অধরা: ইসরোর স্ক্রিনে তখন নিথর অ্যানিমেটেড ছবি। ছবি: পিটিআই।
নেমে আসছিল নিখুঁত ভাবেই। কিন্তু চাঁদের মাটি থেকে আকাশে ২.১ কিলোমিটার উপরে থাকার সময় ইসরো যোগাযোগ হারিয়ে ফেলল বিক্রমের সঙ্গে!
ঠিক ৪৭ দিনের যাত্রা। একেবারে দিনক্ষণ মেপে চাঁদে নামছিল বিক্রম। দক্ষিণ মেরুর কাছে। যেখানে আজ পর্যন্ত আর কোনও দেশের যান পা রাখেনি। ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযানের এই ল্যান্ডারের পেটে রয়েছে ছোট্ট চাঁদের গাড়ি বা রোভার প্রজ্ঞান। কয়েক ঘণ্টা পরে দক্ষিণ মেরুর কাছে ভোর হওয়ার কথা। ঠিক ছিল তার আগেই খুলে যাবে বিক্রমের ডালা বা র্যাম্প। তার উপর দিয়ে গড়িয়ে নামবে প্রজ্ঞান। ভোর ৫টা ১৯ মিনিটে। ভোরের আলো ফুটলে সেই আলো সোলার প্যানেলে মেখে জেগে উঠবে চাঁদের গাড়ি। ভোর ৫টা ২৯ থেকে প্রতি মিনিটে ৬০ সেন্টিমিটার করে এগোবে। তার পরে বিক্রম প্রজ্ঞান শুরু করবে খোঁজ, কী কী আছে চাঁদের মাটিতে ও চাঁদের উপরে! অরবিটার তো আগে থেকেই ছবি তুলে চলেছে চাঁদের। যা দিয়ে তৈরি হবে পথিবীর একমাত্র উপগ্রহের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র।
কিন্তু কী হল বিক্রমের? জানে না ইসরোও। চলছে তথ্য বিশ্লেষণ।
শ্রীহরিকোটা থেকে চন্দ্রযান ২-এর যাত্রা থমকে গিয়েছিল শেষ মুহূর্তে। ত্রুটি সামলে এক সপ্তাহ পরেই গত ২২ জুলাই বাহুবলী রকেটের ঘাড়ে চেপে রওনা দিয়েছিল ভারতের দ্বিতীয় চন্দ্রযান। তখনই ঠিক হয়েছিল যাত্রা পিছিয়ে গেলেও আগের নির্ধারিত দিনেই গন্তব্যে পৌঁছৈ দেওয়া হবে চন্দ্রযান ২-কে। ৭ সেপ্টেম্বর ১০০ দিন পূর্ণ হবে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের। সাফল্যের তালিকায় চন্দ্রবিজয়কে জুড়ে নেওয়ার পক্ষে এমন ভাল দিন আর কী হতে পারত শাসক শিবিরের কাছে! কিন্তু হল না। নামার আগে হারিয়ে গেল বিক্রম।
২০১৯-এর ভোটের আগে এ-স্যাট ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে মহাকাশের লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসের সফল পরীক্ষা চালিয়েছিল ইসরো। সে-বার ইসরো বা ডিআরডিও-র কোনও কর্তা নন, খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদীই সেই সাফল্য প্রচার করে বিরোধীদের বিস্তর সমালোচনা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু ভোটের ফলাফলেই প্রমাণ, জাতীয়তাবাদের হাওয়া তুলতে সেটাও কাজে এসেছিল মোদীর। আগামিকাল, সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হওয়ার দিনে এমন একটা সাফল্য আসতে চলেছে— প্রধানমন্ত্রী তা নিয়ে খুবই উৎসাহিত ছিলেন দিনভর। আজ সকাল থেকেই একের পর এক টুইট করে গিয়েছেন তিনি। কোনওটিতে দেশবাসীকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে বলেছেন। কখনও জানিয়েছেন, তাঁর বেঙ্গালুরুতে আসার কথা। সারা দেশ থেকে কুইজের মাধ্যমে বেছে নেওয়া যে ৬০ পড়ুয়া বেঙ্গালুরুতে তাঁর সঙ্গে বসে অবতরণ দেখবে, টুইট করেছেন তাদের নিয়েও। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।
গভীর রাতে এমন একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য গোটা দেশেই আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। দেশের শহরে-গঞ্জে ও গ্রামে শুক্রবারের রাতটা গোটা দেশ কার্যত জেগেই ছিল। কোথাও দল বেঁধে, কোথাও বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে— নজর ছিল ইসরোর বা খবর ও সোশ্যাল মিডিয়ার সাইটে।
যাত্রা পিছিয়ে গেলেও পৌঁছনোর দিন একই রাখায় প্রশ্ন উঠেছিল, তাতে কোনও বিপত্তি হবে না তো! ইসরো আশ্বাস দিয়েছিল, এর জন্য গতি কিছুটা বাড়াতে হবে। পৃথিবীকে পাঁচ পাক ও চাঁদের চার পাশ পাঁচ পাক খাবে চন্দ্রযান ২। তার মাপজোকেও কিছু বদল অবশ্যই ঘটাতে হবে। গোটা দেশ ভরসা রেখেছিলেন ইসরোর বিজ্ঞানীদের উপরে। আজ তাঁদের সাফল্যের মুকুটে যোগ হতে পারত নতুন পালক। রাশিয়া, আমেরিকা ও চিনের পরে ভারত হত চতুর্থ দেশ, যাঁরা বায়ুমণ্ডলহীন চাঁদে যান নামাতে পেরেছে পালকের মতো। মঙ্গলগ্রহে বায়ুমণ্ডল রয়েছে। সেখানে যানের আছড়ে পড়া থেকে ঠেকাতে বায়ুর বাধাকে কাজে লাগিয়েছিল আমেরিকা। নাসার বিজ্ঞানী অনিতা সেনগুপ্তের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছিল বিশেষ প্যারাশুট। কিন্তু চাঁদে বাতাস নেই। বিক্রমের নীচে লাগানো তরল ইঞ্জিনের চারটি রকেটকে নানা পর্যায়ে চালু করে এর গতি নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল। সে কাজ শুরু করেও মাঝপথে ছিটকে গেল ইসরো।
চাঁদে অবতরণ বিশ্বে নতুন নয়। ষাট বছর আগে ১৩ সেপ্টেম্বর প্রথম বার চাঁদে যন্ত্র-দূত বা ল্যান্ডার নামিয়েছিল রাশিয়া। ১৯৬৯ সালে আমেরিকা মানুষ পাঠিয়েছে চাঁদে। চিনও চাঁদে পৌঁছেছে। গত ১১ এপ্রিল চাঁদে নামতে গিয়ে ইজরায়েলের মহাকাশযান ভেঙে পড়েছিল। ফলে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশের কাছে এ ছিল এক নতুন পরীক্ষা। এই সফ্ট ল্যান্ডিং ভারত আগে কখনও করেনি। মানসিক ভাবে প্রচণ্ড চাপে ছিলেন অভিযানের সঙ্গে যুক্ত ইসরোর প্রত্যেক বিজ্ঞানী, কর্তা ও কর্মী। মায় নিরাপত্তারক্ষীারাও।
উত্তেজনার বহরটা বোঝা গিয়েছিল দুপুরেই। ইসরোর তরফে কোনও বার্তা আসছে না। মুখপাত্রেরাও নীরব। ইসরো অফিস চত্বরে এক মুখপাত্রকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রেই শেষমেশ মুখ খুললেন তিনি। বললেন, সব ঠিকই আছে। পরিকল্পনামাফিক সব কিছু এগোচ্ছে। তবে এটাও স্পষ্ট হল, উত্তেজনায় ভুগছেন শীর্ষ কর্তারাও। সন্ধের পর থেকে ঘড়ির কাঁটা যত ঘুরছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে উত্তেজনা। ইসরো জানাল, অবতরণ রাত ১টা ৫৫ মিনিটে।
রাত ১টা ২২, মিডিয়া সেন্টারের পর্দায় তখন দেখা যাচ্ছে, কম্পিউটারে শেষ মুহূর্তের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা। প্রাক্তন ইসরো চেয়ারম্যান এ এস কিরণকুমারকে দেখা গেল, ঘুরে ঘুরে ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে কথা বলতে। বিরাট জায়ান্ট স্ক্রিনে এক বার ভেসে উঠল, প্রথম অবতরণস্থলের ছবি। তা দেখেই মিডিয়া সেন্টারের সাংবাদিকদের মধ্যেও চাঞ্চল্য তৈরি হল। ১টা ২৩-এ পর্দায় ভেসে উঠল ‘মিশন অপারেশন কমপ্লেক্স’-এ এসে পৌঁছলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী।
প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন ইসরো চেয়ারম্যান কে শিবন। কন্ট্রোল রুমে ঢোকার আগে আশপাশ দেখে নিলেন মোদী। কন্ট্রোল রুমে ঢুকে উপস্থিত ইসরোর প্রাক্তন চেয়ারম্যান কস্তুরীরঙ্গন, কে রাধাকৃষ্ণন-সহ বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ করেন তিনি।
রাত ১টা ৩৮-এ শুরু হল গায়ে কাটা দেওয়া শেষ কয়েকটা মিনিট। বিক্রম তার কৃত্রিম মেধা দিয়ে প্রাথমিক ব্রেক কষা শুরু করল। সে তখন চাঁদের ৩০ কিলোমিটার উপরে। বিক্রমের ঠিক মাথার উপরে থেকে ছবি তুলে পৃথিবীতে পাঠিয়ে চলেছে অরবিটার। সেই ছবি পর্দায় ভেসে উঠতেই কন্ট্রোল রুমে হাততালি বিজ্ঞানীদের। দর্শকের আসনে মোদীরও। ১০ মিনিট পরে ফের গতি কমানোর কাজ সারল আরও সূক্ষ্ম পর্যায়ে। সে তখন চাঁদের মাটি থেকে ৭ কিলোমিটার উপরে। প্রাথমিক ভাবে একটি অবতরণস্থল ও তার বিকল্প ঠিক করা থাকলেও ১টা ৫০ মিনিটে বিক্রম তার তোলা ছবির ভিত্তিতে ল্যান্ডিং সাইট বাছাই বা ‘লোকাল নেভিগেশন’ শুরু করল।
বিক্রম তখন ২.১ কিলোমিটার উপরে। থমকে গেল পর্দা। কন্ট্রোল রুমে পিন পড়ার শব্দও শোনা যাবে। ইঞ্জিনিয়ারেরা হঠাৎ গম্ভীর। কারও মাথায় হাত। কোনও ঘোষণা নেই। এক অদ্ভুত নীরবতা। রাত ১টা ৫৩, প্রধানমন্ত্রীর গালে হাত। চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন শিবন, কিরণকুমার। কন্ট্রোল রুম নিশ্চুপ। কী হল, বোঝা যাচ্ছে না। মিশন কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করছেন বিজ্ঞানীরা। সিবনের সঙ্গে কথা মোদীর। সঙ্গে কিরণকুমার, কস্তুরীরঙ্গন। সকলের চোখেমুখে উদ্বেগ। ২টো ৬ নাগাদ ঘোষণা, ল্যান্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ করা গিয়েছে। তার গতিপথের তথ্য ফের আসতে শুরু করেছে। ছবিও আসছে। কিন্তু পর্দায় ভেসে উঠল পুরোনো গ্রাফিকের ছবি। শিবন ঘোষণা করলেন, বিক্রম ২.১ কিলোমিটার উপরে থাকা পর্যন্ত যোগাযোগ ছিল। তার পরে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ২টো ১৯ মিনিটে মোদী এগিয়ে গিয়ে সিবনের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘‘আপনারা যা করেছেন দেশ আপনাদের জন্য গর্বিত। হোপ ফর দ্য বেস্ট আশা করি আবার আপনারা দেশকে খুশির খবর দিতে পারবেন।’’ উপস্থিত ৬০ পড়ুয়াদের সঙ্গে কিছু ক্ষণ কথা বলেন মোদী। তাদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরও দেন।
অবতরণের শুরুতে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই।
আশা করা হচ্ছিল কামাল দেখাবে কৃত্রিম মেধা! এর পরে চারটির মধ্যে দু’টি রকেটকে কাজে লাগিয়ে নীচে আসার পরে মাঝের একটি রকেট চালিয়ে নিজের গতি নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক যে ভাবে হেলিকপ্টার হেলিপ্যাডে নেমে আসে, ঠিক তেমন ভাবে চাঁদে তার চার পা রাখবে ভারতের বিক্রম। তার আগের মিনিটে নিদের তোলা চাঁদের ছবি পাঠিয়ে দেবে পৃথিবীতে।
৪৭ দিনের যাত্রাপথে মাঝের এক পর্বে ইসরো প্রধান কে শিবন বলেছিলেন, আমাদের তো প্রায় দম বন্ধ হয়ে ছিল কিছু ক্ষণের জন্য। জানিয়েছিলেন অবতরণের ‘দুর্ধর্ষ মুহূর্ত’-এর অপেক্ষায় রয়েছে তিনি। আজ কেমন ছিলেন শিবন? সারা দিনে এক বারই শুধু সংবাদ সংস্থার কাছে জানিয়েছেন, ‘‘আমরা আত্মবিশ্বাসী। সাফল্য আসবেই।’’ কিন্তু ফিরে এল সেই দম বন্ধ করা মুহূর্তগুলি।