গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
হ্যাঁ, আগামী বছরে মহালয়ার ৩৬ দিন পর মণ্ডপে মণ্ডপে বাজবে মহাসপ্তমীর ঢাক। সর্বত্র।
বিশ্বাস হচ্ছে না তো? ভাবছেন, তা আবার হয় নাকি? প্রতি বছরই তো মহালয়ার সাত দিনের মাথায় হয় মহাসপ্তমীর পুজো। বলবেন, তেমনটাই তো জন্মাবধি দেখে আসছি! কখনও তো দেখিনি সেই নিয়ম বদলে গিয়েছে। মহাসপ্তমীর তিথি এক মাসেরও বেশি সময় দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মহালয়ার দিনটি থেকে, এ আবার হয় নাকি!
হয়। কালেভদ্রে হয়। কিন্তু একেবারেই হয় না, এই সব চটকদার বুজরুকি বা বাজার মাত করার জন্য শুধুই কথার কথা, এ কথা বলা যাবে না।
তবে সপ্তাহ দুয়েক ধরে পুজোর আনন্দ উপভোগ করার রেওয়াজ পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে গত বছর থেকেই। মহালয়ার বেশ কয়েকদিন আগে এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি পুজোর উদ্বোধন হয়েছিল গত বছর। এ বারও মহালয়ার অনেক আগেই পুজোর উদ্বোধন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। ফলে আগামী বছর প্রায় দু’মাস ধরে এ রাজ্যে পুজোর উৎসব চলবে এমনটাই ধরে নেওয়া যায়।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ২০২০ সালে মহালয়া হবে ১৭ সেপ্টেম্বর ভোরে। যাকে শাস্ত্রকাররা বলেন, পিতৃপক্ষ শেষ হয়ে দেবীপক্ষের শুরুর তিথি। পিতৃতর্পণের দিন।
মহালয়ার ৩৬ দিনের মাথায় মহাসপ্তমী!
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০২০ সালে মহাসপ্তমীর তিথিটি আসবে অক্টোবরের ২৩ তারিখে। হ্যাঁ, ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ও সে কথাই বলছে।
কেন? তা হলে কি সূর্যকে অন্য ভাবে প্রদক্ষিণ শুরু করতে চলেছে পৃথিবী? চাঁদ কি অন্য ভাবে প্রদক্ষিণ করবে পৃথিবীকে? না হলে দু’টি তিথির মধ্যে এতটা ব্যবধান হবে কেন?
না, তেমন কিছু নয়। নয় কোনও আধিদৈবিক ঘটনা, অলৌকিকও। এই ঘটনা একেবারেই প্রাকৃতিক। যার বিজ্ঞান রয়েছে। আর সেই বিজ্ঞানের হাত ধরেই এমন চটকদার ঘটনা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য চালু রয়েছে সংস্কার, দীর্ঘ দিনের চালু প্রথার অদম্য প্রয়াসও।
আরও পড়ুন- হকিংয়ের সন্দেহ কি অমূলকই? তার কোনও চুল নেই! জানাল ব্ল্যাক হোল
আরও পড়ুন- নোবেল থেকে পাঁচ বার বঞ্চিত এই বাঙালি!
যদি বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখি, তা হলে বলতেই হবে, সৌর ও চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের ব্যবধানকে মিলিয়ে দেওয়ার জেরেই ঘটে এই ঘটনা। আর পুজো-পার্বণের দিনক্ষণ, তিথি বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু মিলেমিশে থাকে ধর্মবিশ্বাস, কিছু সংস্কার, দীর্ঘ দিনের চালু প্রথা, তাই সেগুলি সহায়ক হয়ে ওঠে এই ঘটনাগুলি ঘটানোর জন্য।
কবে মহালয়া? কবে মহাসপ্তমী?
প্রথমে বলি, আগামী বছরের মহালয়া আর পুজোর দিনক্ষণের কথা। ১৭ সেপ্টেম্বরের ভোরে হবে মহালয়া। আর যার সঙ্গে আমার, আপনার মধ্যে অনেকেই, পুরোহিতরা তো বটেই রেখে চলি প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ, সেই পঞ্জিকা জানাচ্ছে, ২০২০ সালে মল চন্দ্র আশ্বিন মাস শুরু হচ্ছে মহালয়ার ঠিক পরের দিনটি থেকেই। ১৮ সেপ্টেম্বর। সেই মল চন্দ্র আশ্বিন মাস শেষ হবে অক্টোবরের ১৬ তারিখে।
তা সে বিয়ে, পৈতে, জমি কেনাই বলুন বা কোনও পুজো, পার্বন বা উৎসব (ইংরেজিতে ‘ফেস্টিভ্যাল’ কথাটা যার সঙ্গে একেবারে ঠিকঠাক ভাবে খাপ খায়), আমাদের বহু প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে মল মাসে সেই সব কিছুই নিষিদ্ধ। করা যায় না। আর সেটা যদি দুর্গা পুজো হয়, তা হলে সেটা কখনই হতে পারে না মল চন্দ্র আশ্বিনে। তাকে হতেই হবে শুদ্ধ চন্দ্র আশ্বিন মাসে।
পঞ্জিকা বলছে, আগামী বছরে তা শুরু হবে ১৭ অক্টোবর। ফলে, মহাসপ্তমীর দিনটি হবে ২৩ অক্টোবর। মহালয়ার তিথি থেকে ৩৬ দিনের মাথায়।
সল্টলেকের ‘পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টারে’র (পিএসি) অধিকর্তা সঞ্জীব সেন বলছেন, ‘‘এই শতাব্দীতে এই ঘটনা এর আগে এক বারই ঘটেছিল। আজ থেকে ১৮ বছর আগে। ২০০১ সালে। সে বারও মহালয়ার দিনটি ছিল ১৭ সেপ্টেম্বর। আর মহাসপ্তমীর দিনটি ছিল ২৩ অক্টোবর। ব্যবধানটা ছিল সেই ৩৬ দিনেরই। এই শতাব্দীতে এই ঘটনা ফের কবে ঘটবে, তা হিসেব কষে বলতে হবে। তবে গত শতকে এমন ঘটনার কথা এখন মনে পড়ছে না।’’
হিন্দু শাস্ত্রে কাকে বলা হয় ‘মল মাস’?
এটা বোঝার জন্য আগে জানা দরকার, অমাবস্যা আর পূর্ণিমা হয় কখন? কী ভাবে?
অমাবস্যার দিন প্রদক্ষিণ করতে করতে সূর্য আর পৃথিবীর মাঝে চলে আসে চাঁদ। অমাবস্যার সময় চাঁদ আর সূর্য একই সঙ্গে ওঠে আর ডোবে। ফলে, দিনে সূর্যের চোখ ঝলসে দেওয়া আলোয় যেমন হারিয়ে যায় চাঁদ, তেমনই রাতে একই সঙ্গে ডুবে যাওয়ার ফলে সূর্যের আলো চাঁদের পিঠে প্রতিফলিত হলেও রাতের আকাশে চাঁদ দৃশ্যমান হয় না। তাই, আমাদের রাতের আকাশে নেমে আসে জমজমাট অন্ধকার।
পূর্ণিমার দিন ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটে। পৃথিবী চলে আসে চাঁদ আর সূর্যের মাঝখানে। সে ক্ষেত্রে সূর্য ডুবলে চাঁদ ওঠে। পরের দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই চাঁদ ডোবে। তাই সারা রাত চাঁদ ঝকঝক করে ওঠে আলোয়।
একটি সৌর মাসে সাধারণত, একটি অমাবস্যা আর একটি পূর্ণিমা হয়। একটি অমাবস্যা থেকে পরের মাসের অমাবস্যার দিনটিতে পৌঁছতে সময় লাগে গড়ে সাড়ে ২৯ দিন। একই সময় লাগে একটি পূর্ণিমার তিথি থেকে পরের মাসের পূর্ণিমার দিনটিতে পৌঁছতে।
সৌর ও চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের ফারাক ১১ দিনের
সঞ্জীব জানাচ্ছেন, এই সময়টাকে ধরে পার্থিব মাসের হিসেব কষা হলে আমরা তাকে বলি, ‘চন্দ্র মাস’। তার মানে, চন্দ্র মাসের দৈর্ঘ গড়ে সাড়ে ২৯ দিন। ফলে, এক চন্দ্র বছরে হয় ১২x২৯.৫ দিন = ৩৫৪ দিন। এটাই বিজ্ঞানের পরিভাষায়, ‘লুনার ইয়ার’। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর বছরের হিসেব কষা হচ্ছে চাঁদ ও পৃথিবীর অবস্থানের নিরিখে। পৃথিবীকে চাঁদের প্রদক্ষিণের নিরিখে।
আরও এক ভাবে পার্থিব বছরের হিসেব কষা হয়। তাকে বলা হয় সৌর বছর বা ‘সোলার ইয়ার’। সূর্যকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ করতে যে সময় লাগে, তার ভিত্তিতে। সেই সময়টা কিন্তু ৩৬৫ দিন।
ফলে, চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের সঙ্গে সৌর বছরের দৈর্ঘের ফারাকটা থেকে যায় ১১ দিনের।
এই সৌর বছরের হিসেবের ভিত্তিতেই ইংরেজি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে সংশোধন করে চালু হয়েছিল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। ইংল্যান্ডের রাজা ত্রয়োদশ গ্রেগরির শাসনকালের স্মরণে। সেই ক্যালেন্ডারে ‘লিপ ইয়ার’-এর বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেটা ১৫৮২ সাল। সেই ক্যালেন্ডার ফের সংশোধিত হয় ১৭৫২ সালে। সেটাই আধুনিক ইংরেজি ক্যালেন্ডার।
কোথায় সুবিধা সৌর মাসের? কোথায় অসুবিধা চন্দ্র মাসের?
সঞ্জীবের কথায়, ‘‘সৌর বছরের হিসেবে একটা সুবিধা রয়েছে যা চন্দ্র বছরের হিসেবে নেই। কোনও সৌর বছরে যদি জানুয়ারিকে শীতের মাস বলে ধরা হয়, তা হলে ৫০০ বছর পরেও শীত আসবে জানুয়ারিতেই। যার মানে, বিভিন্ন মরসুমের সঙ্গে খাপ খায় সৌর বছরের মাসের হিসেব।’’
কিন্তু চন্দ্র বছরের সঙ্গে তা খাপ খায় না। সৌর বছরের তুলনায় চন্দ্র বছরে ১১টি পার্থিব দিন কম হয়। ফলে, তিন বছরে সেই ফারাকটা দাঁড়ায় ৩৩ দিনের। যার অর্থ, তিন বছর অন্তর সৌর বছরের তুলনায় চন্দ্র বছরে এক মাসের কিছু বেশি সময় করে কমে যাচ্ছে দিনের সংখ্যা। তাই চন্দ্র মাসের হিসেবের সঙ্গে মরসুমের হিসেব মেলে না। যেমনটা মেলে সৌর বছরের ভিত্তিতে বানানো ক্যালেন্ডারের সঙ্গে।
সঞ্জীব জানাচ্ছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন মরসুমের সঙ্গে মাসের সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য অঙ্ক কষে দেখা গিয়েছে, ১৯ বছরে যদি ৭টা করে বাড়তি মাস যোগ করা দেওয়া যায়, তা হলে সৌর ও চন্দ্র বছরের মধ্যে দৈর্ঘের ব্যবধানটা আর থাকে না। তার ভিত্তিতে যে ক্যালেন্ডার বানানো হয়, তাকে বলা হয়, ‘লুনি-সোলার ক্যালেন্ডার’ বা ‘চন্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডার’।
তার মানে, গড়ে ২.৭ বছর পর একটা করে মাস যোগ করলে সৌর ও চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের ব্যবধানটাকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়।
প্রাচীন ভারত এই সমস্যা মিটিয়েছিল অভিনব উপায়ে!
কিন্তু ভারতে প্রাচীন কাল থেকে যে চন্দ্র ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ২.৭ বছর অন্তর একটা করে মাসকে যোগ করে সৌর ও চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের বিভেদ মেটানোর চেষ্টা করা হয়নি।
নেওয়া হয়েছিল অন্য একটি পদ্ধতি। কোনও সৌর মাসে একটি অমাবস্যা আর একটি পূর্ণিমা হয়। কিন্তু কোনও সৌর মাসে যদি দু’টি অমাবস্যা পড়ে, তা হলে প্রথম অমাবস্যার দিনটি থেকে পরের অমাবস্যার দিনটি পর্যন্ত সময়কে বলা হয়, ‘মল চন্দ্র মাস’।
আর দ্বিতীয় অমাবস্যার দিনটি থেকে পরের সৌর মাসের অমাবস্যার দিনটি পর্যন্ত সময়কে বলা হয়, ‘শুদ্ধ চন্দ্র মাস’। ‘তিথি’কে চন্দ্র মাসেরই একটি দিন হিসেবে ধরা হয়।
১৯ বছরে এমন ঘটনা ঘটে ৭টি
সঞ্জীবের বক্তব্য, দেখা গিয়েছে এমন ঘটনা ১৯ বছরে ৭টি ঘটে। আর তাতে সৌর ও চন্দ্র বছরের দৈর্ঘের ভেদাভেদ আপনাআপনিই মিটে যায়। তার জন্য গড়ে ২.৭ বছরে একটা করে বাড়তি মাস যোগ করতে হয় না।
তাই আগামী বছরের মহাসপ্তমীর দিনটি পড়বে শুদ্ধ চন্দ্র আশ্বিন মাসে। ২৩ অক্টোবর। মহালয়া থেকে ৩৬ দিনের মাথায়। ওই দিনই আশ্বিন শুক্ল সপ্তমী।
কেন আগামী বছর ১৭ সেপ্টেম্বর হবে মহালয়া?
সঞ্জীব বলছেন, ‘‘তার কারণ, ওই দিনটিই ভাদ্র কৃষ্ণ অমাবস্যা। ওই দিনই পালিত হয় মহালয়া।’’