৭ এপ্রিল, ১৯৬৬। খাদ্য আন্দোলন নিয়ে ময়দানে যুক্তফ্রন্টের মিটিং।
বাংলা একটা ক্রিয়াপদ, যা একই সঙ্গে বিশেষ্যও বটে, সেটা কি কারও জীবনের প্রধান সমস্যা হয়ে উঠতে পারে? পদটা হচ্ছে ‘খাওয়া’ ও তার আনুষঙ্গিক ‘খেতে’। ভেবে দেখেছি, পদদুটোর জটিলতাও নেহাত কম নয়। প্রথমত, কখন ক্রিয়া, কখন বিশেষ্য, এমনকী কখনই বা বিশেষণও, কখন সমাপিকা, কখন অসমাপিকা, তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই।
একেবারে মনে-থাকা-শুরু বয়স থেকে শুনে আসছি, ‘খেতে পারে না’, ‘খেতে শেখেনি’, ‘খাওয়া জানে না’, ‘খাওয়ায় মন নেই’, ইত্যাদি।
আর, সেই বয়স থেকেই কথাগুলোর মানে গুলিয়ে ফেলে নিজের অভ্যেস বদলে ফেলার চেষ্টা করেছি। যেমন, কখনও ভেবেছি, এগুলো বোধহয় পরিমাণগত নিন্দে। তখন, আমরা দুই বন্ধু নেমন্তন্নবাড়িতে রসগোল্লা খাওয়ার পর আবার শাকভাজা থেকে শুরু করতাম। আমরা দুজন দু’ব্যাচের খাওয়া এক আসনে খেয়ে উঠতাম। তাতে, যাঁরা নিমন্ত্রণ করতেন তাঁরা যে সব সময় খুশি হতেন তা নয়। একবার একসঙ্গে দেড় কেজি রসগোল্লা খেয়েছিলাম। কিন্তু এত খেয়েও নিন্দাবাক্যের কোনও শব্দ বদলাল না ‘খেতে পারে না’, ‘খেতে শেখেনি’, ‘খাওয়া জানে না’।
তখন ‘খেতে’ ও ‘খাওয়া’র বিশেষ্যপদগত মর্যাদার দিকে ঝঁুকলাম। দাদুর দু’পাশে দাদা আর আমি পিঁড়ির ওপর জোড়াসনে, মা পরিবেশন করতেন আর নইমা উঠোনে দাঁড়িয়ে আমাকে খাওয়া শেখাতেন। নইমার বুকের দুধ খেতাম কিন্তু ভাত খাওয়ার সময় নইমা ছুঁতে পারতেন না। উঠোনে দাঁড়িয়ে বলে বলে দিতেন, ‘আঙুলের আগা দিয়ে মাখো, গোড়ায় যেন এঁটো না লাগে’, ‘একবারে ভাত মেখো না, অল্প করে ভাঙো’, ‘সব ভাত খাওয়ার কী আছে, ভাত কি কম পড়েছে’, ‘বাড়ির বিড়াল-কুকুরের জন্য একমুঠো রেখো, অত চেঁছে খেতে হবে না।’
‘খেতে’ ও ‘খাওয়া’ এই দুই পদের বিশেষ্য অর্থের যোগ্য হতে, সেই শৈশবের শিক্ষা অনুযায়ী খাওয়ার তরিকা অনুযায়ী খেয়ে আত্মপরিচয়ের সংকট মেটাবার চেষ্টায় লাগলাম। কিন্তু তখন তো খাওয়ার হাতিয়ার বদলে গেছে অথচ নইমা, এমনকী, উঠোনেও দাঁড়িয়ে নেই। এক দিন কাঁটা চামচ দিয়ে মাংস বিঁধতে গিয়ে মাংসের টুকরোটা গল্ফ বলের মতো বহু দূরে এক জনের শরীরে গিয়ে লাগল। তিনি ভয় পেয়ে নিজের ডিশের দিকে চমকে তাকালেন। মুরগির ঠ্যাং কি মুরগির ভূতের ঠ্যাং হয়ে গেল?
সেই ঘটনার পর আমি খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ্য-ক্রিয়া সব ঝেড়ে ফেলে পুরো নৈরাজ্যবাদী হয়ে উঠলাম। যত বেড়েবুড়ে দেওয়া হোক, আমি সেই ভাতের মাথায় আঙুল দিয়ে ফুটো করে নিয়ে তাতে ডাল ঢেলে দিতাম ও বাকি সব কিছুকে সেই ডালভাতের আনুষঙ্গিক করে মুখে পুরতাম। যখন মনে হত খাওয়া হয়ে গেছে, খাওয়া শেষ করে দিতাম। যা খেতাম প্রায় তার সমপরিমাণ আহার্য পাতে পড়ে থাকত। আমি পূর্ণ ব্যক্তিত্ব সহ আমার সম্পর্কিত বিশেষণীয় বর্ণনায় ঢুকে গেলাম ‘খেতে জানে না’, ‘খাওয়া শেখেনি’, ‘খেতে পারে না’।
তখন আমার বছর তিরিশ বয়স, জলপাইগুড়ির কলেজে পড়াই, অহর্নিশ পার্টি করি, জলপাইগুড়ির গ্রামেগঞ্জে ঘুরি। গত শতকের ষাটের দশক। আচমকা যুক্তফ্রন্টের সরকার। আচমকা আমিও জেলার যুক্তফ্রন্টের এক নেতা। একেবারে আচমকা আমাকে কেউ যেন পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে ডুবজলে ফেলে দিল। একেবারে আচমকা আমাকে জানতে হল চালের দাম এত বেড়ে যেতে পারে যে মানুষজন কিনতে পারবে না। সে-মানুষজনের মধ্যে কোনও ফারাক নেই। গ্রামের মানুষও কিনতে পারছে না, শহরের মানুষও না। চালের কেজি-পিছু দাম প্রতি দিন বাড়ছে কেজিপ্রতি পাঁচ টাকা থেকে সাড়ে পাঁচ, সাড়ে পাঁচ থেকে ছয়, ছয় থেকে সাড়ে ছয়।
দুর্ভিক্ষ যে বইয়ের বাইরে কোথাও থাকে সেই প্রথম জানলাম। জ্ঞান এত কঠিন হতে পারে সেও সেই প্রথম জানলাম। ব্লক কমিটিতে ঠিক হল, লঙ্গরখানা খোলা হবে। কিন্তু ব্লকের অফিসাররা বললেন, তাঁরা চাল-ডাল-কড়াই-খুন্তিসহ ট্রাক নিয়ে যেতে পারবেন না, কারণ রাস্তায় ট্রাক লুট হবে।
নানা রকম পরামর্শ শুরু হল। রাত তিনটেয় যদি রওনা হওয়া যায় তা হলে ভোর হওয়ার আগেই মাইল দশ-বারো দূরের সবচেয়ে ক্ষুধাক্রান্ত অঞ্চলে পৌঁছনো যাবে। এমন ব্যবস্থারও নানা ফাঁক বেরোতে লাগল। সেই প্রথম জানলাম, ত্রাণ বললেই ত্রাণ দেওয়া যায় না। কেউ বললেন, রামকৃষ্ণ মিশনকে দায়িত্ব দিলে হয়, ওঁদের এ-বিষয়ে অভিজ্ঞতা আছে। কেউ বললেন, জলপাইগুড়ি মিশনের সেই সংগঠন নেই। যেখানে লঙ্গরখানা খোলা হবে সেটা আমার খুবই যাতায়াতের জায়গা। যে অঞ্চলগুলো দিয়ে ট্রাক নিয়ে যেতে হবে, সেখানেও আমার রাজনৈতিক পরিচয় আছে। আমি একটু কুণ্ঠিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি ট্রাক নিয়ে যাই? বলার সময় ভাবিইনি, এমন কথায় কোনও বিস্ময় ঘটতে পারে। অগত্যা সিদ্ধান্ত তাই হল।
পর দিন বেশ বেলা বেলা করেই আমরা যখন ট্রাক নিয়ে রওনা হব, তখন বিডিও অশ্বিনীবাবু বললেন, ‘আপনি আর না-ই গেলেন কষ্ট করে। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’ অর্থাত্ ব্লক অফিসের কর্মীরা চলে গেছেন, সব পার্টির নেতারা ওখানে লিস্ট বানিয়ে রেখেছেন, আজ রাতে স্কুলবাড়িতে থাকা হবে, কাল সকাল থেকে রান্না শুরু হবে। আমি বললাম, ‘যা-ই না! যাব বলেই তো এসেছি।’ আমি ট্রাকের সামনে ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসলাম।
বিকেল নাগাদ খারিজা বেরুবাড়ির স্কুলের মাঠে পৌঁছে গেলাম। স্কুল মানে বাঁশের বেড়ায় টিনের চাল। একটা খুব বড় বটগাছ ছিল আর সে রাতে আকাশ-ভরা জ্যোত্স্না ছিল। একটা ভয় ছিল। রাতে দল বেঁধে চাল লুট করতে পারে লঙ্গরখানার বাইরের জায়গার লোকজন। জ্যোত্স্না যেন ফেটে পড়ছিল কোনও বাঁধ ভেঙে। জ্যোত্স্নার অতটা জলছায়া-ফেলা পূর্ণতার সঙ্গে খিদের কোনও সম্বন্ধ তৈরি করা দূর কল্পনাতেও সম্ভব ছিল না। অথচ একটু খেয়াল রাখতে হচ্ছিল লুট ঠেকাতে নয়, কাল সকালে লঙ্গরটা সম্ভব করে তুলতে। এতগুলো অবাস্তব স্থির হয়ে ছিল জ্যোত্স্নার ভরা জোয়ার, ক্ষুধার্তদের খাদ্য লুটের সম্ভাবনা, সকালের লঙ্গর।
শেষ রাত থেকে দু’একটা ছায়ামূর্তি জ্যোত্স্নায় ভেসে আসতে দেখা গেল। তারা বটগাছের ছায়ায় মিশে গেল। কাল সকালের আহারার্থী। আমার পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছিল। সে-সব কথা আমার কিছু গল্প-উপন্যাসে লিখেছি।
পর দিন, খিচুড়ির তরল তপ্ত গন্ধে আর বাটি-থালা হাতে মানুষজনের লতানো লাইনে মাঠ ভরে গেল। বাচ্চারা, মেয়েরা, পুরুষরা তাদের সব পরিচয়, অনিষ্পন্ন খিদেয় ঘোঁট পাকিয়ে গিয়েছিল। এতটাই বাসি, পচা, দীর্ঘ খিদের নিরাময় মাত্র এক হাতা খিচুড়ির ঝোলে? আর, সেটুকুর জন্য এত আয়োজন?
আমার আশি বছরের জন্মদিনে পৌঁছতে মাঝখানে আর এক জন্মদিনের ওয়াস্তা। আমার বউমাদের, ভাগ্নেবউদের মুখে আমার খাওয়ার খুব তারিফ বাবাকে/মশায়কে/মামাকে, যা দেওয়া যায়, তা-ই যেন অমৃত হয়ে যায় খাওয়ার গুণে।
ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে? লিখুন এই ঠিকানায়:
হ্যালো 60s, রবিবাসরীয়,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১।
বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in