পরীক্ষায় পাশ করতে আইনস্টাইনের চেয়ে একটু কমই সময় নিলেন স্টিফেন হকিং!
মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম হদিশ পেতে লেগেছিল পাক্কা ১০০টা বছর। আর হকিং পাশ করলেন ৪২ বছর পর। ‘ব্ল্যাক হোলস আর নট সো ব্ল্যাক’, প্রমাণিত হল পরীক্ষামূলক ভাবে। হাতে-কলমে, আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের গবেষণাগারে। যার তাত্ত্বিক উচ্চারণটা হকিং প্রথম করেছিলেন ১৯৭৪ সালে।
ওই সময় কিংবদন্তী তুল্য বিজ্ঞানী হকিং অঙ্ক কষে দেখিয়েছিলেন, আলো সহ ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই শুষে নেয় বলে যে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরকে আমরা ‘কৃষ্ণকলি’ কালো বলে জানতাম, তা তত কালো নয়। কৃষ্ণগহ্বর থেকেও আলোর বিচ্ছুরণ, বিকিরণ হয়। তা যতই অল্প হোক। কিন্তু হাতেকলমে প্রমাণিত না হলে, বিজ্ঞানে কোনও কিছুই গ্রহণীয় হয় না পুরোপুরি। এমনকী পরোক্ষ প্রমাণ মিললেও, নয়। যার জন্য মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বলে কিছু সত্যি-সত্যিই রয়েছে কি না, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিতকাবাদে বলা সেই তরঙ্গের প্রমাণ পেতে আমাদের যায় ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
হকিং-এর ৪২ বছর আগেকার তাত্ত্বিক উচ্চারণকে যিনি পরীক্ষামূলক ভাবে প্রমাণ করেছেন বলে দাবি, তাঁর নাম জেফ স্টেনহাওয়ার। হাইফার ‘টেকনিওন-ইজরায়েল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’র জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-ফিজিক্স’-এ, সোমবার। স্টেনহাওয়ার গবেষণাগারে শব্দ তরঙ্গ (যার কণার নাম- ‘ফোনন’) দিয়ে একটি ব্ল্যাক হোলের প্রতিরূপ বানিয়ে দেখিয়েছেন, সেখান থেকে কিছু কিছু বিকিরণ বেরিয়ে আসতে পারে। ঠিক যেমনটি বলেছিলেন হকিং প্রায় অর্ধ শতক আগে। তাঁর পরীক্ষা-পদ্ধতি নিয়ে বিজ্ঞানীদের একাংশে কিছুটা সংশয় থাকলেও, স্টেনহাওয়ারের দাবি সঠিক হলে, তা অনিবার্য ভাবেই অনেকটা এগিয়ে দেবে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানকে।
প্রায় অর্ধ শতক আগে ব্ল্যাক হোল নিয়ে কী ভাবে ওই সাড়াজাগানো তাত্ত্বিক উচ্চারণটা করেছিলেন হকিং?
শুরুটা হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের একটা গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ‘কোয়ান্টাম তত্ত্ব’ থেকে। যে তত্ত্ব বলছে, আলোর কণা ‘ফোটন’-এর জোড়াগুলো এক বার দেখা দিচ্ছে তো পরের বার হারিয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটা হয়েই চলেছে, বিরামহীন। আর সেটা হয়ে চলেছে গোটা ব্রহ্মাণ্ডেই। খাবার থালার যেমন কানা থাকে, তেমনই ব্ল্যাক হোলেরও থাকে ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’। কিছু খেয়ে আমরা যেমন এঁটোকাঁটা থালার কানা বা কিনারে ফেলে রাখি, তেমনই তার ‘ইভেন্ট হরাইজনে’ও কিছু ‘উচ্ছিষ্ট’ ছড়িয়ে রাখে ব্ল্যাক হোল। আর এই ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’ এমন একটা চৌহদ্দি, যেখান থেকে ব্ল্যাক হোলের ‘টান’ (অভিকর্ষ হল) কাটিয়ে বেরিয়ে আসার গতি (এসকেপ ভেলোসিটি) আলোর গতির চেয়েও অনেকটা বেশি হয়। তাই ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না আলোও। সেই জন্যই কৃষ্ণগহ্বর এত কালো।
হকিং তাঁর তত্ত্বে বলেছিলেন, একটা ফোটন-জোড়া (দু’টো ফোটন কণা) ‘ইভেন্ট হরাইজ্নে’ এলে পোঁছলে একটা ফোটন ব্ল্যাক হোলের ভেতরে ঢুকে যায়। অন্য ফোটনটা ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে। সেই জন্যই ব্ল্যাক হোল থেকে অল্প বিকিরণ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই ‘হকিং রেডিয়েশন’-ই এক সময় সাড়ে সর্বনাশ ডেকে আনবে ব্ল্যাক হোলের। কারণ, অন্য কোনও ভাবে ব্ল্যাক হোল তার ভর বাড়াতে না পারলে এই বিকিরণের ফলেই ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাবে। তার পর এক দিন হয়ে যাবে বেমালুম উধাও।
হকিং-এর বিকিরণ অবশ্য একটা ধাঁধারও জন্ম দিয়েছে। সেটা কী?
কোয়ান্টাম তত্ত্ব বলছে, এই ব্রহ্মাণ্ডে তথ্যের (ইনফর্মেশন) কোনও বিনাশ হয় না। তা শক্তির (এনার্জি) মতোই। তাই যদি হয়, তা হলে যে ফোটন কণাটা ‘ইভেন্ট হরাইজ্ন’-এ এসে ব্ল্যাক হোলের টানে তার ভেতরে ঢুকে যায়, তার সঙ্গে কিছুটা তথ্যও তো ঢুকে যাবে ব্ল্যাক হোলে। হারিয়ে যাবে চির দিনের জন্য।
তা হয় না কেন?
হকিং তার যা জবাব দিয়েছিলেন, স্টেনহাওয়ারও তাঁর হাতেকলমে পরীক্ষায় সেটাই করে দেখিয়েছেন বলে দাবি। মানে, যে ব্ল্যাক হোলের ভেতরে ঢুকে গিয়ে হারিয়ে গেল বরাবরের মতো, সেই ফোটন কণাটি তার বয়ে নিয়ে আসা তথ্যটিকে দিয়ে যায় সেই ফোটন কণাকে, যে ব্ল্যাক হোলের ‘খিদে’র হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। এ যেন সেই মা, যিনি আত্মঘাতী হওয়ার আগে তাঁর কোলের শিশুকে অন্যের হাতে ছুঁড়ে দিয়ে যান!
তবে স্টেনহাওয়ারের এই বক্তব্য মানতে চাননি অনেক পদার্থবিদই।
আরও পড়ুন- অস্ত্রোপচার ছাড়াই এ বার বাইপাস!