আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক সমিত দাশগুপ্ত। ফাইল চিত্র
তিন সাতে একুশ। লিখলাম এক, হাতে রইল পেন্সিল। কিংবা কম্পিউটারের ইঁদুর।
অন্তত এত দিন আমরা তা-ই জানতাম।
কিন্তু সংখ্যাপুরুষেরা বলছেন, সব সংখ্যাই সংখ্যা নয়। তিন আর সাত সংখ্যা বটে। কিন্তু খুব সরল। তা দিয়ে খুব বেশি দূর কাজ এগোন যায় না। গণিতবিজ্ঞানীরা সে জন্য নানা ধরনের জটিলতা আবিষ্কার করে বসেছেন! হাজার হাজার বছর আগে মানুষ শূন্যর কথাও ভেবেছিল। শূন্য, অর্থাৎ যার কোনও অস্তিত্বই নেই! সেই শূন্যকেও একটা সংখ্যা হিসেবে ধরা হয়েছিল। যে কারণে অনেকে বলে থাকেন, শূন্য হল মানুষের সবচেয়ে বিপজ্জনক সৃষ্টি।
কিন্তু বিজ্ঞানীরা সেখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা আবিষ্কার করে ফেলেছেন কল্পিত সংখ্যা— ‘ইমাজিনারি নাম্বার’। শূন্যের মতো এরও অস্তিত্ব নেই। ভূতপ্রেতের মতো এই নম্বরও আমরা কল্পনা করেছি। সেই কল্পিত সংখ্যা যখন অঙ্কে ব্যবহার করা হয়, তা হয়ে যায় জটিল সংখ্যা। ‘কমপ্লেক্স নাম্বার’। জটায়ু থাকলে বলতেন, ‘‘বলেন কী মশাই!’’
প্রতীকী ছবি।
এই জটিল সংখ্যার উপর এক প্রবাসী বাঙালির ভাগ্য নির্ভর করছে। সমিত দাশগুপ্ত আমেরিকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের স্যর। কৃতী ছাত্র। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরিয়ে এখন অধ্যাপক। ছোটবেলা থেকেই অঙ্কে মন সমিতের। আক্ষরিক অর্থে হাতি লোফা তো সম্ভব নয়। কিন্তু খেলার ছলে কিশোর সমিত সর্বক্ষণ অঙ্কের হাতি লোফালুফি করতেন। ছেলের স্বভাবে যাতে গণিতচর্চা থাকে, সে দিকে নজর রেখেছিলেন বাবা-মা।
কলকাতার পদার্থবিদ দম্পতির চেষ্টার ফল পেতেও সময় লাগেনি। ১৯৯৫ সালে, ষোল বছর বয়সেই সমিত ‘ওয়েস্টিংহাউস সায়েন্স ট্যালেন্ট সার্চ’-এর চূড়ান্ত পর্বে জায়গা করে নেন। আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় দু’হাজার ছাত্রছাত্রী ওই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল সে বছর। চূড়ান্ত পর্বে জায়গা পায় মাত্র ৪১জন। তার মধ্যে ছিলেন এই বাঙালি। সে দেশের সংবাদপত্রে সমিতের নাম উঠে এসেছিল ‘নাম্বার থিয়োরি’ নিয়ে গবেষণাপত্র লিখে।
প্রতীকী ছবি।
অঙ্কশাস্ত্রে নানা শাখা-প্রশাখা আছে। যেমন বীজগণিত, পাটিগণিত ইত্যাদি। সে সব শাখা-প্রশাখার মধ্যে নাম্বার থিয়োরি বা সংখ্যাতত্ত্ব হল কুলীন ব্রাহ্মণ। শুধু সংখ্যা (এবং কল্পিত সংখ্যা) নিয়ে পণ্ডিতেরা নিজেরাই বিভিন্ন সমস্যা ফাঁদেন আর সেসব সমস্যার সমাধান করেন। তখন সমিতের কৃতিত্বের কথা বোঝাতে গিয়ে ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ লেখা হয়েছিল, ‘নাম্বার থিয়োরি হল এমন একটি বিষয়, যা অধিকাংশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে’। সেই কারণেই নাম্বার থিয়োরিকে মানুষের জ্ঞানচর্চার শীর্ষে রাখা হয়।
বস্তুত, দর্শন ও যোগ-বিয়োগের মাঝে কোনও দেওয়াল থাকে না। সংখ্যাতাত্ত্বিকদের পাণ্ডিত্যের অহঙ্কারও বেশি। তাঁদের নিয়ে প্রবাদও তেমনই প্রচুর। গ্রিসের সংখ্যাতাত্ত্বিক পাইথাগরাস তো সেই কোন প্রাচীন যুগে বলেছিলেন— ঈশ্বর হল শুধু একটা সংখ্যা!
সে হেন সংখ্যাতত্ত্বই স্কুলজীবন থেকে মন টেনেছে সমিতের। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখার অনেক আগে স্কুলবেলাতেই ‘মাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’-তে গিয়ে গণিত নিয়ে গবেষণা শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানেই বিভিন্ন সংখ্যার মধ্যে সম্পর্কের খোঁজ শুরু হয়েছিল তাঁর। কয়েক দশক পেরিয়েও সমিতের সঙ্গী গণিতশাস্ত্রের সেই গুরুতর অঙ্গ— ‘নাম্বার থিয়োরি’। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সে বিষয় নিয়েই পিএইচডি করেছেন। এখনও চলছে তাঁর চর্চা।
একে বাঙালি। তায় শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান। সহজ প্রশ্ন তাই সমিতের মন টানে না। প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে এক দুরূহ সমস্যা বেছে নিয়েছিলেন সমিত। ১০০ বছর আগে জার্মানির এক তুখড় অঙ্কবিদ ২৩টি সমস্যার হদিস দিয়ে বলেছিলেন, অঙ্ক বুঝতে হলে এ সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ১০০ বছর ধরে সে সব সমস্যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কদের রাতের ঘুম কেড়েছে। দু’-একটির সমাধান হয়েছে। কয়েকটি সমাধানযোগ্য নয় বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। বাকিগুলি ঘিরে এখনও চলছে সোনার হরিণের খোঁজ।
গণিত বিশারদদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র হল ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব ম্যাথেমেটিশিয়ান্স’। ফুটবলের বিশ্বকাপের মতোই যার আসর বসে চার বছর অন্তর অন্তর। দেশবিদেশের অঙ্কের পন্ডিতরা জড়ো হন সেই কনফারেন্সে। ১৯০০ সালে প্যারিস শহরে হয়েছিল কনফারেন্স। সেখানেই ওই ২৩টি সংখ্যার কথা প্রথম প্রকাশ করেন অধ্যাপক ডেভিড হিলবার্ট। যার সমাধান করতে পারলে হওয়া যাবে বিশ্ববরেণ্য অঙ্কবিদ। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে চলছে ‘হিলবার্টস প্রবলেম্স’ নিয়ে গবেষণা।
প্রতীকী ছবি।
গবেষণার জন্য হিলবার্ট সাহেবের ১২তম সমস্যাটি বেছে নিয়েছিলেন সমিত। আমেরিকা থেকে ভিডিয়ো কলে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তিনি জানালেন, গত কুড়ি বছর ধরে হিলবার্টের ১২তম সমস্যার সমাধান খুঁজতে মগ্ন থেকেছেন। শুধু তিনি একা নন। সেই কাজ ধাপে ধাপে এগিয়েছে তাঁর শিক্ষকদের হাতে। এখন সঙ্গে পেয়েছেন এক সহযোগী বন্ধুকে।
বছর কয়েক আগে কোরিয়ায় গণিতবিদদের এক কনফারেন্সে সমিতের আলাপ মহেশ কাকড়ের সঙ্গে। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান মরাঠি যুবক। ‘বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস’-এ গণিতের অধ্যাপক। আলাপ গড়ায় ইমেল আদানপ্রদানে। জানা যায়, দু’জনের ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে একই সমস্যার সমাধানের খোঁজে। সেই থেকে হিলবার্টের ১২তম সমস্যার সন্ধান চলছিল জুটিতে।
সুমিত-মহেশ যে সমস্যা বেছে নিয়েছিলেন, তা দু’-চার কথায় বুঝিয়ে বলা কঠিন। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে পরশপাথর খোঁজার মতো করে যার সমাধানের জন্য তোলপাড় করছেন বিশ্বের নামী-দামি গণিতবিদেরা, তা বোঝা সহজ নয়। সমিত- মহেশ দু’জন মিলে বার করেছেন সেই সমস্যার সমাধান। ১২১তম বছরের মাথায়। সম্প্রতি আমেরিকার এক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের গবেষণাপত্র। ‘কোয়ান্টা’ নামক পত্রিকায় তাঁদের কৃতিত্বের খবর প্রকাশিত হতেই সাড়া পড়ে গিয়েছে পৃথিবীর গণিতমহলে। ‘কোয়ান্টা’ মূলত বিজ্ঞানের পত্রিকা। কিন্তু সাধারণত অঙ্কশাস্ত্রের উপরেই তাদের নজর থাকে। ফলে এতে চোখ রাখেন দেশবিদেশের বিখ্যাত গণিত বিভাগের অধ্যাপক-গবেষকেরা।
অতঃপর সেই বিশ্ববিখ্যাত সমস্যায়। এখানেই যাবতীয় গাণিতিক গোলযোগ। হিলবার্ট সাহেব বলেছিলেন, প্রশ্নের সমাধান করতে হবে ‘কমপ্লেক্স’ অর্থাৎ ‘জটিল’ সংখ্যা দিয়ে। সমিত-মহেশ জটিল সংখ্যা ব্যবহার করেননি। ওঁরা অন্য সংখ্যা ব্যবহার করেছেন। ঢুকে পড়েছে আধুনিক কিছু গবেষণার ফসলও। জ্ঞানচর্চা হল রিলে রেসের মতো। একেক জন পণ্ডিত এগিয়ে নিয়ে যান সেই দৌড়ের ব্যাটন। তাঁর হাত থেকে সে ব্যাটন নিয়ে এগোন পরের জন। মহেশ বলেন, ‘‘জ্ঞান হল জ্ঞান। হিলবার্টের সময়ে অঙ্কের অনেক কিছু জানা যায়নি। অন্যান্য জ্ঞানের মতো গণিতশাস্ত্রও ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে। এ সময়ে বেঁচে থাকলে হিলবার্টও নিশ্চয়ই আধুনিক গবেষণা ব্যবহারে অনুমতি দিতেন।’’
এ কথার যুক্তি মেনে নেন বেশিরভাগই। রামকৃষ্ণ মিশনের মহান মহারাজ তথা টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের গবেষণারত গণিতজ্ঞ মনে করেন, ‘‘এ প্রয়াস চমকপ্রদ!’’ সে কথা স্বীকার করেন বরাহনগরের ইন্ডিয়ান স্ট্যাস্টিস্টক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ঋতব্রত মুন্সিও। তাঁর কথায়, ‘‘এক ধাপে অনেক দূর এগিয়ে গেল গণিতশাস্ত্র।’’ তবে তা সত্ত্বেও রক্ষণশীলেরা বলতে পারেন, ‘‘ভাল তো বটেই। কিন্তু হিলবার্ট তো হল না।’’ সে কথা জানেন সমিতও। তাই বলেন, ‘‘এর পরেও এটা নিয়ে কাজ চালিয়ে যাব।’’
পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু গবেষণাপত্রের প্রকাশনায় সমিত এবং মহেশ প্রথম সারির মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছেন। পরের ধাপ আরও কঠিন। প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁরা। অন্যান্য শাস্ত্রের মতো অঙ্কশাস্ত্রও এখন অতি প্রতিযোগিতাপ্রবণ। দু’জন ভারতীয়— মঞ্জুল ভার্গব এবং অক্ষয় ভেঙ্কটেশ ইতিমধ্যে ‘ফিল্ড মেডেল’ পেয়েছেন। যা অঙ্কের নোবেল পুরস্কার! আরও এক জন (হরিশচন্দ্র) নেহাত বেশি বয়স বলে পুরষ্কারটি লাভ করেননি।
ভারতকে গণিতের প্রায় আঁতুড়ঘরই বলা যায়। প্রাচীন যুগের আর্যভট্ট থেকে ব্রহ্মগুপ্ত, ভাষ্কর থেকে হেমচন্দ্র— গণিতশাস্ত্রে নানা দিশা দেখিয়েছেন। শূন্যের সন্ধান থেকে অঙ্কে দশমিকের ধারণা যোগ করেছে ভারত। ত্রিকোণমিতি, বীজগণিতের বহু গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব আবিষ্কার হয়েছে এ দেশে। আর ইতিহাসের বিখ্যাততম কেরানি, মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টের শ্রীনিবাস রামানুজন। তাঁর জীবন এবং অঙ্ক— সবই কিংবদন্তি দিয়ে মোড়া। রামানুজনের পর হরিশচন্দ্রকে বাদ দিলে এ দেশে সে অর্থে আর ডাকসাইটে অঙ্কবিদ তৈরি হয়নি। কিন্তু এখন সে ক্ষেত্রেও বদল দেখা যাচ্ছে। ভার্গব আর ভেঙ্কটেশ হয়তো লটারির টিকিট পেয়েছেন। তবে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেস, মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ থেকে কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটেও প্রথম শ্রেণির নানা কাজ হচ্ছে অঙ্কশাস্ত্রে। সময় বলতে পারবে, সে সবের মধ্যে সমিত এবং মহেশ মহাজ্ঞানী-মহাজন হিসেবে জায়গা করে নেবেন কি না!
পুনশ্চ: অঙ্কের এই দুরূহ তত্ত্ব আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছেন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমিত দাশগুপ্ত, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের মহান মহারাজ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সেসের মহেশ কাকড়ে এবং ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার ঋতব্রত মুন্সি। সেই তত্ত্ব পরিবেশনে কোনও ভুল-ত্রুটি হয়ে থাকলে তার দায় একান্তই আমাদের।