Science News

মহাপ্রলয় আসন্ন? আট দশকেই জলমগ্ন হবে অধিকাংশ মহাদেশ: রাষ্ট্রপুঞ্জ

গত ১০০ বছরে সমুদ্র যতটা উপরে উঠে এসেছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের দৌলতে সাগর, মহাসাগরগুলির জলস্তর আগামী ১০০ বছরে তার প্রায় ৪০ গুণ উপরে উঠে আসবে।

Advertisement

সুজয় চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:৪২
Share:

ছবি- সংগৃহীত।

মহাপ্রলয়ের আর খুব একটা দেরি নেই! বড়জোর ৮০টা বছর! তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের এই পৃথিবীর প্রায় পুরোটাই ২১০০ সালের মধ্যে চলে যাবে সাগর, মহাসাগরের তলায়! এমনটাই বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট।

Advertisement

গত ১০০ বছরে সমুদ্র যতটা উপরে উঠে এসেছে, বিশ্ব উষ্ণায়নের দৌলতে সাগর, মহাসাগরগুলির জলস্তর আগামী ১০০ বছরে তার প্রায় ৪০ গুণ উপরে উঠে আসবে। যা কার্যত, ডুবিয়ে দেবে প্রায় গোটা পৃথিবীকেই। অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের জন্য পৃথিবীর গায়ের ‘জ্বর’ (তাপমাত্রা) বাড়বে এখনকার হিসেবের চেয়ে আরও এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। তাপমাত্রা বেড়ে যাবে আরও তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা মেরুর বরফ এতটাই গলিয়ে দেবে যে, সেই বরফ-গলা জল সমুদ্রের এখনকার জলস্তরকে আরও প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে তুলে দেবে।

আমাদের সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের অশনি সঙ্কেত মিলেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউনাইটেড নেশন্স এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম বা ‘ইউএনইপি’)-র সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টে। ‘এমিশন্‌স গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৮’ শীর্ষক রাষ্ট্রপুঞ্জের ১১২ পাতার ওই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে গত ২৭ নভেম্বর।

Advertisement

সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ১০০ বছরে (১৮৯৭ থেকে ১৯৯৭) সমুদ্রের জলস্তর উঠে এসেছে ৭.১ ইঞ্চি বা ১৮ সেন্টিমিটার। বিভিন্ন উপগ্রহের পাঠানো তথ্যাদি জানাচ্ছে, সমুদ্রের জলস্তর বিশেষ করে উঠে এসেছে গত ২৪ বছরে। ১৯৯৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সমুদ্রের জলস্তর উঠে এসেছে ৩ ইঞ্চি বা সাড়ে ৭ সেন্টিমিটার। তার মানে, আগের ৭৫ বছরের প্রায় অর্ধেক।

এও বলা হয়েছে, গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কমিয়ে পৃথিবীর গায়ের জ্বর ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে না দেওয়ার জন্য ১৩ বছর আগে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যে লক্ষ্য়মাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, আমেরিকা ২০৩০ সালের মধ্যে তা ছুঁতে পারবে না। তবে এ ব্যাপারে ভারতের পদক্ষেপ সন্তোষজনক। চিনও খুব একটা পিছিয়ে নেই।

রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই রিপোর্ট যে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ছবি তুলে ধরেছে গবেষণা, উপগ্রহের পাঠানো ছবি ও তথ্য-পরিসংখ্যানের মাধ্যমে, তাতে পৃথিবীর গায়ের জ্বর যদি আরও ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তা হলে ২১০০ সালের মধ্যে, সেই অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলস্তর উঠে আসবে একলাফে ১৬ ফুট বা ৫ মিটার। যার মানে, গত ১০০ বছরে সমুদ্রের জলস্তর যতটা উঠে এসেছিল, তার খুব কাছাকাছি। আর পৃথিবীর গায়ের জ্বর যদি আরও ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তা হলে ২১০০ সালের মধ্যে, সেই অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের জন্য সমুদ্রের জলস্তর উঠে আসবে একলাফে ২০ ফুট বা ৬.০৯৬ মিটার। যার অর্থ, গত ১০০ বছরে উষ্ণায়নের জন্য যতটা উঠে এসেছে সমুদ্রের জলস্তর, আর ৮০ বছরের মধ্যে সেই সাগর, মহাসাগর তার ৪০ গুণ ফুলে-ফেঁপে উঠবে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট জানিয়েছে, বিশ্বের এই অনিয়ন্ত্রিত উষ্ণায়নের জন্য দায়ী মূলত চিন, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি ও ভারতের বড় ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্র ও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভর যানবাহন। যা স্থলে, জলে, বাতাসে উদ্বেগজনক ভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাস (জিএইচজি)-এর পরিমাণ।

সমুদ্রের জলস্তর কতটা উঠে আসতে পারে? দেখুন নাসার ভিডিয়ো

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত অর্জুন রঙ্গনাথন বুধবার ওয়াশিংটন থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলেছেন, ‘‘এই রিপোর্টে আমরা তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছি, গোটা বিশ্বে গত বছরে (২০১৭) যে পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি হয়েছে, তার ২৬.৮ শতাংশের জন্য দায়ী চিন। ১৩.১ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস তৈরি করেছে আমেরিকা। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলিতে ওই গ্যাস তৈরি হয়েছে ৯ শতাংশ। আর বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের ৭ শতাংশ হয়েছে ভারতে।’’

রঙ্গনাথন এও জানিয়েছেন, গত বছর গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদনের নিরিখে ভারতের পরেই রয়েছে রাশিয়া (৪.৬%), জাপান (৩%), ব্রাজিল (২.৩%), ইন্দোনেশিয়া (১.৭%), কানাডা ও দক্ষিণ কোরিয়া (১.৬% করে)।

আরও পড়ুন- ৬৫ পয়সায় ১ লিটার! সমুদ্রের জলেই এ বার তৃষ্ণা মেটানো যাবে​

আরও পড়ুন- মেয়েদের কাছে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’ নিজেদের ঘরই! বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্ট​

তবে আগামী ১০০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যাতে আরও দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস না বড়ে, তার জন্য ২০০৫ সালের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ১৯৪টি দেশকে যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, চিন, আমেরিকার মতো বিশ্বের প্রথম সারির গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপাদক দেশগুলি আর ১২ বছরের মধ্যে (২০৩০) সেই লক্ষ্যমাত্রায় আদৌ পৌঁছতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্টই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ওই রিপোর্টে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কর্মসূচির উপদেষ্টা কমিটির আর এক সদস্য, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাইমেট সায়েন্স বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ চৌধুরী বলছেন, ‘‘যেটা খুবই উদ্বেগজনক, তা হল, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে গোটা বিশ্বে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের পরিমাণ প্রায় একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেও, টানা তিন বছর পর, গত বছরেই (২০১৭) তা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আর তা সবচেয়ে বেশি হয়েছে আমেরিকায়। তার পরেই রয়েছে চিন। এ ব্যাপারে এগিয়ে থাকা দেশগুলি যে পদ্ধতিতে ওই গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ কমানোর নীতি নিয়েছে, তাতে আগামী বছরে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বিশ্বে আরও বাড়বে। অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনকে তাই আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’’

ধ্রুবজ্যোতি এও জানিয়েছেন, অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদন ও তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা গত এক বছরে বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়েছে। আর জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভরতা ছেড়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি পথে নামানোর ব্যাপারে চিনের সক্রিয়তাও দৃষ্টান্তমূলক।

তবে আমেরিকা যে নীতি নিয়েছে, তাতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যে লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেশ সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না বলেই জানিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের সাম্প্রতিক রিপোর্ট।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক-তথ্য: রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘এমিশন্‌স গ্যাপ রিপোর্ট, ২০১৮’

ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement