প্রাণীজগতের বিচিত্র খাদ্যাভ্যাস নিয়ে বহু কাল ধরেই চলছে নানা গবেষণা। বিশ্ব জুড়ে কত যে প্রজাতির প্রাণী আর কী বিচিত্র যে তাদের খাদ্যাভ্যাস, তা প্রায় নিত্যদিনই চমকে দেয় বিজ্ঞানীদের। কিন্তু এ বারের চমকটা যেন একটু বেশিই। অজানা তথ্যের ভাণ্ডারে নতুন সংযোজন এক নতুন প্রজাতির ঝিনুকের।
একটি ঝিনুক নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী প্রয়োজন মনে হলে আগেই বলে দেওয়া ভাল, এই ঝিনুক খায় পাথর! আবার সেটিই মল আকারে যখন বেরোয়, তখন হয়ে যায় বালি!
ফিলিপিন্সের আবাতান নদীতে ২০০৬ সালে প্রথম এই ঝিনুকটিকে দেখতে পান ফ্রান্সের 'ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচরাল হিস্ট্রি'র সদস্যরা। এই ঝিনুক আদতে 'শিপ ওয়ার্ম' গোত্রের। সেই সময় তাঁরা এই 'শিপ ওয়ার্ম'টিকে 'টেরেদিনিদি' গোত্রের বলে মনে করেছিলেন।
ঝিনুকের মধ্যেও নানা প্রজাতি ও গোত্র রয়েছে। এই ঝিনুক এক প্রজাতির ‘শিপ ওয়ার্ম’। একে সমুদ্রের উইপোকা বলেও অভিহিত করেন অনেকে।
এই গোত্রের কীট বা ঝিনুকগুলি মূলত নোনা জলে বসবাস করে। এর নামকরণও হয়েছে তাদের খাদ্যাভাসের উপর ভিত্তি করেই। 'শিপ ওয়ার্ম' নাম থেকেই বোঝা যায়, এরা মূলত জাহাজে বা বন্দরের কাঠের পাটাতনে খোলসের মধ্যে থাকে এবং কাঠ খেয়েই জীবনযাপন করে।
সম্প্রতি ফিলিপিন্সে জীব বৈচিত্র অভিযানে গিয়ে এই শিপ ওয়ার্মটিকে পাথরের ভিতরে দেখতে পান গবেষকরা। চমকের শুরু তখন থেকেই। শিপ ওয়ার্ম হলে তা পাথরের মধ্যে কী করছে?
এরপর নানা পরীক্ষা চালিয়ে দেখা যায় যে, যেটিকে তাঁরা শিপ ওয়ার্ম ভাবছিলেন, সেটি আসলে এক নতুন প্রজাতির ঝিনুক। চমকের পরের ধাপে তাঁরা দেখেন, এই ঝিনুকটি পাথর খাচ্ছে এবং মল হিসাবে বালি বের করছে! গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন লিথোরেডো অ্যাবাটানিকা।
শিপ ওয়ার্ম জলে ডুবে থাকা বা বিচূর্ণ কাঠ খেয়ে তাদের ফুলকায় উপস্থিত সিম্বায়োটিক ব্যাকটিরিয়ার দ্বারা হজম করে নেয়। এই ব্যাকটিরিয়ায় এক উৎসেচকের খোঁজ মিলেছে যা নতুন ওষুধ আবিষ্কারে সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বস্টনের নর্থ-ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির গবেষক রুবেন শিপওয়ে এবং ড্যানিয়েল ডিস্টেন স্থানীয় বাসিন্দাদের পরামর্শে নদীর তলদেশে এই প্রাণীর খোঁজ চালাতে যান। সেখানেই তাঁরা পাথরের মধ্যে এই প্রাণীটিকে দেখতে পান।
গবেষকরা পাথরের ভিতর থেকে লিথোরেডো অ্যাবাটানিকাকে বের করে নানা পরীক্ষা ও ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে পান, 'সিকাম' নামক এক অঙ্গ যা বাকি শিপ ওয়ার্মে উপস্থিত থাকে, তা এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। এই সিকাম শিপ ওয়ার্মগুলিকে কাঠ হজমে সাহায্য করে।
লিথোরেডো অ্যাবাটানিকার পেটের ভিতর থেকে বেশ কিছু পাথরের অংশ পাওয়া গিয়েছে, যা ওই এলাকার পাথরেরই অংশ যেখান থেকে শিপওয়ার্মগুলি সংগ্রহ হয়েছিল। এর মল পর্যবেক্ষণ করেও একই পাথরের অংশাবশেষ পাওয়া গিয়েছে।
শিপওয়ে বলেন, “আপাত ধারণা থেকে মনে করা হচ্ছে যে, এই শিপওয়ার্মগুলি পাথরের মধ্যে থেকে কোনও ভাবে পুষ্টিগুণ পাচ্ছে। এই পদ্ধতিটি আমাদের অজানা। তবে এর ফুলকা অন্যান্য শিপ ওয়ার্মগুলির তুলনায় বড়ো হওয়ায় মনে করা হচ্ছে, পাথর হজমে এই ফুলকা বিশেষ ভূমিকা পালন করে।”
গবেষক ও ডিরেক্টর ড্যান ডিন্সেল বলেন, “এটি বাকি প্রজাতি ও গোত্রের শিপ ওয়ার্মের তুলনায় এতটাই আলাদা যে, আমরা একে নতুন বর্গের অন্তর্ভুক্ত করেছি। লিথোরেডো অ্যাবাটানিকা আমাদের চমকে দিয়েছে। বাকি শিপ ওয়ার্মের ফুলকার ভিতরে পাওয়া ব্যাকটিরিয়া থেকে এর ভিতর পাওয়া ব্যাকটিরিয়া একেবারেই আলাদা।”
ফিলিপিন্সের আবাতান নদীর পাড়ে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যেই দেখা মিলছে এই শিপ ওয়ার্মের। এটির নামে ওয়ার্ম থাকলেও এটি আসলে এক প্রকার ঝিনুক। কিন্তু দেহের আকার বড়ো হওয়ায় খোলসের মধ্যে নয়, বাইরেই থাকে সাদা জেলির মতো দেহাংশ।
শিপওয়ার্মের আকার মূলত ১ ফুট থেকে ৫ ফুট হয়। লিথোরেডো অ্যাবাটানিকার আকার প্রায় ৪ ফুট। রয়েছে কয়েক ডজন দাঁতও। এই নতুন শিপ ওয়ার্মের বিষয়ে জানা বাকি আরও।