Fossil

ধ্বংসের মুখে বাংলার জীবাশ্ম

পড়ে আছে শুধু অবহেলায়। প্রাচীনকে কি ভুলেই যাব আমরা? বাংলার কোথায় এই জীবাশ্ম মেলে?

Advertisement

সংযুক্তা চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

সন্ধান: দামোদরের চড়ায় পাওয়া গেল ২৫ কোটি বছর আগের ফসিল

যা  হারিয়ে যায়, তা আগলে বসে রইব কত কাল? প্রশ্ন করেছিলেন এক কবি। সত্যিই অনেক কিছু হারিয়ে গেলেই আমাদের কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এমন কিছু জিনিস আছে, যা এক বার হারালে পাওয়া যায় না কখনওই। যেমন জীবাশ্ম বা ফসিল।

Advertisement

দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার জীবাশ্ম— প্রাণীর হাড়গোড় বা গাছ পাতার অংশ, পাথরের মধ্যে যা কোটি কোটি বছর ধরে সংরক্ষিত হয়ে আছে, ধারণ করেছে জীববিবর্তনের ইতিহাস। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বহু পুরনো প্রাণীদের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, যাদের বয়স ২-২৫ কোটি বছর। মানুষের অজ্ঞতা ও সরকারের উদাসীনতায় দ্রুত ধ্বংসের পথে চলেছে এই সম্ভার। আজকের দ্রুত পরিবর্তিত পরিবেশ মূল্যায়ন ও তার ইতিহাস শুধু জীবাশ্মের রেকর্ড ও অঞ্চলটির ভূতত্ত্ব থেকেই পাওয়া যায়।

বাংলার কোথায় এই জীবাশ্ম মেলে? আসানসোল, বরাকর বা দিসেরগড় কয়লাখনির কথা আমরা জানি। রামনগর কয়লাখনির কয়লাস্তরে পাওয়া যায় পাতার জীবাশ্ম। এই অঞ্চল পেরিমিয়ান সময়কালে (২৬-২৭ কোটি বছর আগে) গাছপালাযুক্ত জলাভূমি ছিল। এই বন থেকে ক্রমে উদ্ভিজ্জ পদার্থ মরে পচে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর পিট জমা হয়, যা পরে কয়লায় রূপ পায়। এই গাছ-পাথরের বয়স ২৫-২৭ কোটি বছর। পারবেলিয়া দিসেরগড় ছাড়িয়ে দামোদর পেরিয়ে মধুকুন্ডার আশেপাশে গ্রামগুলি ২৫ কোটি বছর আগেকার মেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবাশ্মের আঁতুড়ঘর। দামোদরের দু’দিকের বালিপাথরের চড়ায় পাওয়া যায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উভচর, মাছ, লাইস্ট্রোসরাস-এর মতো বিরল বহু প্রাণীর জীবাশ্ম। তবে এখানকার বেশির ভাগ জীবাশ্ম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তালকুড়ি গ্রামের বালিপাথরের মধ্যে পাওয়া যেত এই প্রাণীদের মাথার খুলি। এখন আর কিছুই মেলে না সেখানে।

Advertisement

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ সেনগুপ্ত-র সঙ্গে আমি এই এলাকাতে জীবাশ্মের সন্ধানে আসি। তাঁর আক্ষেপ, “আজ থেকে ২০ বছর আগেও এ সব জায়গা থেকে অসংখ্য প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যেত। এখন আর কিছুই পাওয়া যায় না। কত না জানা তথ্য যে হারিয়ে গিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।”

ফিল্ডে আমাদের জীবাশ্ম খননে অনেক প্রতিকূলতা থাকে। স্থানীয়ে‌রা ধরে নেন, তাঁদের জমিতে সরকারি আধিকারিকেরা খনিজ পদার্থ খোঁজার জরিপ চালাবেন এবং তাদের জমি থেকে উৎখাত করা হবে। তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করলেও তাঁরা কাজে বাধা দেন। নিজেদের সুরক্ষার কারণে প্রায়ই বিজ্ঞানীদের পিছু হঠতে হয়। আরও কারণ রয়েছে। দামোদর নদীর দুই পাড়ই জীবাশ্মে ঠাসা। এই দুই পাড় থেকেই শিল্পসংস্থাগুলির ট্রাক বালি তোলে। সেগুলি দাঁড়ানোর নির্দিষ্ট জায়গা নেই। ট্রাকের চাকায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অমূল্য সব জীবাশ্ম।

প্রথম দিন একটা জীবাশ্ম খুঁজে পেয়ে খনন শুরু করেছি। সূর্য ডুবে যাওয়ায় পরের দিন এসে দেখি, ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ে আছে ওই ফসিল। উপরে ভারী চাকার ছাপ। বিদেশে বহু জায়গাতেই ফসিল সাইট-এ গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। পুরুলিয়ার বড়ন্তি, মধুকুণ্ডা ও লাগোয়া গ্রামগুলির বহু মানুষ এই এলাকায় গজিয়ে ওঠা স্পঞ্জ-আয়রন কারখানাগুলির উপর নির্ভরশীল। এই কারখানার বর্জ্য ফেলার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। যেমন খুশি ডাম্পিং চলতে থাকে। সেই স্থান সঠিক কি না, পরিবেশের কোনও ক্ষতি হবে কি না, বেশির ভাগ সময়েই কোনও সার্ভে হয় না।

এতে শুধু জীবাশ্মেরই ক্ষতি হচ্ছে না, মানুষের শরীরেও তার কুপ্রভাব পড়ছে। দূষিত হচ্ছে নদীর জল। সেই জলেই স্নান করছে, কাপড় কাচছে বহু গ্রামের মানুষ। অনেকে নদীর জলই আবার পানীয় জল হিসেবে ব্যবহার করছে। মানুষের জীবাশ্ম নিয়ে অজ্ঞতা ও নিয়মের শিথিলতা ছাড়াও রয়েছে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতা, যা জীবাশ্ম সংরক্ষণে প্রভাব ফেলে। কী ভাবে? সরকার থেকে গ্রামে-গ্রামে, এমনকি বাড়িতে-বাড়িতে, তৈরি হয়েছে শৌচালয়। তবুও গ্রামবাসী খোলা আকাশের নীচে শৌচকর্ম সারেন। তাতেও নষ্ট হচ্ছে জীবাশ্ম।

আছে অন্য বিপদও। কিছু মানুষ জীবাশ্মগুলিকে নিয়ম না মেনে তুলে নিয়ে বিক্রি করার চেষ্টা করেন। এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এতে জীবাশ্ম সম্পর্কিত তথ্য ভুল ভাবে প্রচারিত হয়। ভারতে এই সংক্রান্ত আইন শিথিল, জীবাশ্ম-সংক্রান্ত ব্যবসাও চলতেই থাকে। বিদেশে এই সমস্ত ফসিল সাইট সংরক্ষণ করা হয়, কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় যাতে জীবাশ্ম-সমৃদ্ধ এলাকাগুলিতে অবৈধ বাড়ি তৈরি না হয় এবং ভারী গাড়ি চলাচল না করে।

এ ছাড়াও বিশেষ অনুমতি নিয়েই ভূতাত্ত্বিকেরা জীবাশ্ম খনন করতে পারেন। বিদেশে সরকারের তরফে এই জায়গাগুলিকে জিয়ো-টুরিজম নাম দেওয়া হয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। ভারতেও অল্প কিছু জায়গায় জীবাশ্ম সংরক্ষণের চেষ্টা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে কয়েকটি জায়গায় ডাইনোসরের জীবাশ্মীভূত ডিম পাওয়া যায়। এমন কিছু জায়গাকে ‘সংরক্ষিত’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। গুজরাটে তৈরি হয়েছে ফসিল পার্ক। মধ্যপ্রদেশেও রয়েছে ঘুঘুয়া উড-ফসিল পার্ক, যেখানে গাছের ফসিলের বন সংরক্ষিত। পশ্চিমবঙ্গে শান্তিনিকেতনের কাছে তৈরি হয়েছে আমখই উড-ফসিল পার্ক, যাতে ২ কোটি বছর আগেকার গাছ-পাথর সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। এই গাছ-পাথরগুলি মেলে শান্তিনিকেতনে খোয়াই-এর চারপাশে। বাংলায় আর কোনও জীবাশ্ম সংরক্ষণ করে রাখার পার্ক নেই। শুধু দামোদরই নয়, শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে গন্ধেশ্বরী ও ধানকোড়া নদীর চরে গরু, ঘোড়া, হরিণ, হায়না, এমনকি এশীয় সিংহ ও জিরাফের জীবাশ্মও পাওয়া গিয়েছে। মেদিনীপুরের ধুলিয়াপুরে তারাফেনি নদীর উপত্যকায় প্যালিয়োলিথিক সময়ের জীবাশ্ম পাওয়া যায়।

এই সম্পদের কথা সবাইকে জানাতে গত ২৭-২৮ জানুয়ারি ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইন্সটিটিউটের ভূতত্ত্ব বিভাগ একটি আলোচনাচক্রের আয়োজন করে। শিরোনাম ‘ডিপ টাইম বায়োডাইভার্সিটি অব বেঙ্গল— অ্যান আউটরিচ প্রোগ্রাম’। এতে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও আরও বহু মানুষকে জীবাশ্মের প্রয়োজনীয়তা জানানো হয়। আলোচনাচক্রে অংশ নেন ক্যালিফর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাইজেল হিউজেস। আমখই উড ফসিল পার্ক তৈরি হওয়ার অনেক দিন আগে থেকেই নাইজেল শান্তিনিকেতনে স্কুলে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁর লেখা ‘মনীষার পাথরের বন’ বইয়ের মাধ্যমে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement