গতকাল সরকারি আদেশে কলকাতার ফুটপাতে যত্রতত্র হেঁটে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছে। শুধু স্থানীয়রাই সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়ে এলাকার ফুটপাতে একটু একটু চলাফেরা করবেন। একটু দূরে যেতে হলেও, গাড়ি করে যেতে হবে, বেপাড়ায় হেঁটে হেঁটে যাওয়া চলবে না। তার কারণ, এত মানুষ সর্ব ক্ষণ যাতায়াত করলে, হকারভাইদের ব্যবসায় খুব ব্যাঘাত ঘটে। গতকালই আবার ‘অপারেশন সানশাইন’-এর ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২৪ নভেম্বর’কে হকারদের কালা দিবস হিসেবে পালনের ইচ্ছাকে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। ওই দিন শুধু ফুটপাতই নয়, যে কোনও ছোট-বড় রাস্তার ধারেও হকাররা বসতে পারবেন। একই সুবিধা তাঁরা পাবেন প্রি-পূজা এবং চৈত্র সেলে। সরকার জানিয়েছে, নতুন ব্যবস্থায় ‘ফুটপাত’ কথাটা অর্থহীন, তাই নাম বদলে ‘হকিং-জোন’ রাখা হতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে যাঁরা ফুটপাতে সংসার পেতে আছেন, তাঁরা আপত্তি করবেন ভেবে সরকার দ্বিধাগ্রস্ত। ফুটপাতের এই নিষেধাজ্ঞা সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। হকারদের অবশ্য দাবি, সময়টা সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত করা হোক। কারণ, দোকান গুছিয়ে বসতে ও গুটিয়ে তুলতেও তো অনেকটা সময় যায়। তবে এই খুচখাচ আপত্তির কথা বাদ দিলে, সামগ্রিক ভাবে হকাররা খুব খুশি। একই সঙ্গে তাঁরা জানিয়েছেন, কোনও পথচারী মাল কেনার ছুতোয় হেঁটে চলে যেতে পারেন— সেটাকে আটকানোর জন্য চেকিং বা টিকিটের ব্যবস্থা হোক। হকারদের কাছ থেকে মাল কিনলেই ওই টিকিটের দাম বাদ যাবে। এ দিকে খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাতিবাগান, গড়িয়াহাট, ক্যানিং স্ট্রিট সহ শহরের সমস্ত হকাররা উৎসবে মেতে ওঠেন। তাঁরা আনন্দে ক্রেতাদের ছাড়ও দিয়েছেন। তবে, ডালহৌসি-শিয়ালদহর নিত্য পথযাত্রীরা তাঁদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে বউবাজার মোড়ে রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করেন। পুলিশ আসার আগেই স্থানীয় হকাররা তাঁদের হটিয়ে দেন।
রতনকুমার দত্ত, রবীন্দ্রপল্লি, বাঘাযতীন
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা: টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
ভোরে আকাশবাণীতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া শুনছি, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা বরাবর অজানা মানুষের চিৎকার: ‘বাঁধ ভেঙেছে! জল, জল! পালাও! পালাও!’
১৯৭৮-এর এক ভোরে প্রায় সারা বাংলা জুড়ে জলপ্লাবন ঘটেছিল। এত বড় জলস্থিতি বা বন্যা এর আগে কখনও দেখিনি। প্রথমে বম্বে রোড বরাবর বেশ কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় জলপ্লাবন ঘটে। আরও পরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় অবিভক্ত মেদিনীপুরের বেশির ভাগ অংশই বন্যার কবলে পড়ে যায়।
আমাদের দোতলা বাড়ি, মাটির। পাশের জেঠুর আর পাড়ার সবার একতলা মাটির বাড়ি। বন্যার একটা পূর্বাভাস আগে থেকেই গ্রামবাসীর জানা ছিল। তাই মহালয়ার ভোরে জল আসার আগেই গ্রাম আর পাড়ার বেশির ভাগ মানুষ উঁচু জায়গার সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে পালায়। আমরা ভোরবেলায় আমাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বটু থানার তিনতলা পাকাবাড়িতে যখন গিয়ে পৌঁছলাম, সিঁড়িতে পা ফেলার জায়গা নেই। ধান আর চালের বস্তায় সমস্ত জায়গা দখল হয়ে গেছে। কোনও রকমে পাশ কাটিয়ে দোতলায় উঠলাম বটে, কিন্তু সুস্থ ভাবে বসার এতটুকু জায়গা নেই। ঠাকুমার সঙ্গে আমি আর আমার ভাইবোনেরা গিয়েছিলাম। বেলা বাড়ার পর বাবা আমাদের কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমা কাতর স্বরে বললেন, আমাকে ঘরে নিয়ে চল, মরতে হয় তো ওখানেই মরব, এখানে এক মুহূর্ত থাকতে পারব না। অগত্যা বাবা আমাদের নিয়ে রাস্তার জল ঠেলে আবার আমাদের বাড়ির কাছে নিয়ে এল। গোটা গ্রাম আর পাড়া তখন উজাড়। আমাদের মাটির বাড়ির সামনে বেশ উঁচু একটা ‘পতা’ ছিল জানা-দের। আমরা এ বার সেখানেই উঠলাম।
বেলা আরও বাড়তে বাবা আমাদের রেখে গ্রামের প্রাইমারি স্কুল, আর যাদের পাকাবাড়ি আছে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখল, কোত্থাও তিলধারণের জায়গা নেই। স্থির হল, আমরা দু’কিলোমিটার দূরের উঁচু বাঁধে যাব (তখনও এন এইচ ফর্টি ওয়ান সম্পূর্ণ হয়নি)। এমন সময় গ্রামেরই হরিপদ সামন্তর ছেলে বাবাকে দেখে বলল, মাস্টারমশাই, এখনও কোথাও যাননি? চলুন আমাদের বাড়ি।
’৭৮-এর বন্যার খণ্ডচিত্র। বাংলার ২০০০০ বর্গকিলোমিটার জায়গা
ডুবে ছিল জলের তলায়। প্রিয়জনকে আঁকড়ে ডাঙা খোঁজার অভিযান তখন সর্বত্র।
হরিপদ সামন্তের তমলুকে পানের বিশাল ব্যবসা। ইটভাটাও আছে। বড়লোক বলতে যা বোঝায় ঠিক তা-ই। গ্রামের রাস্তায় চার চাকার গাড়ি মানে ওদের অ্যামবাসাডর। বাবা না করল না। আমরা দফায় দফায় ডোঙায় চেপে বন্যার জল পেরিয়ে সামন্তদের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাড়ির অনেক আসবাব, বিশেষত পেতলের জিনিস, বিছানাপত্র আর কিছু ধান-চাল-মুড়ি নিয়ে আসা হল। বিকেলের দিকে বাবা আবার আমাদের গরু, আর পড়শিদের ফেলে যাওয়া গরুকে এনে সেই উঁচু ‘পতা’য় রাখার ব্যবস্থা করল। আমাদের খড়ের গাদা ভেঙে শুকনো খড়গুলো পতায় রেখে ওদের মাথায় একটা ছাউনিও করে দিল।
পুরুষমানুষরা সকাল থেকেই ডোঙা আর কলার ভেলায় চেপে নানান দিকে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে যেত। কিন্তু এক রকম শূন্য হাতেই বিকেলের দিকে ফিরে আসত। আমরা যারা কচিকাঁচা ছিলাম, ওই সময় ভেলায় করে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে দেখতাম, জলের তোড়ে কত মরা কুকুর, গরু, ছাগল, এমনকী শেয়ালও ভেসে যাচ্ছে। নোংরা জলে মানুষের পায়খানা, কত গাছগাছালি, সব ভাসছে। গ্রামের অধিকাংশ কাঁচা বাড়িই বন্যায় পড়ে যায়। আমরা খুব কাছ থেকে হেলিকপ্টার দেখেছি, চেঁচিয়ে সমস্বরে আর্তনাদ করেছি। কিন্তু কোনও ত্রাণ, সাহায্য পাইনি।
বন্যার ক’দিন বড়রা খুব আতঙ্কিত আর বিষাদগ্রস্ত ছিলেন। আমরা ছোটরা অবশ্য তখন সেটা বুঝিনি। আমরা বেশ মজাতেই ছিলাম। বেশ একটা পিকনিক পিকনিক মেজাজ। কয়েকটা পাড়ার সমস্ত মানুষ এক বাড়িতেই ছিলাম। প্রতি দিন সকালে প্রত্যেক বাড়ির সদস্যসংখ্যা অনুযায়ী বাটিতে চাল মেপে একত্রিত করে রান্না হত। সঙ্গে ডাল আর আলুভাতে। আর যে দিন কাঁচা বিচিকলা পাওয়া যেত, সে দিন বিচিকলা-ভাতে। এখন ভাবতে বসে মনে হয়, সে সব তো ‘খাবার’ পদবাচ্য কিছু ছিল না, কিন্তু ওই জিনিসই পাশাপাশি একসঙ্গে বসে খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা।
দু’দিন কোনও রকমে কাটার পর বড় রাস্তায় এক কোমরেরও ওপর জল দাঁড়িয়ে গেল। তার ওপর সন্ধেয় প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে মানুষ আর গৃহপালিত গরুকুকুরবেড়াল সবাই নাস্তানাবুদ। রাতে ভাল ঘুম হত না। নিশুতি রাতে ঝপাস ঝপাস শব্দ হত, আর সবাই বলত, ওই, ভৌমিকদের বাড়ি পড়ে গেল। ও ভাবেই কেটেছে কয়েকটা রাত। আর সকাল হলে কোনও রকমে জল পেরিয়ে বাবা গিয়ে দেখত, আমাদের বাড়িটা আগের মতোই দাঁড়িয়ে কি না, এখনও।
দিন দশেক কাটল এ ভাবেই। তার পর এক দিন জলটা নামতে থাকল, আস্তে আস্তে। আমরা ফিরে এলাম আমাদের বাড়িতে। দেখি, সাংঘাতিক অবস্থা। চারদিকে নোংরা জল, পচা গন্ধ। বরজের পান, খেতের ফসল, পুকুরের মাছ, কিচ্ছু নেই। শ্মশান যেন। হাহাকারে ভরা। মানুষের সেই হতদরিদ্র অবস্থা ভাষায় বর্ণনা করাও শক্ত। সেই সময় কোনও লঙ্গরখানা ছিল না। জল নেমে যাওয়ার পর যেটুকু ত্রাণ এসেছিল, তার বিলিবণ্টন নিয়ে আবার আর এক নাটক।
আর একটা জিনিস কিছুতেই ভোলার নয়। আমাদের বাড়িতে প্রতি পূর্ণিমায় ঘটা করে নারায়ণপুজো হত। ঠাকুরটি গোটা চাঁদি রুপোর তৈরি। এত বড় বাড়ি যদি সত্যি পড়ে যায়, তা হলে ঠাকুরটিকে আর না-ও পাওয়া যেতে পারে, সেই আশঙ্কায় বাবা প্রতি দিন এসে ঠাকুরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাটির বাড়ির দোতলায় ওঠার চেষ্টা করতেন। অদ্ভুত কাণ্ড, ঠাকুরকে নিয়ে যেতে হাত বাড়ালেই চারদিক থেকে টিকটিকির দল জুটে টিক টিক শব্দে বাবাকে দিশেহারা করে তুলত। দিন পাঁচেকের চেষ্টার পরও যখন একই কাণ্ড, বাবা হাল ছেড়ে দেন। আর আমাদের বলে দেন, ঠাকুর যখন এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছেন না, তখন এ বাড়ি দাঁড়িয়ে থাকবেই। আজ ২০১৪, ঠাকুমা, বড়দা, মেজো জেঠু নেই। কিন্তু প্রতি পূর্ণিমায় আজও নারায়ণপুজো হয়। সেই বাড়িতেই।
প্রশান্তশেখর ভৌমিক, রামতারকহাট, পূর্ব মেদিনীপুর
সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in