ফ্রেজার স্টডার্ট।
কলকাতা শহরে পার্কে সিমেন্টের বা লোহার স্লিপ থাকে। বাচ্চারা তার পিছনের সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, স্লিপ বেয়ে আবার নেমে আসে। ধরুন, আপনার বাচ্চা স্লিপে উঠে ওইখানে দাঁড়িয়ে রইল। আপনি কী করবেন?
প্রথমে খানিক ক্ষণ অপেক্ষা করবেন, তার পর ভুলিয়ে-ভালিয়ে নামতে বলবেন, তার পর বকবেন। বকুনি শুনে যে-ই সে স্যাট করে নেমে এল স্লিপ বেয়ে, আপনি সেই ‘দুষ্টু’ বাচ্চাকে বগলদাবা করে চললেন বাড়ি। অর্থাৎ, মাটিতে নেমে আসার পর বাচ্চাটি সাম্যাবস্থায় এল। এবং আপনার মেজাজও। যত ক্ষণ সে স্লিপের ওপরে চড়ে ছিল, তত ক্ষণ আপনার মেজাজও ছিল অসাম্যে, আপনি ছিলেন টেনশনে।
এ বার ধরুন, গ্রিক পুরাণে বর্ণিত সিসিফাসের কথা। সিসিফাস ছিলেন অভিশপ্ত। পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ত (অসাম্য থেকে সাম্য) এবং সিসিফাসকে আবার সেই পাথর পাহাড়চূড়ায় নিয়ে যেতে হত (সাম্য থেকে অসাম্য)। এই অসাম্যের প্রক্রিয়া চলছেই, অনন্তকাল ধরে। পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী ইলিয়া প্রিগোজিন প্রথম বলেন তাপগতিবিদ্যার প্রচলিত সাম্যাবস্থার ধারণার বাইরেও যাওয়া সম্ভব। তিনি বলেছিলেন, নন-ইকুইলিব্রিয়াম থার্মোডায়নামিক্সের কথা। ২০১৬ সালে রসায়নে নোবেল জয়ের বক্তৃতায় জেমস ফ্রেজার স্টডার্টের মুখেও শোনা গিয়েছিল একই সুর, “আমাদের সাম্যাবস্থার রসায়ন থেকে এগিয়ে অসাম্যের রসায়নের দিকে যেতে হবে।’’
স্যর জেমস-এর বয়স ৭০ পেরিয়েছে। সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন তাঁর নর্থ-ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষণাগারের এক ছাত্রের বিয়ের অনুষ্ঠানে। পাত্রের বাবার অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতিতে স্টডার্টই কার্যত ভূমিকা নিয়েছিলেন অভিভাবকের। অর্ডন্যান্স ক্লাবের এক টেবিলে বসে সাম্য থেকে অসাম্যের রসায়নে যাত্রার গল্প বলছিলেন তিনি।
স্টডার্টের গবেষণায় জীবজগতের প্রভাব প্রবল। নিজেই বলছিলেন, গত একশো-দেড়শো বছরে আমরা যা আবিষ্কার করেছি প্রযুক্তিবিদ্যায়, তার অধিকাংশই জীবজগতের থেকে অনুপ্রাণিত, যেমন এরোপ্লেন, সাবমেরিন, জাপানের বুলেট ট্রেনের ইঞ্জিনের আকারের নকশা। মানবদেহের প্রতিটি কোষের একটি গুরুত্বপূর্ণ কোষ অঙ্গাণু হল মাইটোকন্ড্রিয়া, যাকে পড়ুয়ারা জেনে আসে কোষের শক্তিঘর হিসেবে। বিজ্ঞানে অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিমাত্রেই কোষের মধ্যেকার শক্তির রূপান্তর নিয়ে আগ্রহী। স্টডার্টও ব্যতিক্রম নন। তাঁর উৎসাহের কারণ হল প্রক্রিয়াটি আসাম্য রসায়ন নির্দেশ করে।
কোষে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়াতে তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুসারে, শক্তি সৃষ্টি হয় না, কেবলমাত্র রাসায়নিক শক্তি থেকে কোষের ব্যবহার্য শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। মাইটোকন্ড্রিয়ার দেওয়ালে বসে থাকে কোষের সিসিফাস— ইলেকট্রন ট্রান্সপোর্ট চেন কমপ্লেক্স (ইটিসি), আমাদের খাবার থেকে আসা গ্লুকোজ জারিত হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশ প্রাণিবিদ পিটার মিচেল তাঁর গবেষণায় অঙ্কের মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন, কেবলমাত্র নির্দিষ্ট দূরত্বে বসে থাকা ইটিসি-র প্রোটিনই এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। এই ব্যাপারটি একটি নন-ইকুইলিব্রিয়াম প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া সাম্যাবস্থায় পৌঁছয় এক বারই, মৃত্যুর সঙ্গে।
স্টডার্ট নিজের গবেষণাগারে প্রতি দিনই এই সাম্য-অসাম্যের খেলায় মেতে থাকেন। সঙ্গে ছাত্ররাও। তিনি নিজে যে রাসায়নিক যৌগটি নিয়ে কাজ করেন, তার নাম রোটাক্সেন। এই রোটাক্সেনের পলিমার (একাধিক পরমাণু জুড়ে তৈরি যৌগবিশেষ) বানানোর প্রক্রিয়া আবিষ্কারের জন্যই তিনি বিখ্যাত হন। আমরা, নব্বইয়ের দশকে যাদের জন্ম, ছোটবেলায় একটা খুব সহজ খেলনা দেখেছি। একটা লোহার বাঁকানো তারে একটা রিং গলানো থাকত। পাজ়লটা ছিল লোহার তার না বেঁকিয়ে, রিং না তারে ঠেকিয়ে, শুধুমাত্র বুদ্ধি খাটিয়ে রিং-টা তার থেকে বের করে আনা। স্টডার্টের রোটাক্সেন তৈরির কাজটাও এই তারে রিং পরানোর প্রক্রিয়ার মতোই। রিং-টি মেকানিক্যাল বন্ড-এর সাহায্যে তারের ওপর বসে। এই বন্ডের মূল উপাদান কিন্তু আয়নীয় বন্ধনী এবং কোভ্যালেন্ট বন্ধনীই। রিং-টি তারের ওপর সরতে সরতে একটি রাসায়নিক স্পিডব্রেকারে আটকে যায়, রিঙের দুটি পরমাণুর ঋণাত্মক চার্জ গ্রহণের মাধ্যমে কেবলমাত্র রিং সেই স্পিডব্রেকার অতিক্রম করতে পারে। গাড়ির তেল ভরার মতো রিং গ্রহণ করে দুটি ইলেকট্রন। ফের জারণ এবং বিজারণের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে।
একটা চলতি খেলনার ধারণা থেকে এক্কেবারে নোবেল জয়ের মতো গবেষণা। ছেলেবেলায় কি তিনিও এই ধরনের খেলনা নিয়ে খেলেছিলেন? এই প্রশ্ন করতেই প্রবীণ বিজ্ঞানীর চোখ চকচক করে ওঠে। শিশুর মতো গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন তাঁর ছোটবেলার কথা। ১৯৪২ সালে এডিনবরার কাছে এক ছোট গ্রামে চাষি পরিবারে স্টডার্টের জন্ম। স্কটল্যান্ডের সংস্কৃতি অনুযায়ী তিনি যান পারিশের স্কুলে। পারিশ হচ্ছে চার্চের অধীনে থাকা ছোট ছোট জায়গা। সেই স্কুলে পাঁচ জন পড়ুয়ার মধ্যে চার জনই মেয়ে, আর সে যুগে স্কটল্যান্ডে প্রাইমারি স্কুলেই মেয়েদের উল বোনার হাতেখড়ি হত। জেমসের জন্য নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি। জেমস উল বোনা শিখলেন। ভবিষ্যতে যিনি রোটাক্সেনের বুনন আবিষ্কার করবেন, তার বীজ বোনা হয়ে গিয়েছিল উল বোনার হাত ধরেই।
তত দিনে শেষ হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে তার নিদর্শন তখন গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে। ভাঙা জিপ, অচল স্পার্ক প্লাগ, ইঞ্জিনের মাথা। দুই দশক আগেও মফস্সলের বাঙালি ছেলেপুলেরা যেমন ভাঙা লোহা-লক্কর নিয়ে খেলতে খেলতে বড় হত, স্টডার্টেরও বড় হয়ে ওঠাটা অনেকটা এক রকম। সেই সঙ্গে সেল্টিক সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত গিঁট, শিকল ইত্যাদিতে উৎসাহ তো ছিলই। পরে যখন তিনি রসায়নের অধ্যাপক, সুইডেনের এক বিরাট হলে ডাক পড়ল তাঁর। নোবেল প্রাইজ় নেওয়ার জন্য। তিনি বানিয়ে ফেলেছিলেন এক অদ্ভুত জিনিস— সেই তারের মধ্যে রিং পরানো। ছোটবেলার উল বোনা, অচল জিনিস নিয়ে খেলাই যে তাঁর ভবিষ্যতে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রাসায়নিক মেশিন নিয়ে খেলার ভিত গড়ে দিয়েছিল, তা স্বীকার করেন নোবেলজয়ী।
স্টডার্টের বর্তমান গবেষণার পুরোটা জুড়েই রয়েছে মলিকিউলার মেশিন, রাসায়নিক অণুকে কাজে লাগিয়ে ছোট ছোট যন্ত্র তৈরি। এই যন্ত্রগুলি যে খালি চোখে দেখা যায় না, ন্যানোমিটারে মাপতে হয়, তা অবশ্য বলে দিতে হয় না। ঠিক কী ভাবে কাজ করে এই মলিকিউলার মেশিন? বানানোর সময় কোন তাত্ত্বিক প্রয়োজন মাথায় থাকে? এ সব নিয়ে কথা হচ্ছিল ছাত্রের বিয়ের মণ্ডপে।
বিজ্ঞানপাগল অধ্যাপক স্থান-কাল-পাত্র বিচার না করেই হাতের কাগজ প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে আঁকতে শুরু করলেন। ছবির বিষয়বস্তু সেই দুষ্টু বাচ্চার স্লিপে চড়া ও নেমে আসা, সাম্য ও অসাম্যের খেলা।
স্টডার্টের পিএইচ ডি-র সুপারভাইজর ছিলেন আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর ল্যাংলি হার্স্ট। ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড-এ সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় স্টডার্ট উল্লেখ করেছিলেন মেন্টরশিপের কথা, যা তিনি শিখেছিলেন হার্স্টের কাছ থেকে।
তা হলে নোবেল প্রাইজ় না মেন্টরশিপ, কোনটাতে আপনি বেশি খুশি? আমার প্রশ্ন শুনে কালবিলম্ব না করে স্টডার্ট উত্তর দিলেন, ‘‘আমি ৫০টি দেশের ৫০০ জন ছাত্র তৈরি করেছি। আপনার কি মনে হয় না, এরাই আমার সন্তান? আমার ছাত্ররাই আমার উত্তরাধিকার। শুধু আমার নয়, বিজ্ঞানেরও উত্তরাধিকার ওরাই। তাই সব সময়েই হতে চেয়েছি এক জন মেন্টর। নোবেল প্রাইজ প্রাপক হিসাবে খ্যাতি সেই মেন্টরশিপের শিরোপায় পালকমাত্র।’’
ছবি: লেখক