‘রাজপুত্তুর মশাই রাজপুত্তুর! কী যে গড়ন যেন ননীর চাপ থেকে কেটে তুলেছে।’ এক টাকায় একজোড়া ইলিশ কিনে তারই বর্ণনা দিচ্ছে নবীন। ১৮৯৭ সনে লেখা রামলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক ‘কষ্টিপাথর’-এর সংলাপ। কলকাতায় তখন গঙ্গার ইলিশের ঘাট ছিল। তক্তা ঘাট, বাবু ঘাট, বাগবাজারের ঘাট, বিচালি ঘাট। তখন এমন কিছু ভোজনরসিক বাবু ছিলেন, যাঁরা ইলিশ খেয়ে বলে দিতে পারতেন, তা কোন ঘাটের না কি মাঝগঙ্গার।
প্রাচীন কালেও এই মাছ বাঙালির প্রিয় ছিল। তখন অবশ্য ভালবেসে একে ইল্লিশ বা ইলসা বলে ডাকা হত। সে সময়ে ব্রাহ্মণদের মধ্যে সব মাছ খাওয়ার চল ছিল না। শ্বেতবর্ণ, আঁশযুক্ত মাছ খাওয়ারই বিধান ছিল ব্রাহ্মণদের। ফলে এই রুপোলি মাছ খুব সহজেই তাঁদের প্রিয় হয়ে ওঠে। ক্রমশ স্বাদে-গন্ধে সেরা মাছ হয়ে ওঠে সকলের কাছে। শাস্ত্রকার জীমূতবাহনের প্রাণিজ তেলের তালিকায় ইলিশ মাছের তেল ও তার ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইলিশ মূলত সমুদ্রের নোনা জলের মাছ। ডিম পাড়ার সময়ে মিষ্টি জলের খোঁজে এরা বঙ্গোপসাগর দিয়ে ঢুকে প্রায় ফরাক্কা অবধি পৌঁছে যায়। ব্যারাজ তৈরির আগে ইলিশের দৌড় ছিল বহু দূর। ইলাহাবাদ পেরিয়ে আগরা পর্যন্ত পৌঁছে যেত এই রুপোলি শস্য। গঙ্গা ও রূপনারায়ণ ছাড়াও বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, অন্ধ্রপ্রদেশে গোদাবরী নদীতেও ইলিশ পাবেন। তবে গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশই সবচেয়ে স্বাদু। ভাপা, ভাজা বা ঝোল... যেমনই রাঁধুন না কেন, এ মাছের স্বাদ অতুলনীয়। কালো জিরে, বেগুন দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল বা সরষে বাটা দিয়ে ভাপা কিংবা কলা বা লাউপাতায় মুড়ে ইলিশ পাতুরি সমান জনপ্রিয়। এ ছাড়া কাঁচকলা দিয়েও ইলিশের ঝোল হয়। ও পার বাংলায় অবশ্য ইলিশ রান্নায় পেঁয়াজ-রসুনের ব্যবহার চলে। ইলিশের মাথা দিয়ে কচু পাতা বা শাকের পদ বেশ লোভনীয়। বাঙালির পাত থেকে বিদেশিদের মন ছুঁতেও ইলিশের সময় বেশি লাগেনি। তাই হয়তো কাঁটা ছাড়িয়ে স্মোক্ড হিলসার আবিষ্কার। ইলিশকে ডি-বোন করে এখন তো কাবাবও তৈরি হচ্ছে। ও পার বাংলায় অবশ্য ইলিশ পোলাও আর বিরিয়ানি ছাড়া দাওয়াত হয় না। তবে সারা বছর ইলিশ পাবেন না সেখানে। পূর্ববঙ্গীয়দের মধ্যে ইলিশ খাওয়ার রীতি আছে। সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ এনে ধান, দূর্বা, সিঁদুর দিয়ে বরণ করে ঘরে তুলে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই মাছ খাওয়া শুরু হয়। বিজয়া দশমীর দিন জোড়া ইলিশ খেয়ে সে বছরের মতো ইলিশ খাওয়ার সমাপ্তি।
ইলিশের মতো প্রায় মধ্যযুগ থেকেই বাঙালি চিংড়ি দিয়ে উদরপূর্তি করে আসছে। তবুও উৎসব-অনুষ্ঠানে সেই মালাইকারি। যদিও আসল কথাটা ‘মালয় কারি’। কারণ রান্নাটা মালয় দেশবাসী দক্ষিণ ভারতীয়দের আবিষ্কার। এর প্রমাণ পাওয়া যায় রোজ়মেরি ব্রিসেনডেনের ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ান ফুড’ বইয়ের চতুর্থ পরিচ্ছদে। এর বাইরেও বিবিধ রন্ধনপ্রণালী আছে। যার উল্লেখ রয়েছে মঙ্গলকাব্যে। কুচো, চাপড়া বা বাগদা হলে তা দিয়ে চচ্চড়ি, লাউ, থোড়, মোচা রান্না হয়। বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’-এ উল্লেখ আছে চিংড়ি রান্নার, ‘ভিতরে মরিচ-গুঁড়ো বাহিরে জড়ায় সূতা। তৈলে পাক করি রান্ধে চিংড়ির মাথা।’ আবার দ্বিজ বংশীদাসের ‘মনসামঙ্গল’-এ পাওয়া যায়, ‘বড় বড় ইঁচা মৎস্য করিল তলিত।’ ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ খুল্লনার চিংড়ির বড়া বা ‘অন্নদামঙ্গল’-এ পদ্মমুখীর রান্না ইছার (চিংড়ি) ঝোলকে ভুললেও চলবে না। সেই রান্নাই নতুন ভাবে সেজেগুজে এখন পোশাকি নাম নিয়েছে। তেলে মাখা চিংড়ির বড়াই সাজ পালটে হয়ে গিয়েছে প্রন কাটলেট। অন্য দিকে বড় বড় চিংড়ির ঝোলে ফুলকপি দিয়ে হয়েছে চিংড়ির ফুলঝোল। এ ছাড়াও রয়েছে হাজারো পদ। সরষে-পোস্ত-নারকেল বাটা ও কাঁচা লঙ্কা দিয়ে চিংড়ির পাতুরি করা যায়। বাঙালি কিন্তু আভেনের আগমনের আগে থেকেই বেক করতে জানত। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেক্ড প্রনের রেসিপি থেকে। কুচো চিংড়ির খোসা ছাড়িয়ে সরষের তেল, নুন, হলুদ ও সরষে বাটা দিয়ে মেখে নারকেলের মধ্যে পুরে দেওয়া হত। নারকেলের দুটো মালা মাটি দিয়ে লেপে বন্ধ করে উনুনের মধ্যে দিয়ে রাখতে হত প্রায় ঘণ্টাখানেক। উনুনের ঢিমে আঁচে চিংড়ি মজে মাখন হয়ে যেত। এ ছাড়াও বানিয়ে ফেলতে পারেন চিংড়ির পাফ, কাটলেট, সাল্মি বা চিংড়ির আচার।
ভাপা-মালাইকারির বাইরেও ইলিশ, চিংড়ির এই লোভনীয় পদ থেকে দু’টি রেসিপি দেওয়া হল।
চিংড়ির ফুলঝোল
উপকরণ: গলদা চিংড়ি ৭-৮টি, ফুলকপি ১টি, আলু ৩টি, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, আদা-রসুন বাটা দেড় চা চামচ, তেজপাতা ৩টি, গোটা জিরে ১ চা চামচ, জিরে গুঁড়ো ১ চা চামচ, ধনে গুঁড়ো ১ চা চামচ, গরম মশলা গুঁড়ো ১ চা চামচ, লঙ্কা গুঁড়ো ১ চা চামচ, সরষের তেল ১ কাপ, ঘি ১ টেবিল চামচ, নুন ও চিনি অল্প।
প্রণালী: নুন-হলুদ মাখিয়ে চিংড়ি সরষের তেলে ভেজে নিন। আলু ও ফুলকপি ডুমো করে কেটে ভেজে রাখুন। তেলে জিরে, তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে পেঁয়াজ কুচি দিন। তাতে আদা-রসুন বাটা, হলুদ ও লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষাতে থাকুন। কিছুক্ষণ পরে অল্প জলে ধনে ও জিরে গুঁড়ো গুলে কড়াইয়ে দিন। তেল ছাড়লে আলু, কপি দিয়ে নাড়াচাড়া করে জল দিয়ে সিদ্ধ করুন। অর্ধেক সিদ্ধ হয়ে এলে চিংড়ি দিন। নামানোর আগে ঘি ও গরম মশলা ছড়িয়ে দিন।
ডাব ইলিশ
উপকরণ: ইলিশ ৪ টুকরো, শাঁস-সহ ডাব ২-৩টি, হলুদ ও কালো সরষে ৪ টেবিল চামচ, পোস্ত বাটা ১ চা চামচ, কাজু বাদাম বাটা ১ টেবিল চামচ, সরষের তেল ৪ টেবিল চামচ, কাঁচা লঙ্কা ৫-৬টি, নুন স্বাদ মতো।
প্রণালী: ডাবের শাঁস বেটে নিন। একটি বড় ডাবের মুখ কেটে জল ও শাঁস বার করে রাখুন। বড় বাটিতে শাঁস বাটা, শাঁস কুচি, কাজু-সরষে-পোস্ত বাটা, কাঁচা লঙ্কা, তেল ও নুন মিশিয়ে, মাছের টুকরো মাখিয়ে রাখুন। ডাবের মধ্যে এই মাছ ভরে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলে মুড়ে নিন। ২৫ মিনিট ভাপিয়ে নামিয়ে নিন ডাব ইলিশ।
চিংড়ির পদ: সোমা চৌধুরী, ছবি: দেবর্ষি সরকার; ইলিশের পদ: সায়ন্তনী মহাপাত্র, ছবি: শুভেন্দু চাকী