমরা কোনও অন্তর্সম্পর্ক জানতে পারিনি”, তিনি বলেন। লালারসে ভাইরাসের পরিমাণ নির্ণয়ের সমস্যা বিষয়ে তিনি জানান, “কী অবস্থায় ওই লালা সংগৃহিত হয়েছিল, সেই প্রাক-বিশ্লেষণী অবস্থার উপরেও বিষয়টা অনেকখানি নির্ভরশীল।“
তাঁর মতে লালারসের সংগ্রহের পদ্ধতির উনিশ-বিশ ঘটলেও পরীক্ষায় বিরাট ফারাক চলে আসে। “রক্তে ভাইরাসের পরিমাণের উপরে রোগের মাত্রাও নির্ভর করে, এটা সত্য।“ এ কথা তিনি স্বীকার করেছেন। ফ্রেড হাচিনসন সেন্টারের ক্লিনিক্যাল ভাইরোলজিস্ট এবং এইচএইচভি-৬ সংক্রান্ত সমীক্ষার সহ-গবেষক জোশুয়া স্নিফার দেখাচ্ছেন, শ্বাসরোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের ক্ষেত্রে নাক থেকে সংগৃহিত লালায় ভাইরাসের পরিমাণ স্থিতিশীল থাকে এবং এই পরিমাণের সঙ্গে রোগের লক্ষণ ও গতিপ্রকৃতির সম্পর্কও ভাল ভাবে বোঝা যায়। মার্চ মাসে ‘দ্য ল্যানসেট ইনফেকশাস ডিজিজেস’-এ অনলাইনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ইউনিভার্সিটি অফ হংকং এবং ন্যানচ্যাং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের এক দল দেখিয়েছেন, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীদের নাক থেকে সংগৃহিত লালা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, সেখানে ভাইরাসের পরিমাণ মৃদু ভাবে আক্রান্তদের তুলনায় ষাট শতাংশ বেশি।
পৃথিবী জুড়ে করোনাভাইরাসের দাপট অব্যাহত। এই পরিস্থিতিতে আমরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব যে, কী করে এক্সপোজারের তীব্রতা আর ভাইরাসের পরিমাণ কোভিড-১৯-এর নিরাময়ের পথ দেখাতে পারে। উপর থেকে দেখা ‘বার্ডস আই ভিউ’-এর সঙ্গে নীচ থেকে দেখা ‘ওয়র্মস আই ভিউ’-কেও সংযুক্ত করে দেখব, কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আমরা রোগী, হাসপাতাল এবং জনসাধারণকে নিয়ন্ত্রণ করার পন্থা বদলাতে পারি।
এক্সপোজার ইন্টেনসিটি আর সংক্রমণ—এই দুইয়ের সম্পর্ক দিয়েই শুরু করা যাক। যাঁরা রেডিয়েশন নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের আমরা কীভাবে মনিটর করি, ভাবা যাক। রেডিয়েশন ডোসিমেট্রি দিয়ে আমরা কারোর এক্সপোজারকে সামগ্রিক ভাবে মেপে থাকি। সেই অনুযায়ী তার উপরে সীমা আরোপ করি। আমরা এই মুহূর্তে জানি, চিকিৎসক ও নার্সদের পক্ষে মাস্ক, গ্লাভস, গাউন ইত্যাদি ‘বর্ম’ ব্যবহার করে কোভিড-১৯-এর অতিমারী ঠেকানো কতটা সমস্যাজনক। বিশেষ করে যেখানে এই সব সামগ্রীর অভাব রয়েছে, সেখানে তা রীতিমতো কঠিন। এমন ক্ষেত্রে আমরা এক্সপোজারের সামগ্রিক খতিয়ান রাখতে পারি এবং ভাইরাল ডোসিমেট্রি নিয়ন্ত্রণ করে দেখতে পারি একজন ব্যক্তি কী করে প্রবল ভাবে সংক্রমিত রোগীদের সংস্পর্শ এড়াতে পারেন।
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত ২৬ নার্স, ৩ চিকিৎসক, ‘সংক্রামক’ ঘোষিত হাসপাতাল
ডোজ ও রোগের তীব্রতার মধ্যে একটা সম্পর্ক নির্ণয় রোগীর সুশ্রুষায় কাজে আসতে পারে। যদি আমরা লক্ষণ দেখা দেওয়ার আগেই রোগীকে বিপুল পরিমাণ ভাইরাসের সম্মুখীন হওয়ার সময়ে চিহ্নিত করতে পারি, অর্থাৎ এমন লোক যিনি একাধিক রোগাক্রান্তের সঙ্গে মেলামেশা করছেন অথবা এমন নার্সদের পর্যবেক্ষণে রাখতে পারি, যাঁরা ভয়ানক ভাবে রোগাক্রান্তদের সেবা করছেন, তা হলে হয়তো আমরা রোগের তীব্রতর পরিস্থিতিকে আগে থেকে ধরতে পারব। এবং সেই সঙ্গে সীমিত সাধ্যের চিকিৎসা-সামগ্রী দিয়ে দ্রুত এবং ফলপ্রদ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সমর্থ হবো।
এবং, পরিশেষে যদি আমরা ভাইরাসের পরিমাণের দিকে সঠিক ভাবে নজর রাখতে পারি, তা হলে কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের চিকিৎসার পদ্ধতি বদলে যেতে পারে। খুব কম খরচে এবং সহজলভ্য গবেষণাগারেই এই সূচক পরিমাপ করা সম্ভব। একটি দ্বি-স্তরীয় পদ্ধতির কথা ভাবা যাক—এক, আক্রান্ত রোগীদের, বিশেষ করে সেই সব রোগীর, যাদের চূড়ান্ত স্তরের চিকিৎসা প্রয়োজন তাদের প্রথমে চিহ্নিত করা হোক। দুই, তাদের নাক অথবা শ্বাসনালী থেকে লালা সংগ্রহ করে তাতে ভাইরাসের পরিমাণ দেখা যাক। ভাইরাস কাউন্ট এবং চিকিৎসা পদ্ধতির অন্তর্সম্পর্ক চিকিৎসা বা আইসোলেশনের প্রকৌশলে পরিবর্তন আনতে পারে।
পরিমাণগত নিরীক্ষার এই দৃষ্টিভঙ্গি নিরাময় সংক্রান্ত চর্চাতেও ব্যবহারযোগ্য। যখন কোনও ওষুধ পরীক্ষামূলক ভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন যে রোগীর অবস্থা সঙ্কটপূর্ণ নয়, তাঁর থেকেই অধিক তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটলে চিকিৎসাও থমকে দাঁড়ায়। আর যদি তেমন রোগীদের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রোগলক্ষণের উপরে নির্ভর না করে ভাইরাসের পরিমাণগত বিন্দু থেকে চিকিৎসা করা হয়, তা হলে তা তুলনামূলক ভাবে অনেক সহজ ও অনেক যথাযথ হবে বলে মনে হয়।
আমরা এটাও জানতে চাই, যাঁরা সংক্রমণ থেকে মুক্ত হলেন, তাঁরা কি সার্স-কোভ-২-এর প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করলেন এবং তাঁদের থেকে কি আর সংক্রমণ ঘটবে না? এমন লোকদের ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় লক্ষণীয়। তাঁরা সংক্রমণ ছড়াচ্ছেন কি না তার হিসেব রাখা প্রয়োজন। এবং তাঁদের রক্তে প্রতিরোধ ক্ষমতার চিহ্ন ঠিক কতটা (অ্যান্টিবডি টেস্টের ফলে জানা যেতে পারে) জানা দরকার। দ্বাদশ শতকে চিনের লোকেরা গুটি বসন্তের ক্ষেত্রে এমনটাই আবিষ্কার করেছিলেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মীরা এই ওষুধের ক্ষেত্রে বিশেষ ইঙ্গিত বহন করেন। চূড়ান্ত ভাবে সংক্রমিত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তাঁরা যদি সংক্রমিত না হন, তা হলে বিষয়টা বোঝা যাবে।
আমার কাজের ক্ষেত্র ক্যানসারের চিকিৎসা। এই ক্ষেত্রে পরিসংখ্যান গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিউমারের আয়তন, সংক্রমিত জায়গার সংখ্যা, কেমোথেরাপির পরে ম্যালিগন্যান্ট অংশের সংকোচন ইত্যাদির হিসেব আমাদের রাখতে হয়। আমরা ‘রিস্ক স্ট্র্যাটিফিকেশন’ ( রোগীর স্বাস্থ্য অনুযায়ী বিচার করে) এবং ‘স্ট্র্যাটিফিকেশন অফ রেসপন্স’ ( রোগী চিকিৎসায় কতটা সাড়া দিচ্ছেন, সেটা বিচার করে) সিদ্ধান্ত নিই। প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে আধ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় কাটিয়ে আমি তাঁদের ঝুঁকির জায়গাটা বোঝাই, বোঝাতে চেষ্টা করি নিরাময় কী ভাবে পরিমাপ করা হয় এবং চিকিৎসার একটা পরিকল্পনা তৈরি করি।
এর উলটো দিকে অতিমারী একটা অন্য ব্যাপার। তার সঙ্গে প্যানিকের অঙ্গাঙ্গী যোগ। ক্যাওসের রাজত্ব। ইটালির চিকিৎসকরা চটজলদি কাজ চলানোর মতো ওয়ার্ডে অস্থায়ী বিছানায় শায়িত রোগীকে আইভি ড্রিপ দিচ্ছেন অস্থায়ী খুঁটিতে বোতল ঝুলিয়ে। এমন অবস্থায় পরিসংখ্যান গ্রহণ—ভাইরাল-লোড টেস্টিং ইত্যাদি ভাবা সম্ভব নয়। কিন্তু এই দুঃসময়ে আমরা মাথা ঠান্ডা রেখে ঝুঁকির বিষয়টা ভাবতে পারি, যতটুকু রসদ আমাদের হাতে রয়েছে, তার কার্যকর প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারি।
‘এপিডেমিওলজি’ অভিধাটিতে রয়েছে ‘এপি’ এবং ‘ডেমস’ শব্দ দু’টি। যার অর্থ ‘মানবের ঊর্ধ্বে’। এটা একটা আগ্রাসনের বিজ্ঞান, বহুজনের বিজ্ঞান। তা সত্ত্বেও ওষুধের সাহায্যে এর মোকাবিলা করা যায়, যা একক মানুষের বিজ্ঞান। যেদিন সকালে আমি কলকাতার সেই শীতলা মন্দিরে গিয়েছিলাম, মহামারী নিরাময়কারিণী সেই দেবীর কাছে নিরাময়ের আর্জি নিয়ে এসেছিলেন এক মা যাঁর সন্তান সপ্তাহকাল জ্বরে ভুগছে। দেবী সেই মায়ের কাছে একান্ত জন। কোভিড-১৯-এর সঙ্গে এই সংগ্রামে জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ভাইরাসের গতিপ্রকৃতি বোঝাটা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও জানা প্রয়োজন, এক জন রোগীর ক্ষেত্রে তার গতিপ্রকৃতি কেমন। কারণ, ‘এক’ থেকেই ‘বহু’ জন্মায়। দু’দিক থেকেই বিষয়টা দেখা দরকার ।
করোনাভাইরাস অতিমারীর একটি গাইডলাইন—
• রোগাক্রান্ত আত্মীয় থেকে খাবার অর্ডার করার ক্ষেত্রে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং কী ভাবে অভ্যেস করা যায়।
• কীভাবে এক অতিমারীর কালে আমাদের অভ্যস্ত রীতিনীতির বদল ঘটানো যায়।
• করোনাভাইরাসের সংক্রমণকে কীভাবে আবদ্ধ ও প্রশমিত করা যায়।
• বিশ্বের ঠিক কতটা কোয়রান্টিন করা উচিত?
•ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সময়ে কী ভাবছেন।
•টিকা আবিষ্কারের আগেই এক বছরেরও বেশি সময় এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
•মনে রাখা দরকার, আমরা সকলেই অকারণ উদ্বেগের শিকার।
•রোমে কী ভাবে করোনাভাইরাস দখল নিল, তা সভয়ে লক্ষ করা।
•কী ভাবে অতিমারী ইতিহাসকে বদলায়, তার সাক্ষী থাকা।