—প্রতীকী ছবি।
দু’জনেরই লিভার ক্যানসার। একই চিকিৎসা চলছিল। এক জন সুস্থ হলেন, অন্য জনের কাজই দিল না। ক্যানসার চিকিৎসায় বহু বার এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন ডাক্তারেরা। তার কারণ, রোগ একই হলেও রোগের চরিত্র ভিন্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্যানসারের ক্ষেত্রে ‘পার্সোনাইলজ়ড’ চিকিৎসা প্রয়োজন। অর্থাৎ রোগীবিশেষে চিকিৎসা আলাদা। কিন্তু তার জন্য ক্যানসারের চরিত্র জানতে হবে। যে পথ করে দিচ্ছে ‘ক্যানসার অর্গানয়েড’। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বসু জানাচ্ছেন, এই পদ্ধতিতে তাঁরা ইতিমধ্যেই কাজ করেছেন। গবেষণাগারে সাফল্যও পেয়েছেন হাতেনাতে।
এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে ‘অর্গানয়েড’ নিয়ে বহু গবেষণা চলছে। ‘নেচার’ পত্রিকায় একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। শুধু ক্যানসার নয়, অটিজ়ম, অ্যালঝাইমার্স, ডিমেনশিয়ার মতো রোগের নিরাময়ের সন্ধান চলছে ‘ব্রেন অর্গানয়েড’ তৈরি করে। অর্গানয়েড শব্দটির মধ্যেই রয়েছে অর্গান বা অঙ্গ। বিষয়টা এ রকম: হিউম্যান অর্গানয়েড হল যে কোনও মানব অঙ্গের ক্ষুদ্র প্রতিলিপি। রোগীর শরীরের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, ল্যাবে তার একটি প্রতিলিপি তৈরি করে তাতে রোগের পর্যবেক্ষণ।
বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এত দিন গবেষণাগারে যে ‘সেল কালচার’ করা হত, সেখানে দ্বিমাত্রিক কোষ নিয়ে কাজ হত। এই কোষগুলি জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড। এমনিতে কোষের নির্দিষ্ট আয়ু আছে, তার পরে তা মরে যায়। জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড কোষ মরে না। গবেষণার জন্য এগুলিকে ব্যবহার করা হত। কিন্তু তাতে মানব শরীরের সমস্ত জটিলতা বোঝা যায় না। তা ছাড়া, প্রি-ক্লিনিক্যাল গবেষণার ক্ষেত্রে দ্বিমাত্রিক সেল কালচারের ব্যবহার পরবর্তী ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। অর্গানয়েড নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে মানব কোষ ব্যবহার করা হয়। যেমন, ক্যানসার অর্গানয়েডের ক্ষেত্রে রোগীর নিজস্ব ক্যানসার কোষকে গবেষণাগারে কালচার করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কোষগুলি দ্বিমাত্রিক নয়, ত্রিমাত্রিক আকারে বাড়তে থাকে। ল্যাবে একটি ত্রিমাত্রিক কোষসমষ্টি তৈরি হতে থাকে, যা মানুষের শরীরে হওয়া রোগের মতোই প্রতিলিপি তৈরি করতে থাকে। এ ভাবে শরীরে ক্যানসার কোষ কী ভাবে বাড়ে বা ছড়ায়, তার একটা বিশদ ধারণাপাওয়া যায়।
‘ফ্রন্টিয়ারস ইন অঙ্কোলজি’ জার্নালের একটি রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, রোগী-বিশেষে ক্যানসার অর্গানয়েড চিকিৎসা পদ্ধতি প্রি-ক্লিনিক্যাল ও ট্রান্সলেশনাল গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। অরিন্দম জানিয়েছেন, তাঁরা কোনও ক্যানসার রোগীর বায়োপসির সময়ে সংগৃহীত নমুনা থেকে ক্যানসার কোষ নিয়ে ল্যাবে অর্গানয়েড তৈরি করেছিলেন। এগুলির চরিত্র হুবহু রোগীর দেহে উপস্থিত ক্যানসার কোষগুলির মতোই। তাঁরা পর্যবেক্ষণ করেন, কী ভাবে ক্যানসার কোষ বাড়ছে। ক্যানসারের চরিত্র নির্ধারণ করেন। এর পরে ‘হাই থ্রুপুট ড্রাগ স্ক্রিনিং’ করেন। বিষয়টা এমন: ক্যানসার সংক্রমণ রোধে বাজারে উপস্থিত ওষুধগুলি ওই অর্গানয়েডে প্রয়োগ করেন বিজ্ঞানীরা। এ ভাবে তাঁরা ল্যাবে চিহ্নিত করেন, কোন ওষুধটি ওই রোগীর জন্য কাজ দিচ্ছে। একেই বলে ‘পার্সোনালাইজ়ড’ ট্রিটমেন্ট।
কলকাতার ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই পার্সোনালাইজ়ড ক্যানসার ট্রিটমেন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনও আমরা বিশেষ বায়োপসির সাহায্যে রোগীর ক্যানসার চরিত্র বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা এতটা বিশদে বোঝা যায় না। ক্যানসার অর্গানয়েডের মাধ্যমে যদি চিকিৎসা শুরু করা যায়, তা হলে আরও অনেক বেশি কার্যকরী হবে।’’
অরিন্দম বলেন, ‘‘আমেরিকাতেও এই চিকিৎসা পদ্ধতি এখনও সরকারি অনুমোদন পায়নি। তবে একাধিক গবেষণা চলছে। বিশেষজ্ঞেরা চাইছেন, এটাই ‘স্ট্যানডার্ড অব কেয়ার’ বা ক্যানসার চিকিৎসার নির্দিষ্ট পদ্ধতি হোক। তাতে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বহু রোগীর প্রাণ বাঁচবে।’’