বিজ্ঞানের ইতিহাসে আজকের দিনটা লাল কালিতে চিহ্নিত হল। ওয়াশিংটনে ‘ইউএস ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন’-এর উদ্যোগে আয়োজিত সাংবাদিক বৈঠকে বিজ্ঞানী ডেভিড রিৎজ আজ ঘোষণা করলেন, ‘‘আমরা মহাকর্ষ-তরঙ্গের খোঁজ পেয়েছি।’’
ওই ঘোষণায় বিশ্বজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীদের উল্লাসের ভাগীদার হলেন ভারতীয় গবেষকেরাও। পরোক্ষে নয়, প্রত্যক্ষ ভাবে। ওয়াশিংটনের ওই সাংবাদিক বৈঠক সরাসরি দেখানো হচ্ছিল এখানে ‘ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউসিএএ)’-র চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়ামে। ওয়াশিংটনে ঘোষণার কয়েক মিনিট পরেই দিল্লি থেকে টুইট করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্ববিজ্ঞানের ওই সাফল্যকে অভিনন্দন তো জানালেন। সঙ্গে সঙ্গেও এ-ও বললেন, ‘‘এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা যুক্ত ছিলেন। এটি আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আশা করি, মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করার জন্য উন্নতমানের যন্ত্র বানিয়ে এই কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন আমাদের বিজ্ঞানীরা।’’
আরও পড়ুন- মহাকর্ষ তরঙ্গের অন্য অজানা উৎস জানতে ভারতের মুখ চেয়ে বিশ্ব
মোদীর এই টুইট আইইউসিএএ-র নির্দেশক সোমক রায়চৌধুরী ঘোষণা করা মাত্র হাততালিতে ভরে গেল চন্দ্রশেখর অডিটোরিয়াম।
কী ঘটল বিজ্ঞানের দুনিয়ায়, যা নিয়ে এত শোরগোল?
আরও এক বার পরীক্ষায় পাশ করলেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। হ্যাঁ, আরও এক বার অগ্নিপরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেন তিনি। বুঝিয়ে দিলেন, মহাবিশ্বকে ভাল ভাবে চিনতে হলে কেন দ্বারস্থ হতে হবে শুধু তাঁরই। কেন আইজ্যাক নিউটনের ভাবনার আশ্রয়ে সবটা চেনা যাবে না।
পৃথিবীজুড়ে পদার্থবিজ্ঞানীরা উল্লসিত। বিজ্ঞানের ইতিহাসে ২০১৬-র ১১ ফেব্রুয়ারি গণ্য হল ‘রেড লেটার ডে’ হিসেবে।
যেমন হয়েছিল চার বছর আগে ৪ জুলাই। যে দিন জেনেভার কাছে সার্ন গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন ‘ঈশ্বরকণা’র অস্তিত্ব। যে কণা না থাকলে ব্রহ্মাণ্ডে কোনও বস্তু ভারী হতো না। আর আজ? ওয়াশিংটনের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন, মহাশূন্যে ধুন্ধুমার ঘটনা ঘটলে (প্রচণ্ড ভারী দু’টি নক্ষত্রের একে অন্যকে চক্কর কিংবা দু’টো ব্ল্যাকহোলের সংঘর্ষ এবং মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া), সে সব থেকে চার দিকে এক ধরনের তরঙ্গ বা ঢেউ ছড়ায়। যার নাম মহাকর্ষ-তরঙ্গ।
মহাকর্ষ-তরঙ্গ যে শনাক্ত হয়েছে, সে রকম গুজব কিছু দিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল। ইন্টারনেটও ছয়লাপ হচ্ছিল এ বিষয়ের উপর নানা ব্লগে। কিন্তু পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা কিছুতেই মুখ খুলছিলেন না। অবশেষে আজ সব গুজবের অবসান ঘটিয়ে গবেষকেরা জানালেন, সত্যি সত্যিই যন্ত্রে ধরা পড়েছে ওই তরঙ্গের অস্তিত্ব।
বিজ্ঞানী রিৎজ জানালেন, ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে সূর্যের থেকে ২৯ গুণ এবং ৩৬ গুণ ভারী দু’টো ব্ল্যাকহোল একে অন্যের সঙ্গে মিশে একটা ব্ল্যাকহোলে পরিণত হওয়ার সময় ওদের চারপাশে ‘স্পেসে’ যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছিল, তা গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর পৃথিবীর যন্ত্রে ধরা পড়েছিল। রিৎজ বলছিলেন, ‘‘সত্যিই কি তার সঙ্কেত পেয়েছি আমরা? জানতে ডেটা চেক এবং রি-চেক করেছি কয়েক মাস ধরে। তারপর নিঃসন্দেহ হয়ে আজ ঘোষণা করছি আমাদের সাফল্য।’’
এমন তরঙ্গের অস্তিত্ব যে থাকতে পারে, তা জানা গিয়েছিল ঠিক ১০০ বছর আগে, আইনস্টাইনের ‘জেনারেল রিলেটিভিটি’-র তত্ত্ব থেকে। তত্ত্বে থাকলে কী হবে, বাস্তবে সেই তরঙ্গের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে লাগল ১০০ বছর! চেষ্টা যে আগে হয়নি তা নয়। প্রথমে বিক্ষিপ্ত ভাবে, তার পর গত দু’দশক ধরে গভীর ভাবে। সেই চেষ্টা, এবং কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের ফল মিলল এত দিনে। গবেষণা একেই বলে! বিজ্ঞানীরা তো উল্লসিত হবেনই।
উল্লসিত ভারতীয় গবেষকেরাও। যে বিশাল পরীক্ষায় শনাক্ত হল মহাকর্ষ-তরঙ্গ, তাতে সামিল এ দেশের অনেক বিজ্ঞানী। তবে শুধু বিশ্বভ্রাতৃত্বের অজুহাতে নয়, আরও বড় কারণে ভারতীয় গবেষকেরা উল্লসিত। যে সাফল্য মিলেছে আমেরিকায়, তার পিছনে এ দেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের অবদান যে অনেক! একশো বছর লাগে যার খোঁজ পেতে, তা যে জটিল বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তা বলাই বাহুল্য। মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করতে তৈরি করতে হয়েছে অতি জটিল যন্ত্রপাতি। মাথা খাটিয়ে বার করতে হয়েছে ফাঁদ পাতার কৌশল। যে কৌশলে শনাক্ত হল মহাকর্ষ-তরঙ্গ, তা ১৯৮০-র দশকে বাতলেছিলেন দুই ভারতীয় বিজ্ঞানী-ই— সঞ্জীব ধুরন্ধর এবং বি সত্যপ্রকাশ।
উৎসাহের আরও একটি বড় কারণ আছে। যে পরিকল্পনায় আমেরিকায় শনাক্ত হল মহাকর্ষ-তরঙ্গ, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই ভারতেই যন্ত্র তৈরি করে ও এ ব্যাপারে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। এই জন্য ১২৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রায় দু’বছর ধরে অনুমোদনের অপেক্ষায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর টেবিলে পড়েছিল। আজ জানা গিয়েছে, সেই প্রকল্প অনুমোদন করার প্রক্রিয়া সরকারি স্তরে শুরু হয়ে গিয়েছে।
সে কারণে ওয়াশিংটনে সাফল্যের ঘোষণার পরেই এই শহরে আইইউসিএএ-তে মহাসমারোহে ব্যাখ্যা করা হল সদ্য এই আবিষ্কারের তাৎপর্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অনেক ভারতীয় বিজ্ঞানী। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান সত্যপ্রকাশ। তিনি আজ না থাকলেও আজ হাজির ছিলেন প্রবীণ বিজ্ঞানী সঞ্জীব ধুরন্ধর। আর ছিলেন সেই ভারতীয় বিজ্ঞানী সি ভি বিশ্বেশ্বর। যিনি সেই ১৯৭০-এর দশকে বলেছিলেন যে, দু’টো ব্ল্যাকহোল মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে।
নতুন আবিষ্কারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে আইইউসিএএ’-র নির্দেশক সোমক রায়চৌধুরী বললেন, ‘‘এক দিক থেকে দেখলে, মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করা ঈশ্বরকণা বা হিগস-বোসন কণা আবিষ্কারের থেকেও এটা বড় সাফল্য।’’ কেন? সোমকবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘হিগস-বোসন যে আছেই, সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ছিল না। অপেক্ষা ছিল শুধু তা খুঁজে পাওয়ার।’’ তবে মহাকর্ষ-তরঙ্গ যে আছেই, সে ব্যাপারে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী নিশ্চিত ছিলেন না, জানাচ্ছেন সোমকবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আইনস্টাইনের ‘জেনারেল রিলেটিভিটি থিওরি’র ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রে ঠিকঠাক করা হচ্ছে না বলে মনে করতেন অনেকে। সে রকম একটি জিনিসের অস্তিত্ব প্রমাণ সত্যিই বড় সাফল্য।’’ আইইউসিএএ-র আর এক বিজ্ঞানী তরুণ সৌরদীপ অনুষ্ঠানে জানালেন মহাকর্ষ-তরঙ্গ সন্ধানে এখন প্রায় ১০০ জন ভারতীয় গবেষক কাজ করছেন।
ঠিক কী ভাবে শনাক্ত হল মহাকর্ষ-তরঙ্গ?
উত্তর পেতে ওই তরঙ্গ কী থেকে জন্মায়, তা বোঝা দরকার। আর জানা দরকার মহাকর্ষ সম্পর্কে নিউটন ও আইনস্টাইনের ব্যাখ্যার ফারাক। নিউটন বলেছিলেন, মহাকর্ষ হল দুই বস্তুর মধ্যে অদৃশ্য আকর্ষণ বল। আইনস্টাইনের মতে, মহাকর্ষ তা নয়, মহাকর্ষ আসলে অন্য ব্যাপার। কী? যে কোনও বস্তু নিজের চারপাশে শূন্যস্থান বা ‘স্পেস’-কে দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। তার মানে, মহাকর্ষ আসলে শূন্যস্থান বা ‘স্পেস’-এর জ্যামিতির খেলা। নিউটনের মতে, সূর্য পৃথিবীকে কাছে টানতে চায় বলে পৃথিবী তার চারদিকে ঘোরে। আর আইনস্টাইনের ব্যাখ্যায়, সূর্যের উপস্থিতিতে তার চারপাশের ‘স্পেস’ যে দুমড়ে-মুচড়ে যায়, সেই ‘স্পেস’-এর মধ্যে দিয়ে চলার সময় পৃথিবীর গতিপথ বেঁকে যায়।
এ বার ধরা যাক, কোনও কারণে সূর্যটা হঠাৎ আকাশ থেকে উধাও হয়ে গেল! নিউটনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সূর্য উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী সেই নিরুদ্দেশের খবর পাবে এবং সে কক্ষপথ পাল্টে দূরে হারিয়ে যাবে। আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, তা ঘটবে না। সূর্যের নিরুদ্দেশের খবর পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গে পাবে না। সে খবর আসবে তরঙ্গের মাধ্যমে, এবং তা আসতে কিছুটা হলেও সময় লাগবে। ওই ঢেউ-ই মহাকর্ষ-তরঙ্গ। মহাশূন্যে প্রচণ্ড ভারী বস্তুর হঠাৎ নড়াচড়ার ফলে ওই ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়।
সোমক বললেন, ‘‘আইনস্টাইন এবং নিউটনের তত্ত্বের মধ্যে কোনটা ঠিক, তা নির্ধারণ করার পক্ষে মহাকর্ষ-তরঙ্গ অনুসন্ধান একটা বড় পরীক্ষা।
আইনস্টাইন ওই তরঙ্গের কথা বলেছিলেন। নিউটন তা বলেননি।’’
তা হতে পারে। তবে সত্যিটা এই যে, আইনস্টাইন নিজেও প্রথম দিকে মহাকর্ষের অস্তিত্ব মানতে চাননি। পরে অবশ্য তিনি নিজের তত্ত্বের ওই ফলাফল মেনে নেন। এই মানামানির ব্যাপারে আইনস্টাইনের ভাবনা-চিন্তা কিন্তু বিচিত্র। আইনস্টাইন মানতে চাননি যে, ব্ল্যাক হোল বাস্তব বিশ্বে থাকতে পারে।
ঢেউয়ের ফলে ‘স্পেস’ কাঁপে। মানে আয়তনে এক বার বড় এবং এক বার ছোট হয়ে যায়। যে হেতু ঢেউয়ের জন্ম পৃথিবী থেকে হাজার-হাজার আলোকবর্ষ দূরে, তাই তার প্রভাব যখন পৃথিবীতে পৌঁছয়, তখন তা ক্ষীণ হয়ে যায়। ওই ক্ষীণতাই মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করার প্রধান অন্তরায়। পৃথিবীতে আছে নানা রকম ঝাঁকুনি— ভূমিকম্প, ভারী ভারী ট্রাকের গতি, এমনকী সমুদ্রের ঢেউ পা়ড়ে আছড়ে পড়ার ঘটনা। তার মাঝখান থেকে পৃথিবীতে পৌঁছনো অতিক্ষীণ মহাকর্ষ-তরঙ্গ শনাক্ত করা খুব কঠিন কাজ। অতি সংবেদশীল যন্ত্রের সাহায্যে সেটাই আমেরিকায় করছেন বিজ্ঞানীরা।
কী ভাবে করছেন?
যে প্রকল্পে কাজ হয়েছে, তার নাম ‘লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজার্ভেটরি’ (এলআইজিও)। আমেরিকার লিভিংস্টোন এবং হ্যানফোর্ড শহরে চার কিলোমিটার লম্বা দু’টো ফাঁপা পাইপের দৈর্ঘ্য লেজার-রশ্মির সাহায্যে মেপেছেন বিজ্ঞানীরা। মাপতে গিয়ে দেখেছেন, গত ১৪ সেপ্টেম্বর যখন দু’টো ব্ল্যাক হোল মিশে গিয়ে মহাকর্ষ-তরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল, তখন ওই চার কিলোমিটার আর চার কিলোমিটার ছিল না। বেড়ে-কমে গিয়েছিল। অর্থাৎ, স্পেসের আয়তন বাড়ছিল এবং কমছিল।
বিজ্ঞানীরা উল্লসিত, কারণ এ বার থেকে নতুন এক ‘চোখে’ দেখা যাবে মহাবিশ্বকে। আগে দেখা যেত শুধু কোনও ঘটনা থেকে আসা আলোর সাহায্যে। এ বার দেখা যাবে একেবারে নতুন আর এক উপায়ে। এত দিন মহাবিশ্ব যেন ছিল শুধু এক নাটক, যাতে অভিনেতাদের শুধু মঞ্চে আসা-যাওয়া ঠাহর হতো। এ বার থেকে যেন শোনা যাবে তাঁদের কথাবার্তাও।