চন্দ্রযান-২। ছবি-ইসরো।
চাঁদ নিয়ে ভাবার সময় পাননি সর্দার বল্লভভাই পটেল! ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সত্যাগ্রহ নিয়ে। ঐতিহাসিক বরদলি সত্যাগ্রহের সময় বল্লভভাই কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন, প্রায় ১০০ বছর পর ধারেকাছের হা-অন্ন গ্রামের স্কুলে পড়া একটি ছেলের ‘সত্যাগ্রহ’-ই ইসরোর ভরসা হয়ে উঠবে ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রাভিযানে? ভেড়ছি গ্রামের গাঁধী বিদ্যাপীঠের ছাত্র সন্তোষের বানানো যন্ত্রেই যে চাঁদের মাটিতে ‘মণি, মাণিক্য, হিরে, জহরত’ খুঁজবে ভারত! বহু দশক আগে যার প্রয়োজনের কথা প্রথম বলেছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম।
সর্দার বল্লভভাই স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর তাঁর সত্যাগ্রহের পীঠস্থান বরদলি শহরের কাছেই গুজরাতের একটি ছাপোষা গ্রামের সন্তোষ অসম্ভব জেদ নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছেন, খনিজের ভাণ্ডার শেষ হয়ে গেলে যেন ফের ‘পরাধীন’ না হয়ে পড়তে হয় ভারতকে! যেন এই সৌরমণ্ডলে কাছপিঠের অন্য কোনও জায়গা থেকে সেই খনিজ নিয়ে এসে মেটানো যায় অভাব। যে স্বপ্নটা প্রথম দেখেছিলেন প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। লিখেছিলেন তাঁর বই ‘দ্য সায়েন্টিফিক ইন্ডিয়ান’-এ।
আরও বড় স্বপ্ন রয়েছে সন্তোষের। যে স্বপ্নটা দেখছে নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘এসা’), ইসরোর মতো বিশ্বের প্রথম সারির মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলি। চাঁদে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন। যার জন্য জলের সঙ্গে চাই খনিজ পদার্থেরও। বেঁচে থাকার জন্য, জীবনযুদ্ধে টিঁকে থাকার জন্য।
স্বপ্নটাকে সত্যি করে তুলতে হলে জানতে হবে, কোন কোন মৌল বা খনিজ পদার্থ রয়েছে চাঁদে। তার চেয়েও যেটা বেশি করে জানতে হবে, তা হল, সেই সব মৌল ও খনিজগুলি কতটা পরিমাণে রয়েছে আমাদের একমাত্র উপগ্রহে।
স্বপ্ন সত্যি করতেই সন্তোষের উদ্ভাবন
আর সেগুলি জানার জন্যই দু’টি বিশেষ ধরনের যন্ত্র বানিয়েছেন ইসরোর অধীনে থাকা আমদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির (পিআরএল) সিনিয়র প্রফেসর সন্তোষ ভাদাওয়ালে। যে দু’টি যন্ত্র সঙ্গে না গেলে ইসরোর চন্দ্রযান-২ অভিযান কার্যত নিরর্থকই হয়ে যেত।
সন্তোষের বানানো এই এক্স-রে সোলার স্পেকট্রোমিটারই পাঠানো হচ্ছে চন্দ্রযান-২-এ
সন্তোষের বানানো একটি যন্ত্রের নাম- ‘এক্স-রে সোলার মনিটর (এক্সএসএম)’। অন্যটির নাম- ‘আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (এপিএক্সএসএম)’। প্রথম যন্ত্রটি থাকবে চন্দ্রযান-২-এর ‘অরবিটা’রে। যা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে তার বিভিন্ন কক্ষপথে। আর দ্বিতীয় যন্ত্রটি থাকবে চাঁদের মাটিতে ঘুরে-চরে বেড়ানো রোভার ‘প্রজ্ঞান’-এ।
কোন কোন মৌল রয়েছে চাঁদে?
সন্তোষ জানালেন, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার, পটাসিয়াম, টাইটানিয়াম, লোহা, নিকেল তো রয়েছেই, চাঁদের বালিকণায় এমনকী সোনা, প্ল্যাটনামের মতো বহু মূল্যবান ভারী মৌলেরও প্রচুর পরিমাণে মিশে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্টই।
আরও পড়ুন- হুগলির চন্দ্রকান্তের তৈরি অ্যান্টেনার ভরসায় ফের চাঁদের কক্ষপথে ঢুকছে ইসরো
চাঁদে খনিজ খুঁজতে সূর্যের হল্কার উপরেও নজর!
হ্যাঁ, চাঁদের বুকে কোন কোন মৌল আর খনিজ রয়েছে, মুখ গুঁজে লুকিয়ে রয়েছে চাঁদের পিঠে ছড়ানো বালিকণার মধ্যে, তার খোঁজতল্লাশে সূর্যের হল্কার (ফ্লেয়ার) দিকেও তাকাতে হবে সন্তোষের বানানো যন্ত্রকে। বলা ভাল, সূর্যের হল্কার উপর ঠিক ভাবে নজর রাখতেই তাঁর যন্ত্রটি বানিয়েছেন সন্তোষ। যাতে তার মাধ্যমেই নিখুঁত ভাবে জানা যায় চাঁদের বুকে লুকিয়ে রয়েছে কোন কোন মৌল ও কোন কোন খনিজ পদার্থ আর সেই সবগুলি রয়েছে ঠিক কোন পরিমাণে। যৎসামান্য হলে তো তাদের নিয়ে আর চিন্তাভাবনা করার কোনও প্রশ্নই নেই। কারণ, তা দিয়ে আমাদের চাহিদা মেটানো যাবে না।
চাঁদে যে ধরনের খনিজের হদিশ মেলার আশায় ইসরো
কেন নজর সূর্যের হল্কার উপর?
আমদাবাদ থেকে টেলিফোনে সন্তোষ ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’কে বললেন, ‘‘সূর্যের বায়ুমণ্ডল বা ‘করোনা’ থেকে প্রতি মুহূর্তে ছিটকে বেরিয়ে আসছে শক্তিশালী এক্স-রে। এক্স-রে দু’ধরনের হয়। সফ্ট এক্স-রে আর হার্ড এক্স-রে। সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে শুধুই সফ্ট এক্স-রে। হার্ড এক্স-রে সূর্যের করোনা থেকে আসে না।’’
সফ্ট এক্স-রে-র শক্তি হয় সাধারণত, ১ থেকে ১০/১৫ কিলো ইলেক্ট্রন ভোল্ট (কেইভি)। কখনও কখনও তা ১০০ কেইভি হয়ে গেলে তাকে মিডিয়াম রেঞ্জ বা মাঝারিমানের শক্তির এক্স-রে হয়। আর সেই শক্তির পরিমাণ ২০০ কেইভি-রও বেশি হয়ে গেলে তাকে বলা হয় হার্ড এক্স-রে।
সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে ওই সফ্ট এক্স-রে প্রতি মুহূর্তে আছড়ে পড়ে চাঁদের পিঠে (লুনার সারফেস)। চাঁদের কোনও বায়ুমণ্ডল নেই বলে, সেই এক্স-রে সূর্য থেকে সরাসরি এসে আছড়ে পড়ে চাঁদের পিঠে। বায়ুমণ্ডল থাকলে তা বাতাসের কণার গায়ে ধাক্কা মারত। তাতে তার শক্তি ক্ষয় হত। ভাগ্যিস, পৃথিবীর পুরু বায়ুমণ্ডল রয়েছে! তাই আমরা সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা এক্স-রে-র হামলা থেকে বেঁচে যাচ্ছি।
আমদাবাদে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির সিনিয়র প্রফেসর সন্তোষ ভাদাওয়ালে
সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে সেই সফ্ট এক্স-রে চাঁদের পিঠে আছড়ে পড়লেই সেখানকার বালিকণার মধ্যে মিশে থাকা মৌল আর খনিজগুলি থেকে আলোর বিকিরণ হয়। সেগুলির মধ্যে দেখা দেয় ‘ফ্লুরোসেন্স’। যেমন জোনাকির আলো। সেই আলোর রং দেখেই আমরা বাছবিচার করে বলতে পারি, কোন কোন মৌল রয়েছে চাঁদের পিঠে (এলিমেন্টাল কম্পোজিশন)। রয়েছে কোন কোন খনিজ পদার্থ। আর সেগুলি রয়েছে ঠিক কোন পরিমাণে। আমার বানানো এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার সেই কাজটাই করবে। প্রতি সেকেন্ডে সূর্যের করোনা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে কতটা এক্স-রে, আমার বানানো যন্ত্র তা মাপবে।’’
কোন কোন ধরনের হল্কা বেরিয়ে আসে করোনা থেকে?
সূর্যের করোনা থেকে বেরিয়ে আসে নানা ধরনের আগুনের হল্কা (ফ্লেয়ার)। শক্তির দাঁড়িপাল্লায় তাদের মোট ৫টি গোত্র রয়েছে। ‘এ-ক্লাস’, ‘বি-ক্লাস’, ‘সি-ক্লাস’, ‘এম-ক্লাস’ এবং ‘এক্স-ক্লাস’। প্রথম তিনটি গোত্রের হল্কা সাধারণ মানের। ‘এম-ক্লাস’-এর হল্কাগুলি মধ্যম মানের। আর সবচেয়ে শক্তিশালী হল্কাগুলির গোত্র ‘এক্স-ক্লাস’। শক্তির নিরিখে প্রতিটি গোত্র তার আগের গোত্রের (যেমন, বি-ক্লাস এ-ক্লাসের চেয়ে, ইত্যাদি) অন্তত ১০ গুণ।
আরও পড়ুন- চাঁদে যেতে সঙ্গে নিন মাটি, পকোড়া...
সন্তোষের কৃতিত্ব কোথায়?
সন্তোষের বানানো এক্স-রে সোলার মনিটর (এক্সএসএম) শুধুই সূর্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা আগুনের ওই হল্কাগুলির শক্তি আর তা প্রতি সেকেন্ডে কী পরিমাণে বেরিয়ে আসছে, তা মাপবে। তার জন্য যে যন্ত্রটি বানিয়েছেন সন্তোষ, তার নাম- ‘চন্দ্রযান লং এরিয়া সফ্ট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (সিএলএএসএস বা ‘ক্লাস’)। সন্তোষের কথায়, ‘‘এমন একটি এক্সএসএম রয়েছে চন্দ্রযান-১-এও। তবে তা প্রতি ১৬ সেকেন্ডে যা মাপতে পারে, এ বার চন্দ্রযান-২-এ পাঠানো আমাদের এক্সএসএম তা মাপবে প্রতি সেকেন্ডে।’’
সন্তোষের কৃতিত্ব, চন্দ্রযান-১-এর সেই যন্ত্রটির ক্ষমতা ও দক্ষতা দুই’ই বাড়াতে পেরেছেন তিনি।
সন্তোষের বানানো এক্সএসএমের ওজন মাত্র ১ কিলোগ্রামের সামান্য বেশি। এটি থাকবে চন্দ্রযান-২-এর অরবিটারে, দু’টি বাক্সে। উপরে থাকবে ছাতার মতো একটি রিফ্লেক্টর।
তা ছাড়াও চাঁদের পিঠে ঘুরে বেড়ানো রোভারে থাকবে ‘আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (এপিএক্সএমএস)’। যা চাঁদের পিঠে থাকা মৌল বা খনিজগুলির ফ্লুরোসেন্স কতটা, তা মাপবে।’’ এপিএক্সএমএস-এর ওজন মাত্র ৭০০ গ্রাম। থাকবে একটি বাক্সে।
সন্তোষের সত্যাগ্রহ...
পড়াশোনা শুরু করেছিলেন ভেড়েছি গ্রামের ছোট্ট একটা স্কুলে। গাঁধী বিদ্যাপীঠে। বাবা ছিলেন সেখানকারই একটি বিএড কলেজের শিক্ষক। বাবাই অনুপ্রেরণা দিতেন সন্তোষকে উদ্ভাবনের। ছোটবেলা থেকেই। তার পর সন্তোষ ভর্তি হন গাঁধীর মতাদর্শে চলা ভেড়েছিরই উত্তর বুনিয়াদি স্কুলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়েন সন্তোষ। পরে নবম আর দশম শ্রেণির পড়াশোনা চালান বাড়িতে বসেই। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন ভদোদরার অ্যালেম্বিক বিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে বিএসসি এবং এমএসসি করেন ভদোদরার এম এস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার পর পিএইচডি করতে যান মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চে (টিআইএফআর)। মহাকাশ নিয়ে ছোটবেলার স্বপ্নটাকে বাস্তবের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সন্তোষের প্রস্তুতি মূলত শুরু হয় টিআইএফআর থেকেই। সেখান থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নেন পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি। ২০০৬-এ যোগ দেন পিআরএল-এ।
কেন এত ছোটাছুটি মহাকাশে? কী বলছেন সন্তোষ, দেখুন ভিডিয়ো
ভরসা সন্তোষই!
খনিজ পদার্থের ভাণ্ডার দ্রুত শেষ হয়ে আসছে আমাদের বাসযোগ্য গ্রহে। চাহিদা মেটাতে পৃথিবীর অন্দর থেকে সেই সব তুলে আনার জন্য কাঙ্খিত প্রযুক্তি আমাদের হাতে নেই। ফলে, এক দিন হয়তো চাঁদ থেকে তুলে এনেই আমাদের চাহিদা মেটাতে হবে।
তবে তার জন্য আমাদের আপাতত ভরসা রাখতে হবে সন্তোষের বানানো যন্ত্রের উপরেই।
চাঁদে কাঙ্খিত খনিজের খোঁজ পেতে সন্তোষ ছাড়া আর কেই-বা পথ দেখাতে পারেন আমাদের?
ছবি সৌজন্যে: ইসরো।
ভিডিও সৌজন্যে: ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি, আমদাবাদ