ধূমকেতু শুরিয়ামোভ-গেরাশিমেঙ্কো। ছবি সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি।
এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনার হদিশ মিলল। ধূমকেতুর চার পাশে এক ধরনের জ্যোতির্বলয় দেখা গেল এই প্রথম।
জানা গেল, পৃথিবীতে আমরা যাকে ‘অরোরা’ বা মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা বলি, সেই একই ঘটনা ঘটে ধূমকেতুতেও। তবে যেটা পৃথিবীতে খুব ভাল ভাবে দেখা যায় শুধু দুই মেরুতেই, সেই অরোরা এ বার দেখা গেল ধূমকেতুর সর্বত্র।
এসা, নাসার যুগলবন্দি
ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (‘এসা’) মহাকাশযান ‘রোসেটা’র পাঠানো ছবি ও তথ্যাদি বিশ্লেষণ করেই এই বিরল মহাজাগতিক ঘটনার হদিশ মিলেছে ‘৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কো’ ধূমকেতুতে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে গত সোমবার আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার অ্যাস্ট্রোনমি’-তে।
আজ থেকে ৬ বছর আগে এই ধূমকতুতেই প্রথম পা ছুঁইয়েছিল মানবসভ্যতা। যদিও নামার সময় ধূমকেতুর পিঠের খাঁজে আটকে পড়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ল্যান্ডার ‘ফিলি’। যে যন্ত্রের মাধ্যমে ধূমকেতু ৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কোর অরোরার প্রথম হদিশ মিলেছে সেটি বানানো হয়েছে নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবরেটরি (জেপিএল)-তে। তার নাম ‘মাইক্রোওয়েভ ইনস্ট্রুমেন্ট ফর রোসেটা অরবিটার (মাইরো)’।
গ্রহ, উপগ্রহ ছাড়া অন্য কোথাও অরোরা এই প্রথম
গবেষকরা জানিয়েছেন, কোনও গ্রহ, উপগ্রহ ছাড়া এই প্রথম কোনও মহাজাতিক বস্তু থেকে অরোরার মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বেরিয়ে আসার ঘটনা দেখা সম্ভব হল।
তরঙ্গদৈর্ঘ আর কম্পাঙ্কের ভেদাভেদে আলোক-বর্ণালীতে দৃশ্যমান আলো ছাড়াও থাকে আল্ট্রাভায়োলেট রে বা অতিবেগুনি রশ্মি ও ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত রশ্মি। অতিবেগুনি রশ্মির কম্পাঙ্ক সবচেয়ে বেশি (সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ) আর অবলোহিত রশ্মির কম্পাঙ্ক সবচেয়ে কম (সবচেয়ে বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ)। দৃশ্যমান আলোয় যেমন সাতটি রং থাকে তেমনই নানা রং থাকে অতিবেগুনি ও অবলোহিত রশ্মিতেও। তবে সেগুলির কোনওটিকেই খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়।
৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কো ধূমকেতু
গবেষকরা জানিয়েছেন, ৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কো ধূমকেতুতে যে অরোরা দেখা গিয়েছে, তার আলো অতিবেগুনি রশ্মির সুদূর প্রান্তে (‘ফার-আলট্রাভোয়ালেট রে’)।
এই ধূমকেতুতেই প্রথম পা ছুঁইয়েছিল সভ্যতা
কোনও ধূমকেতুতে প্রথম পা ছোঁয়ানোর জন্য এসা-র রোসেটা মহাকাশযানের উৎক্ষেপণ হয়েছিল ২০০৪ সালে। টানা ১০ বছর ধরে মহাকাশে ছুটে রোসেটা ধূমকেতু ৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কোর কক্ষপথে ঢুকে পড়ে ২০১৪-য়। তার পর রোসেটায় থাকা ল্যান্ডার ‘ফিলি’ ধূমকেতুতে পা ছোঁয়ায় ২০১৬-র সেপ্টেম্বরে।
‘ভেবেছিলাম ডে-গ্লো, পরে ভুল ভাঙে’: মারিনা গালান্দ
মূল গবেষক ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক মারিনা গালান্দ ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বলেছেন, ‘‘আমরা প্রথম ঘটনাটিকে ভেবেছিলাম নিছকই ‘ডে-গ্লো’। দিনে সূর্যের আলো পড়লে বরফ, পাথর আর নানা ধরনের গ্যাসে ভরা ধুমকেতুর গ্যাসের কণা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সেখান থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার সময় সেই গ্যাস বিকিরণের জন্ম দেয়। এটাই ‘ডে-গ্লো’। কিন্তু পরে রোসেটায় থাকা নাসার অন্যান্য যন্ত্রপাতির দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করেই আমাদের ভুল ভাঙে। বুঝতে পারি ওটা মোটেই ডে-গ্লো নয়। ওটা আদতে অরোরা। অতিবেগুনি রশ্মি। যা জ্যোতির্বলয়ের মতো গোটা ধূমকেতুটিকেই ঘিরে রাখে। ধূমকেতুর সর্বত্রই তা দেখা যায়। অতিবেগুনি রশ্মি বলে পৃথিবীর অরোরার মতো তা খালি চোখে দেখা যায় না।’’
মারিনা টেলিফোনে এও জানিয়েছেন, এই আবিষ্কার আগামী দিনে আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে সৌরবায়ুতে থাকা কণাগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে বদলে যায় মহাকাশে দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়। কী ভাবে সেগুলি বদলে যায় কোনও গ্রহ, উপগ্রহ বা অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুতে পৌঁছনোর পর। এর ফলে মহাকাশের আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়ার কাজটা ভবিষ্যতে সহজতর হতে পারে। যা আগামী দিনে বিভিন্ন গ্রহের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করা কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযানের বিভিন্ন যন্ত্রাংশকে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে। রক্ষা করতে পারে চাঁদে ও মঙ্গলে যাওয়া মহাকাশচারীদেরও।
অশোক সেন (বাঁ দিক থেকে), গৌতম চট্টোপাধ্যায়, মারিনা গেলান্দ ও সন্দীপ চক্রবর্তী
পৃথিবীতে মেরুজ্যোতি হয় কেন?
প্রতি মুহূর্তেই সূর্য থেকে বেরিয়ে পৃথিবী-সহ সৌরমণ্ডলের সব প্রান্তে ছুটে যাচ্ছে সৌরবায়ু বা সোলার উইন্ড। এই সৌরবায়ুতে থাকে অত্যন্ত শক্তিশালী সৌরকণা বা সোলার পার্টিকল্স। কোনও গ্রহ বা উপগ্রহের বায়ুমণ্ডলের একবারে উপরের স্তরে থাকা কণাগুলির সঙ্গে যাদের সংঘর্ষ হয়। তাতে উপকারই হয় সেই গ্রহ বা উপগ্রহগুলির। আমাদের বায়ুমণ্ডল যদি এই সৌরকণাদের রুখতে না পারত তা হলে পৃথিবীতে প্রাণের টিঁকে থাকাটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। এই সৌরকণাগুলির বৈদ্যুতিক আধান (‘চার্জ’) থাকে। ফলে থাকে চৌম্বক ক্ষেত্রও। তাই যে গ্রহের (যেমন পৃথিবী) মোটামুটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে তার সঙ্গে এই সৌরকণাদের সংঘর্ষ হলে আলোর মতো তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের জন্ম হয়। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী তার দুই মেরুতেই। তাই পৃথিবীর উত্তর আর দক্ষিণ মেরুতেই দেখা যায় এই অরোরা বা মেরুজ্যোতি। যাদের আমরা যথাক্রমে বলি ‘নর্দার্ন লাইটস’ আর ‘সাদার্ন লাইটস’। যা সাদা, সবুজ, লাল, বেগুনি নানা রংয়ে বা তাদের মিশেলে দেখা যায়।
উত্তর মেরুর ‘অরোরা বোরিয়ালিস’ আর দক্ষিণ মেরুর ‘অরোরা অস্ট্রালিস’-এর নাম কে না জানেন?
এখানেও সভ্যতার পা। ৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কো ধূমকেতু
একই ঘটনা দেখা যায় বৃহস্পতি, মঙ্গল, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মতো গ্রহে, যাদের বায়ুমণ্ডল আছে কম-বেশি। বৃহস্পতি ও শনির চাঁদগুলিতেও দেখা যায় এমন অরোরা। কিন্তু গ্রহ, উপগ্রহ ছাড়া ধূমকেতুর মতো অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুতে এই অরোরার হদিশ মিলল এই প্রথম।
অরোরা কেন গোটা ধূমকেতু জু়ড়েই?
মূলত নাসার বানানো যে দু’টি যন্ত্রের মাধ্যমে ধূমকেতুতে অরোরার প্রথম হদিশ মিলল, সেই ‘মাইরো’ (অন্য যন্ত্রটির নাম- ‘আয়ন অ্যান্ড ইলেকট্রন সেন্সর’ বা ‘আইইএস’) প্রজেক্টের অন্যতম সদস্য নাসার জেপিএল-এ সিনিয়র সায়েন্টিস্ট গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ধূমকেতুতে থাকে বরফ, গ্যাস আর পাথর। দূরে থাকলে সেই বরফ জমাট বেঁধে থাকে। আর ধূমকেতুগুলি যত সূর্যের কাছে আসে ততই সেই বরফ গলে গিয়ে জলকণা হিসেবে ছড়িয় পড়ে মহাকাশে। তাতেই ধূমকেতুর লেজ তৈরি হয়। নানা ধরনের পদার্থ গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে ধূমকেতুর মাথার দিকটায়। তারা একটা গ্যাসের আবরণী তৈরি করে ধূমকেতুর। যাকে বলা হয় ‘কোমা’। সৌরবায়ুতে থাকে প্রচুর পরিমাণে ইলেকট্রন কণা। সেগুলির সঙ্গে ধূমকেতুর গ্যাসের কণাগুলির সংঘর্ষ হয়। সেই সৌরকণারাই ধূমকেতুর বরফ থেকে তৈরি হওয়া জলের কণাগুলিকে ভেঙে দেয়। ভেঙে দেয় গ্যাসে থাকা অন্যান্য অণুগুলিকেও। এর ফলেই অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ বেরিয়ে আসছে ধূমকেতু থেকে। যা আদতে ধূমকতুর অরোরা। ধূমকেতুর কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র নেই। তাই ধূমকেতুর চার পাশেই দেখা যায় সেই অরোরা।’’
সহায়ক হবে মহাকাশের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)’-এর অধিকর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ধূমকেতুতে প্রথম অরোরার হদিশ পাওয়ার চেয়েও বিজ্ঞানীদের কাছে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা হল; সেই বিকিরণের ভিন্নতা। যার থেকে বোঝা সম্ভব হবে সৌরবায়ুতে থাকা ইলেকট্রন কণাদের ঘনত্ব। যেখানে সেই ঘনত্ব বেশি সেখানে সংঘর্ষের ঘটনা বেশি বলেই বিকিরণ তীব্রতর হচ্ছে। এটাই আগামী দিনে মহাকাশের আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাস দিতে বিজ্ঞানীদের আরও সাহায্য করবে।
৬৭পি/শুর্যুমোভ-গেরাশিমেঙ্কো ধূমকেতু
নজর রাখতে হবে জলকণা, অতিবেগুনি রশ্মি, দু’টিতেই
সন্দীপের কথায়, ‘‘ধূমকেতুর অভিকর্ষ বল মোটেই জোরালো নয়। তাই তারা বায়ুমণ্ডলও ধরে রাখতে পারে না। ধরে রাখতে পারে না গ্যাসগুলিকে। সেই গ্যাসের কণা কোথায় কতটা পরিমাণে ভাঙবে সেটাও নির্ভর করে তার উপর কী পরিমাণে সৌরবায়ু এসে পড়ছে, সেখানকার সৌরবায়ুতে সৌরকণাদের ঘনত্ব কতটা তার উপর। তাই অতিবেগুনি রশ্মির কমা-বাড়া থেকেই সৌরবায়ুতে থাকা ইলেকট্রন কণাদের ঘনত্ব নিখুঁত ভাবে জানা যাবে বলে আমার মনে হয় না। তার জন্য দু’টি ঘটনাকেই মিলিয়ে দেখতে হবে। তাই ধূমকেতুর জলকণার পরিমাণ ও তার অরোরার অতিবেগুনি রশ্মির তীব্রতার বাড়া-কমা, দু’টির উপরেই নিয়মিত নজর রাখা জরুরি, মহাকাশের আবহাওয়ার নিখুঁত পূর্বাভাসের জন্য।’’
বায়ু আছে, ভিন মুলুকের এমন জায়গায় অবতরণে সহায়ক
এসা-র রোসেটা মিশনের গবেষণার সঙ্গে ১০ বছর ধরে জড়িত শিলচরের অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক অশোক সেন বলছেন, ‘‘এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। কারণ, সৌরবায়ু কী ভাবে কোনও গ্রহ, উপগ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপর কোথায় কী পরিমাণে আছড়ে পড়ে, এই প্রথম তা সবিস্তারে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে এই গবেষণায়। এর ফলে, বায়ুমণ্ডল আছে সৌরমণ্ডলের এমন কোনও মহাজাগতিক বস্তুতে আগামী দিনে আমাদের অবতরণে এই গবেষণা অনেক সহায়ক হয়ে উঠতে পারে।’’
ফলে ধূমকেতুর এই সদ্য-চেনা আলোই আগামী দিনে গ্রহে, উপগ্রহে আমাদের পা ফেলার পথে আলো দেখাবে, এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
ছবি সৌজন্যে: নাসা, এসা।