প্রথম বইটি আমার হাতেই রয়েছে এখন। প্রথম প্রকাশ ১৯৬৪। পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। চার বছরের গল্প একসঙ্গে করে বইটা করা হয়েছিল। প্রত্যেক গল্পের একটা করে ইতিহাস আছে। আমি যখন এম এ পরীক্ষা শেষ করেছি মাত্র, ঠিক করলাম, লেখালেখিকেই বৃত্তি হিসেবে গ্রহণ করব। কিন্তু লেখাকে জীবিকা করে নেওয়া তখন অসম্ভব ছিল, এখনও অসম্ভব। আমার লেখালিখির ক্ষেত্রে এটা হওয়ার সম্ভাবনা তো খুবই কম।
১৯৬০ সালে একটি গল্প লিখেছিলাম। যে কোনও কারণেই হোক, গল্পটি বেশ সমাদৃত হয়েছিল। গল্পটির নাম ‘শকুন’। সেই গল্পের প্রশংসা এখনও শুনি। আমার মাঝে মাঝে রাগ হয়, তার পরে কি আমি আর কিছুই লিখিনি?
বৃত্তি হিসেবে বেছে নিলাম শিক্ষকতা। তার একটাই কারণ, আমাকে কারও কথা শুনে চলতে হবে না। লেখক কারও অধীন নন। একমাত্র নিজের অধীনতা ছাড়া তিনি আর কারও কাছে মাথাটা বিক্রি করবেন না। প্রথম বইয়ে গল্প আছে দশটি। এই দশটি গল্প ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪-র মধ্যে লেখা। কোনওটা রাজশাহীতে বসে, কোনওটা সিরাজগঞ্জে, কোনওটা বা আমাদের ফুলতলার বাড়িতে বসে। এই গল্পগুলো লিখে আমি আনন্দ পেয়েছি। দু-একটি লিখে খুবই আনন্দ পেয়েছি।
গল্প তৈরি করে লিখে যাওয়া, সেটা আমার দ্বারা কখনওই হয় না। আমার কাজ অনেকটা কামার-কুমোরের মতো হাতেনাতে কাজ। অভিজ্ঞতার বাইরে আমি কিছুতেই যেতে পারি না। ওই বয়সেই অভিজ্ঞতা কম হয়নি। দেশভাগ, বঙ্গবিভাজন হয়ে গেছে। তার ছাপ আমার প্রথম বইয়ের গল্পগুলোর মধ্যে এসেছে। বেশির ভাগ গল্পেরই পটভূমি পশ্চিমবাংলা। কয়েকটা গল্প আছে, যেগুলিকে যে কোনও জায়গার গল্প বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়। গল্পগুলো বেরিয়েছিল নানান জায়গায়। কিছু বেরিয়েছিল ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায়, কিছু ‘পরিক্রম’ পত্রিকায়। মাসিক ‘পরিক্রম’ পাকিস্তান লেখক সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার মুখপত্র ছিল। আহমদ রফিক সরাসরি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া ‘দৈনিক পাকিস্তান’ নামে একটি দৈনিক কাগজে আমার বেশ ক’টি গল্প বেরিয়েছিল। এই কাগজে কবি আহসান হাবীব ছিলেন, তিনি আমার গল্প পছন্দ করতেন এবং বেশ ক’টি গল্প ছেপেছিলেন।
আমার প্রথম গল্প ‘শকুন’ লিখেছি রাজশাহীতে বসে। ‘তৃষ্ণা’ ও ‘উত্তরবসন্তে’ গল্পদুটি লিখেছি সিরাজগঞ্জে। বাকিগুলি খুলনায়। এই সব গল্প নিয়ে প্রথম বই ‘সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য’।
বই বার করার কথা আমি তেমন ভাবে তখনও ভাবিনি। ‘পরিক্রম’-এর সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এক দিন আমাকে বললেন, ‘আপনার গল্পগুলি একসাথে করুন। দেখি একটা বই বের করা যায় কি না।’ আমি চিন্তাও করতে পারিনি আমার একটা বই বেরোতে পারে। গল্পগুলো জোগাড় করলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপি কী করে তৈরি করতে হয় জানি না। গল্পগুলো আলাদা করে লিখিনি বা কপি করিনি। তখন কম্পোজ করে পাঠানো সম্ভব ছিল না। লেটার প্রেসে হাতের লেখা থেকেই গল্পগুলি বেরিয়েছিল। কোনও রকমে ছাপা গল্পগুলি একসঙ্গে করে পূর্ব পাকিস্তানের লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলামকে দিলাম। তিনি দিলেন এক জন প্রকাশককে। আমার খুব উত্তেজনা। ওই প্রকাশকের একটা বইয়ের দোকান ছিল নিউমার্কেটে। সেখানে প্রায়ই যেতাম। রকিব সাহেব বলে এক জন ভদ্রলোক ছিলেন প্রেসের মালিক। মুখে সরল একটি হাসি লেগেই থাকত। তিনি আমার হাতে প্রুফ ধরিয়ে দিতেন। দেখতাম, তখনও ভেজা। নিউজপ্রিন্টের ওপরে লেটার প্রেসে কম্পোজ করা, দু-চারটি লেটার ভেঙে গেছে। ‘ল’ ভেঙে গেছে ভাই, আপনার লেখায় ‘ল’ হবে না। ড্যাশের অসুবিধা, ‘ল’-এর অসুবিধা ইত্যাদি। ভেজা ভেজা কাগজ চেপে ধরে গ্যালিপ্রুফ করা হত। প্রুফ কী ভাবে দেখতে হয়, আমি তো জানি না তখন। উনি দেখিয়ে দিলেন। কোথায় নতুন শব্দ ঢোকাতে হবে, কোথায় ডিলিট করতে হবে, সব। আমি খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রুফ দেখতে লাগলাম। যেখানটায় থাকতাম, সেখান থেকে অনেকখানি হাঁটতে হত নিউমার্কেটে আসার জন্য। আজকের নিউমার্কেটের সঙ্গে সে কালের নিউমার্কেটের কিছুই মিল নেই। লোকজন নেই, জনবিরল একটা জায়গা। বইয়ের দোকানই ছিল বেশি। এই ভদ্রলোকের বইয়ের ছাপার জায়গা ছিল বাংলাবাজারে।
পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে আমি খুলনা চলে এসেছি। তখন অধ্যাপনা করি দৌলতপুর বি এল কলেজে। থাকি ন’মাইল দূরে ফুলতলা গ্রামে। এই ফুলতলাতেই আমাদের পরিবার বর্ধমান থেকে মাইগ্রেট করে বসবাস শুরু করেছিল। বাড়িটা খুব শান্তির। অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিল এই বাড়ি। তবু কী এক বিষণ্ণতায় ভুগতাম। ওই বিষণ্ণতাটা প্রথম বইয়ের অনেক গল্পেই আছে। ‘উত্তরবসন্তে’ সেই বিষণ্ণতা। বাংলাদেশ ভাগ হয়েছে। একটার নাম হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান, অন্যটি পশ্চিমবঙ্গ। কত মানুষ দেশত্যাগ করেছে! হিন্দু সম্প্রদায়ের কত মানুষ ইচ্ছায় বিনা-ইচ্ছায় দেশ ছেড়েছিল। এখনও কলকাতায় গেলে অনেকের কাছে শুনি, বাংলাদেশে তাঁদের বাড়ি ছিল, সুখসমৃদ্ধি সবই ছিল। লেখাপড়া করার জন্য যখন দৌলতপুর কলেজে আসি, আমার মনে আছে, তখন শিয়ালদহ স্টেশনে বহু মানুষের পিঠের বুকের ওপরে পা দিয়ে ট্রেন থেকে নেমেছি। তবে এ সব বিষয় আসে আমার দ্বিতীয় বইয়ে। প্রথম বইয়ের বেশ কয়েকটি গল্পের পটভূমি ছিল রাঢ়। যাই হোক, পাণ্ডুলিপি দেওয়ার পরে অপেক্ষার পালা। কখন বইটা বেরোবে। অধ্যাপনা করি, কলেজে যাই। মাঝে মাঝে ভাবি, কবে বেরোবে। এক দিন শরতের রোদ-ঝলমল বিকেলে বাড়িতে ঢুকতেই স্ত্রী বললেন, তোমার নামে একটা প্যাকেট এসেছে। মনে হল বইয়ের প্যাকেট। প্যাকেট খুলতেই দেখলাম আমার প্রথম বই, ‘সমুদ্রের স্বপ্ন, শীতের অরণ্য’। সেই মুহূর্তটা আমি ঠিক বর্ণনা করতে পারব না। বিখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন। মোটা রেখায় নারীর মুখ। পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৫৫। শেষ গল্পটির তলায় ১৯৬৪ সাল লেখা আছে। এই গল্পটি কোনও পত্রিকায় দেওয়া হয়নি।
এই আমার প্রকাশিত প্রথম বইয়ের কথা। দারুণ প্রশংসিত হয়েছিল বইটি। খুব প্রশংসা করেছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরী। তার পর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে লেখককে নতুন সাহিত্যের জগতে স্বাগত জানিয়েছিলেন।