চাঁদে সভ্যতার আস্তানার নকশা। শিল্পীর কল্পনায়।
চাঁদই হল অন্নপূর্ণা বা কাঞ্চনজঙ্ঘা! আর মঙ্গল বা এই সৌরমণ্ডলের অন্য কোনও গ্রহে পৌঁছনোটা হবে এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা!
মঙ্গলে গেলে কোন কোন বাধার মুখে পড়তে হবে, কোন ধরনের পরিবেশ পেতে হবে আর তাতে কী ভাবে মানিয়ে নিয়ে রীতিমতো লড়াই করে টিঁকে থাকতে হবে, সেটাই বুঝে ও শিখে নিতে চাঁদে নামতে রওনা দিয়েছি আমরা। যাবতীয় চন্দ্রাভিযান পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পর ৫২ বছর পর, ফের ২০২৪-এ চাঁদে নামার তোড়জোড় শুরু করেছে আমেরিকা। যাচ্ছে চিনও। যাবে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সিও (ইএসএ বা ‘ইসা’)।
পাকাপাকি ভাবে থাকার কথা ভাবা হচ্ছে না
চাঁদে পাকাপাকি ভাবে থাকার কথা যে বিজ্ঞানীরা খুব একটা ভাবছেন, তা বলব না। তবে কিছু দিনের জন্য তো গিয়ে থাকতেই হবে চাঁদে। তার জন্য চাঁদের পিঠের (লুনার সারফেস) এক থেকে দুই মিটার নীচে বানাতে হবে বাঙ্কার। কারণ, আমরা যেমনটা রয়েছি পৃথিবীর পিঠে (যাকে বলা হয়, ভূপৃষ্ঠ), সেই ভাবে অল্প সময়ের জন্যেও থাকা সম্ভব নয় চাঁদে। তার কোনও বায়ুমণ্ডল নেই বলে।
চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়
পৃথিবীর দুই রক্ষাকর্তা আছে!
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল আমাদের অনেক রকমের ঝড়, ঝাপটার হাত থেকে বাঁচায়। সূর্যের করোনা বা বায়ুমণ্ডল থেকে ধেয়ে আসে সৌরবায়ু, সৌরঝড়, করোনাল মাস ইজেকশানের মতো ভয়ঙ্কর সব শত্রুরা। বায়ুমণ্ডল না থাকলে যাদের দাপটে আমাদের জন্ম বা টিঁকে থাকা আদৌ সম্ভবই হত না।
আরও পড়ুন- চাঁদের ভেলা পৌঁছে দেবে নতুন দিগন্তে, রুখবে ব্রেন ড্রেন, বাড়াবে বাণিজ্যও!
আরও পড়ুন- ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্যের জট খুলতে আরও রোমাঞ্চকর অভিযানের পথে ইসরো
আমাদের সৌরমণ্ডল হয় তাদের শুষে নেয় বা বদলে দেয় অন্য কোনও কণা বা মৌলে অথবা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহাকাশের অন্য কোনও দিকে। ওই শত্রুদের হাত থেকে বাঁচায় পৃথিবীর অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের একটি পুরু আবরণীও। সূর্য থেকে ধেয়ে আসা খুব শক্তিশালী মারণ কণাদের অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেয় পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র।
চাঁদের না আছে বায়ুমণ্ডল, না আছে চৌম্বক ক্ষেত্র
চাঁদের না আছে বায়ুমণ্ডল, না আছে কোনও শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র। ফলে, সূর্য থেকে ধেয়ে আসা কণা আর মহাজাগতিক রশ্মি (কসমিক রে) প্রতি মুহূর্তেই এসে আছড়ে পড়ছে চাঁদের বুকে। তা এড়িয়ে টিঁকে থাকতে হলে চাঁদের পিঠের নীচে কিছুটা গভীরতায় আমাদের বানাতে হবে বাঙ্কার। যার উপরটা এমন কোনও পদার্থ দিয়ে বানাতে হবে যাতে তা সেই সব শক্তিশালী হানাদারদের পুরোপুরি শুষে নিতে পারে। তাতে বাঙ্কারের উপরটা গরম হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তার তাপমাত্রা কমিয়ে আনার অন্য উপায়ও আমাদের হাতে রয়েছে।
চাঁদ আর মঙ্গলের পরিবেশ প্রায় একই রকমের
চাঁদে এই বাঙ্কার বানিয়ে ফেলার অভিজ্ঞতাটাই আমাদের কাজে লাগবে মঙ্গলে মানবসভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশ গড়ে তোলার সময়। কারণ, মঙ্গলের পরিবেশটাও প্রায় হুবুহু চাঁদের মতোই। লাল গ্রহ মঙ্গলেরও কোনও বায়ুমণ্ডল নেই। নেই তারও কোনও চৌম্বক ক্ষেত্র। ফলে, মহাজাগতিক রশ্মি আর সৌর বিকিরণের হামলা মঙ্গলকেও সইতে হয়, সইতে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। তাই মঙ্গলে সভ্যতার দ্বিতীয় উপনিবেশটাও গড়ে তুলতে হবে ল লাল গ্রহের পিঠের বেশ কিছুটা নীচে। সেখানেও বানাতে হবে আমাদের টিঁকে থাকার জন্য বাঙ্কার। তার অভিজ্ঞতাটাই আমাদের অর্জন করতে হবে চাঁদে গিয়ে। কিছু দিনের জন্য চাঁদের বুকে কাটিয়ে।
থাকার জন্য চাঁদে সবচেয়ে ভাল জায়গাটা কোথায় হতে পারে?
চাঁদে আমাদের থাকার জন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা হিসাবে এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের পছন্দ আমাদের একমাত্র উপগ্রহের দক্ষিণ মেরু ও তার লাগোয়া এলাকা। যে লক্ষ্যগুলিকে সামনে রেখে এ বার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামতে চলেছে ‘চন্দ্রযান-২’, এটি তার অন্যতম।
কী ভাবে গড়ে তোলা হবে চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশ? দেখুন ভিডিয়ো
আমাদের থাকার জন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরু ও তার সংলগ্ন এলাকাকে বিজ্ঞানীদের পছন্দ হওয়ার কারণ মূলত দু’টি। চাঁদ তার কক্ষপথে একটু হেলে থাকায় সূর্যের আলো যে ভাবে যতটা এসে পড়ে আমাদের উপগ্রহের উত্তর মেরু-সহ অন্যান্য এলাকায়, দক্ষিণ মেরু ও তার লাগোয়া এলাকাগুলিতে সূর্যকে ততটা বেশি সময় ধরে দেখা যায় না। ফলে, উত্তর মেরু-সহ চাঁদের অন্যান্য এলাকার চেয়ে রাতের অন্ধকার অনেকটাই বেশি থাকে তার দক্ষিণ মেরুতে। ফলে, সৌর বিকিরণের ঝাপ্টা সেই মুলুকে অনেকটাই কম সামলাতে হবে আমাদের।
বাঙ্কার হবে, জল মিলবে, মিলতে পারে জ্বালানিও!
বিজ্ঞানীদের এখনও পর্যন্ত এও ধারণা, চাঁদে তরল জলের সবচেয়ে বড় ভাণ্ডারটি রয়েছে তার দক্ষিণ মেরুতে। ফলে, বসবাসের জন্য জলের অভাব হবে না সেখানে। আবার সেই জলের একটি অংশকে যদি আমরা সহজে, কম খরচে তড়িৎ বিশ্লেষণের মাধ্যমে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসে ভেঙে নিতে পারি, তা হলে ওই দু’টি গ্যাস আমাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে দু’ভাবে। ওই অক্সিজেন গ্যাস যেমন আমাদের শ্বাসের বাতাস জোগাতে পারে, তেমনই হাইড্রোজেন গ্যাস আমরা কাজে লাগাতে পারি জ্বালানি হিসাবে। যে জ্বালানি অপ্রচলিত শক্তির উৎস হিসাবে যেমন কাজে লাগতে পারে চাঁদ-মুলুকে সভ্যতার যাপনে, তেমনই তা কাজে লাগতে পারে রকেটের জ্বালানি হিসাবেও।
চাঁদে সভ্যতার উপনিবেশের নকশা। নাসার শিল্পীর কল্পনায়
চাঁদই শেখাবে কী ভাবে থাকতে হবে মঙ্গলে...
চাঁদ থেকে তখন যদি পৃথিবীতে প্রায়ই যাওয়া-আসা করতে হয় বা চাঁদ থেকে যেতে হয় মঙ্গল বা এই সৌরমণ্ডলের অন্য কোনও গ্রহে, তা হলে সেই সব মহাকাশযাত্রার জন্য রকেটের জ্বালানি ভরে নেওয়া সম্ভব হবে চাঁদেই।
আরও পড়ুন- চাঁদে এখন না নামলে পরে খুবই পস্তাতে হত ভারতকে!
আরও পড়ুন- চাঁদই হতে চলেছে আগামী দিনের সেরা ল্যাবরেটরি!
শুধুই বাঙ্কারের প্রযুক্তি নয়, জল নিষ্কাশন, পরিশোধন, তাকে ব্যবহারের যোগ্য করে তোলা, তাকে ভেঙে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস বের করে নিয়ে আসার যাবতীয় কৌশলে চাঁদেই রপ্ত হয়ে নিয়ে আমরা সেটাকেই অনুসরণ করতে পারি মঙ্গলে।
তাই মঙ্গলের মতো কোনও এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার আগে চাঁদই হয়ে উঠতে চলেছে আমাদের অন্নপূর্ণা বা কাঞ্চনজঙ্ঘা! তাই আর ৫ বছরের মধ্যেই ফের চাঁদে যাচ্ছে নাসা। আর ৯ বছরের মধ্যেই চাঁদের কক্ষপথে ‘লুনার স্পেস স্টেশন’ বানানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গিয়েছে জোর কদমে।
লেখক কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার)-এর অধ্যাপক। বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী
টেলিফোন সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন: সুজয় চক্রবর্তী
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
ছবি সৌজন্যে: নাসা
ভিডিয়ো সৌজন্যে: ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ বা ‘ইসা’)