বাঙালিকে যেমন উত্তমকুমারের মধ্য দিয়ে চেনা যায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত-র মধ্য দিয়ে চেনা যায়, হেমন্তবাবুর মধ্য দিয়ে চেনা যায়— ঠিক তেমনই চেনা যায় লুচি, ইলিশমাছ আর রসগোল্লার মধ্য দিয়ে। আর চেনা যায় একটি গোলগাল, রংবাহার সুস্বাদু ফল দিয়ে— যার নাম আম। সারা ভারতে আমের ফলন এত ভাল যে সেটা পৃথিবীর মোট ফলনের মোটামুটি পঞ্চাশ ভাগ। আর তাই এই মিষ্টি ফলটিকে ভারতবর্ষের জাতীয় ফলের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। একসময় যেমন সেরা সাহিত্য, সেরা চিত্রকলা, সেরা সঙ্গীত আর সেরা ছায়াছবির আখর ছিল এই বাংলা— তেমনই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ফলন হলেও, দেশের সেরা আমটি যে এই বাংলাদেশেই ফলত (বা বলা ভাল এখনও ফলে) তা বলাই বাহুল্য। কলা কেমন যেন আঠা-আঠা, বেদানার ওপরের ছালটা ছাড়ানো বেশ ঝামেলার, আপেলের মধ্যে একটু যেন একঘেয়ে ব্যাপার আছে। শাঁসের তুলনায় বীজের ভাগ বেশি এমন ফল— যেমন লিচু, সবেদা, কাঁঠাল বা তরমুজের কথা আমি আর এখন টেনে আনলাম না। কিন্তু এমন পেলব, এমন বিনয়ী, এমন মিষ্টি আর এমন আনন্দে ভরা একটি ফল, যার ওপরের ছাল আর ভেতরের আঁটিটি একটা বাচ্চা ছেলেও সামান্য চেষ্টাতেই ছাড়িয়ে ফেলতে পারবে— এর মধ্যেই যদি প্রকৃত বাঙালিয়ানা না থাকে তবে আর আছে কীসে?
হালের কথা বলতে পারব না, তবে আমাদের ছোটবেলায় মধ্যবিত্ত বাঙালি যেমন পয়লা বৈশাখের লেমোনেড আর ক্যালেন্ডারের জন্য, দুর্গাপুজোর নতুন জামাকাপড়ের জন্য, আর বড়দিনে নিউমার্কেটের পাম-কেকের জন্য সারাবছর হা-পিত্যেশ করে বসে থাকত— ঠিক তেমনই বসে থাকত গরমকালের আমের জন্য। স্বর্ণযুগের যে কোনও ভাল বাংলা সিনেমার শুরুতেই হিরো বা হিরোইনকে (যেমন উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা সেন, বা অরুন্ধতী দেবীদের) যেমন দেখতে পাওয়া যেত না। তাঁরা ছবির একটি বিশেষ মুহূর্তে দর্শককে চমকে দিয়ে রুপোলি পর্দায় ফুটে উঠে, তাদের বুক উথাল-পাথাল করে দিতেন। আর তার আগের সিনগুলি অপূর্ব সব ক্যারেক্টর আর্টিস্টদের (যেমন পাহাড়ি সান্যাল, তরুণকুমার, বিকাশ রায়, ছায়া দেবী বা মলিনা দেবীদের) কন্ট্রোলে থাকত, ঠিক তেমনই হিমসাগর বা ল্যাংড়া ঢোকার আগে কলকাতার পুরনো ফলের বাজারগুলোকে গোলাপখাস বা লালমণির মতো আমেরা কন্ট্রোলে রাখে। এরা যেন কোনও গুরুত্বপূর্ণ মানুষের গাড়ির কিছুটা সামনে সামনে ছুটে-চলা সেই পাইলট-কার, যারা জানান দিচ্ছে— ওই, উনি এসে গেলেন বলে!
এখন বাজারে ওঠার সময়কে খেয়াল করলে গোলাপখাস আসে সবার আগে। ঠিক বৈশাখের মাঝামাঝি। কেরল থেকে আসা গোলাপখাসের সুন্দর গন্ধ। এরা সাইজে বড়সড় আর মিষ্টি। ম্যাড্রাসি গোলাপখাস একটু লম্বাটে। এরা মাঝে মাঝে একটু টোকো হয় আর ভেতরে একটু আঁশ থাকে। আমাদের টালিগঞ্জ বা বারুইপুরের পুরনো বাগানগুলির ছোট মাপের দিশি গোলাপখাস কিন্তু বেশ ভালই মিষ্টি হয়। তবে এখন বড় একটা পাওয়া যায় না। হনুমানজি লঙ্কায় সীতামাইয়াকে খুঁজতে গিয়ে, অশোকবনের যে আমগাছটিতে উঠে আম খেয়ে খেয়ে, তার আঁটি ভারতবর্ষের দিকে ছুড়ে ছুড়ে ফেলেছিলেন, সেটা যে গোলাপখাসেরই গাছ ছিল তাতে বোধহয় আর কোনও সন্দেহ নেই। কেরলের গোলাপখাসের জন্য আমাদের ভবানীপুর বা গড়িয়াহাটের ফলের দোকানগুলোর ওপর ভরসা করতে হয়।
লালমণি আমেরা ওঠে গোলাপখাসের ঠিক পরেই। এই আমটি দেখতে অনেকটা হিমসাগরের মতো কিন্তু এর বোঁটার দিকে একটু লালচে ভাব থাকে। মহারাষ্ট্র আর উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা এই আমটিকে অনেকেই হিমসাগরের একটি ভাগ বলে মনে করেন। কিন্তু আসলে সেটা ঠিক নয়। লেকমার্কেটের দু-তিনটি ফলের দোকানে সবচেয়ে ভাল লালমণি পাওয়া যায়। এর পরে ক্রিজে নামে আমেদের ক্যাপ্টেন— হিমসাগর। হিমসাগরের সেরা জায়গা হল চন্দননগর আর শান্তিপুর। চন্দননগরের হিমসাগর সোনালি হলুদ। দুর্দান্ত মিষ্টি আর ভেতরটা যেন মাখনের মতো। ওখানকার বিশ্বনাথ চ্যাটার্জির বাগানের হিমসাগরের স্বাদ অনবদ্য। এটির চালু নাম চ্যাটাজ্জির আম। শান্তিপুরি হিমসাগর একটু ছোট সাইজের। মালদহ বা মুর্শিদাবাদের হিমসাগরও ভাল, তবে চন্দননগরের কাছে কেউ না। গড়িয়াহাট, লেকমার্কেট আর চিৎপুর বাজারে চন্দননগরের হিমসাগর খুঁজলে পাওয়া যায়। যদুবাজারের পুরনো ফলের দোকানগুলোতেও মাঝে মাঝে থাকে।
এই খাস আমটি চেনার আর একটি উপায় হল, এদের সঙ্গে দেখা হলেই এরা যেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ব্যারিটোনের কালজয়ী গান, ‘আয় খুকু আয়’-এর ঢঙে ‘আয় খোকা আয়’ গেয়ে আপনাকে দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকতে থাকবে। শুধু মুখেই বলুন বা চিঁড়ে, দই, মর্তমান কলা আর মাখাসন্দেশের সঙ্গে চটকে ফলারই বলুন, কিংবা ঘন দুধে এই আম মেখে, গরম হাতরুটি ডুবিয়ে দুধরুটিই বলুন— হিমসাগর এককথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এদের ছাড়িয়ে, ডুমোডুমো করে কেটে, ফ্রিজে ঠান্ডা হতে দেবেন। তারপর ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরে বার করে, ওপরে চিনি-ছাড়া ঘন ক্ষীর আলগোছে ছড়িয়ে, কাঁটায় করে তুলে তুলে গালে দেবেন। খেতে খেতে মনে হবে বুঝি পহেলগাঁওয়ের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া লিডার নদীর ঠান্ডা জলের ঝাপটা চোখে মুখে এসে লাগছে।
এদের ঠিক পরপরই বাজারে আসতে শুরু করে গুজরাত আর মহারাষ্ট্রের আলফানসো। যেহেতু আমগাছের জোড়কলম করার বিষয়টি আমরা পর্তুগিজদের কাছে শিখেই এহেন উপাদেয় আম তৈরি করতে পেরেছি, তাই অনুমান, পর্তুগিজ সেনানায়ক আলফানসো দ্য আলবুকার্ক-এর নাম থেকেই আমটির এমন নাম হয়েছে। মহারাষ্ট্রের দেবগড়ের আলফানসো খুবই বিখ্যাত। অনেকটা হিমসাগরের মতো দেখতে এই আমটি মুম্বইতে ‘হাপু’ নামেও পরিচিত। এই চোঁচবিহীন আমটি অত্যন্ত দামি আর বিদেশেও প্রচুর রফতানি হয়।
এর পর ভরা জ্যৈষ্ঠে বেনারস এবং বিহারের ভাগলপুর থেকে পাতলা খোসার ল্যাংড়া আম ঢুকতে শুরু করে। কথিত আছে, বেনারসের যে মূল আমগাছটি থেকে পরে সব গাছ তৈরি হয়েছে, তার মালিকের একটি পা নাকি ছোট ছিল। সেই থেকে আমটির নামও ল্যাংড়া হয়ে গিয়েছে। বেনারসি ল্যাংড়ার সুগন্ধ পাগল করে দেওয়ার মতো। তাই জামাইষষ্ঠীর কাজ করা কাচের থালায় এদের খুব কদর। যে সমস্ত বনেদি মিষ্টির দোকান ভাল ছানা দিয়ে দামি আমসন্দেশ করে থাকে, তারা কৃত্রিম গন্ধের বদলে আসল ল্যাংড়া আমের রসের সুগন্ধ ব্যবহার করেন। তবে সেক্ষেত্রে মিষ্টিটিকে একবেলার বেশি ফেলে রাখা যায় না। নষ্ট হওয়ার ভয়ে পেট ভর্তি থাকলেও ‘কী যে করি, কী যে করি’ ভাব করে গালে ফেলে দিতে হয়।
এই একই সময় সরিখাস নামের একটি আম ওঠে যাকে দেখতে অনেকটা লম্বাটে ল্যাংড়ার মতো। শুধু এদের বোঁটার কাছে খুব হালকা লালচে ছোপ থাকে। চন্দননগরেও সেরা সেরা সরিখাসের বাগান আছে। চন্দননগরের সরিখাসের ভেতরে কোনও রকম আঁশ হয় না। এই আমটির পরে উত্তরপ্রদেশেরই মালিহাবাদ থেকে বর্ষার শুরুতে আসতে শুরু করে অতি প্রাচীন প্রজাতির আম দশেরি। আর এর প্রায় গায়ে-গায়েই আসে চৌসা। শোনা যায়, শের শাহ সুরি নাকি শেষের আমটির এ হেন নামকরণ করেছিলেন। এই দুটি আমই মিষ্টি আর একটু লম্বাটে। এদের ঠিক মনের মতো পেতে গেলে অবশ্যই বড়বাজার এলাকায় ঘুরে বেড়াতে হবে। এদের ঠিক পরে কলকাতার বাজারে কর্নাটক থেকে আসা নীলাম্বরী নামের একটি আম ওঠে। এই আমটির গড়ন কেমন যেন মানুষের নাকের মতো বাঁকা। এর পর ভাদ্রমাসে মালদহ থেকে বড় বড় ফজলি আম আসতে শুরু করে। এই আমটি আমার নিজের তেমন প্রিয় না হলেও এটা মানতেই হবে যে মালদহ হল এমন একটি জায়গা যেখানে প্রায় সব ধরনের জাত আম ফলে থাকে। বেগমফুলি (আদতে অন্ধ্রের আম। হিমসাগরের মতোই দেখতে কিন্তু খোসাটি মোটা), রানিপসন্দ (ছোট্ট হিমসাগরের মতো কিন্তু খুবই মিষ্টি), তোতাপুরি (হালকা গোলাপি ছোপওয়ালা আর লম্বা লাটিমের মতো), কিসেনভোগ (গোলগাল ল্যাংড়া আমের মতো), মধুগুলগুলি (একদম ছোট্ট ছোট্ট, কিন্তু খুবই মিষ্টি) বা আম্রপালি (সংকর আম। ছোট্ট, মিষ্টি, অপূর্ব সুগন্ধ), এগুলি সব মালদহের ইংলিশবাজারে হইহই করে বিক্রি হয়।
তুলনায় শান্তিপুরে শুধু হিমসাগর আর ল্যাংড়া আর চন্দননগরে হিমসাগর আর সরিখাস ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কোনও আম পাওয়া যায় না। তবে ওই সব জায়গায় এই আমগুলি বেশির ভাগই গাছপাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, যার সঙ্গে কার্বাইডে পাকানো চালানি আমের কোনও তুলনাই চলে না। কলকাতায় যদুবাজার, গড়িয়াহাট বা চিৎপুর মার্কেটে ভরা-সিজনে এদের দ্যাখা পেলেও, গরুর টাটকা দোয়া দুধ আর প্যাকেটের গায়ে বড় করে ‘কাউ মিল্ক’ লিখে লিকুইড গুঁড়ো দুধ বিক্রি করলে, এই দুটির মধ্যে স্বাদের যে তফাৎ— সেটা কিন্তু এখানেও বরাবর বজায় থাকে।
ছবি: সুমন বল্লভ এবং স্বাতী চক্রবর্তী