পিনাকী ভট্টাচার্য
দুপুরে প্রথম শীতের মিঠে রোদ পিঠে মেখে কয়লাঘাটের ফুটপাতের পাশে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে গোলমরিচ-ছড়ানো মাখন টোস্টে কামড় দেওয়ার সময় আমরা অনেকেই ভুলে যাই যে এই কয়লাঘাট আসলে কেল্লাঘাট— এইখানেই ছিল কলকাতার প্রথম কেল্লা, আর এই কেল্লা যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈরি করেছিল, সেই কোম্পানির গোড়াপত্তনের পিছনে এই টোস্টে ছড়ানো গোলমরিচ।
রানি প্রথম এলিজাবেথের আমলে শীতকালে ইংল্যান্ডের সাহেবদের খাবার বলতে ছিল শীত আসার আগে থেকে নুন মাখিয়ে রেখে দেওয়া মাংস আর শুঁটকি মাছ। আর তা খেতে হত কোনও মশলা ছাড়া— কারণ মশলা ছিল দুষ্প্রাপ্য আর দুর্মূল্য। আমাদের দেশের ওড়িশার দক্ষিণ-পশ্চিমের বা ছত্তীসগঢ়ের দক্ষিণ-পূর্বের জেলাগুলোতেও কয়েক রকমের নুন আর লংকা পাওয়া যায় ক্ষুন্নিবৃত্তিতে সাহায্য করতে, কিন্তু সেই ইংল্যান্ডে তা-ও পাওয়া যেত না। ওই দুর্গন্ধওয়ালা খাবার গলাধঃকরণ এক বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাহেবদের কাছে— বেঁচে থাকার তাগিদে দমবন্ধ করে সাহেবরা তা-ই খেয়েছে বছরের পর বছর। কিছু দিন পর্তুগিজদের কাছ থেকে মশলা কিনেছিল কিন্তু মওকা বুঝে তারা মশলার দাম বাড়িয়ে দেয়। ওলন্দাজদের কাছে মশলা কিনতে গিয়ে আরও ফ্যাচাং— ১৫৯৯ সালে তারা ইংল্যান্ডে গোলমরিচ বিক্রি করল পাউন্ড প্রতি তিন শিলিং দামে, আর ক’মাসের মধ্যেই তা বাড়িয়ে করে দিল আট শিলিং! অগত্যা আশি জন সাহেব বসলেন শলাপরামর্শ করতে, আর জন্ম হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির। ১৬০১ সালে ওঁরাও জাহাজ ভাসালেন ভারতের দিকে, আড়াই বছর পর ফেরত এলেন দশ লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ নিয়ে! আর লাভের অংশ? ১৬২০ সালে আড়াই লক্ষ পাউন্ড গোলমরিচ কিনেছিলেন পাউন্ড প্রতি আড়াই পেনি দরে। বিক্রি করেছেন এক শিলিং আট পেনি দরে! এক বার মনে করিয়ে দিই এখানে ১২ পেনি=১ শিলিং আর ২০ শিলিং=১ পাউন্ড ছিল সেই জমানার হিসেব। অর্থাৎ পরিষ্কার আট গুণ বেশি দামে! তার পরের ইতিহাস আর মনে করিয়ে দিতে হবে না কাউকেই।
পর্তুগিজরা আর ওলন্দাজরা যতই জাহাজ ভর্তি করে গোলমরিচ ভারত বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বীপগুলো থেকে ভাস্কো দা গামা’র আবিষ্কৃত পথ দিয়ে ইউরোপে পাঠাক আর টাকা কামাক, ইউরোপে গোলমরিচ তার অনেক আগেই পৌঁছে গেছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে রোমানরা তাদের সমস্ত আমদানিকে ৮৬ পাতায় লিপিবদ্ধ করেছিল— যার মধ্যে গোলমরিচও ছিল। কিন্ত মূলত ওষুধ বানাতে ব্যবহার করা সে দিনের সেই গোলমরিচ ছিল সাংঘাতিক দামি— এক সময় ইউরোপে ১২ আউন্স গোলমরিচের দাম ছিল ৫০ পাউন্ড। গথরা যখন ষষ্ঠ শতাব্দীতে রোম নগরী ঘিরে ফেলে, শান্তিস্থাপনের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়ার মধ্যে ছিল তিন হাজার পাউন্ড ভারতীয় গোলমরিচ!
শুধু ইউরোপে নয়, চিন দেশেও কিন্তু গোলমরিচ পাওয়া যায় ভাস্কো দা গামা’র ভারতীয় গোলমরিচের দর্শন আর ডাকাতির বহু দিন আগে থেকেই। মার্কো পোলোর লেখায় পাওয়া যায় কুবলাই খান তাঁর কিন্সে শহরের জন্য দৈনিক ৯৫৮৯ পাউন্ড গোলমরিচ জোগান দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। আর তৃতীয় শতাব্দীর চিনা পুঁথিতে ‘হুজিজাও’ বলে গোলমরিচের উল্লেখ করা হয়েছে— যার মানে বিদেশি মরিচ।
একটা খবর না দিলে গোলমরিচের গপ্প অসম্পূর্ণ থাকবে— ১২১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মমি হওয়া মিশরীয় সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিস-এর নাকে গোলমরিচ গোঁজা ছিল— মানে সেই জমানাতেও গোলমরিচ ছিল— মানে ভারত সেই সময়েই মিশর পৌঁছে গিয়েছিল! গোলমরিচের জন্মস্থান তো দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূল!
pinakee.bhattacharya@gmail.com
স্বপ্নময় চক্রবর্তী
সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এক বার আমাকে বলেছিলেন, লোকাল ট্রেনে বসে খবরকাগজ-বইপত্র পড়বি না। কান খাড়া করে মানুষের কথা শুনবি। যতটা পারি উপদেশ মেনেছি, মণিমাণিক্যও পেয়েছি। বেশ কিছু দিন বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করতে হয়েছিল। এক চাটনিবিক্রেতা দু’চারটে মজার কথা বলে, তার পর চাটনির প্যাকেট বার করতেন। ওঁর চাটনির নাম ছিল, ‘সুখময় চাটনি’। এক বার চাটনির প্যাকেটগুলো বের করে বললেন, স্ত্রী-পরস্ত্রী সই পাতাবে, বউ-শাশুড়িতে ভাব হবে, দুই জা মিলে ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা যাবে— নিয়ে যান বাড়িতে, শুধু উপহার দিন। মেয়েকে মোবাইল ফোন কিনে দিতে পারছেন না? মেয়ের অভিমান? মান ভাঙাতে সুখময় চাটনি।
ঝুটো গয়না, ঝুঁটি চুল আর ঝিলিক শাড়ি পরা কয়েক জন মহিলা বসেছিলেন। হকারটি বললেন, ম্যাডামগণ, বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন, নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে এই সুখময় চাটনি উপহার দিয়ে ওদের জীবনে ছড়িয়ে দিন টক-ঝাল-মিষ্টি সুখময় গুঁড়ো। এক জন বয়সিনি বলে ফেললেন, যাঃ, তাই আবার হয় না কি? হকারটি বললেন, কেন হয় না? পুরোহিত দর্পণ, বা ভারতের সংবিধান— কোথাও তো লেখা নেই বিয়েতে চাটনির প্যাকেট উপহার দেওয়া চলে না।
রসিক হকারটির সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। বললেন— বাবা নাম রেখেছিলেন দুখী। কিন্তু এই নাম আমি মানতে পারিনি। দুনিয়ায় কী রগড়! রগড় চিপে আনন্দ বার করে নিতে হয়। মারপিট, চুরি, দু’নম্বরি যেমন আছে, ভালও আছে। এই তো চালউলি সন্ধ্যা ট্রেনে পড়ে থাকা একটা বাচ্চাকে ঘরে নিয়ে গেল। এটুকু বুঝেছি দাদা, জীবনের গায়ে একটু আনন্দের চাটমশলা ছড়িয়ে নিতে হয়। বিতাং করে বলতে পারব নাকো, পড়ালেখা তো করিনি বেশি, তবে দাদা, ছেলেটাকে পড়ালেখা করাচ্ছি, আর ছেলেটার নাম রেখেছি সুখময়। ছেলেটার নামেই এই চাটনির গুঁড়ো। বিটনুন-আমচুর-গোলমরিচ-মৌরি-আমলকী-যষ্টিমধু-তালমিছরি...
দুখী এক দিন বললেন— আজ একটা সুখের খবর দেব। আমার ছেলেটা ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ দিয়েছে। এই সুখের দিনে সুখময় চাটনি ফ্রি, তবে, প্যাকেটগুলি ছোট। আমার সুখে আপনারাও ছোট করে ভাগ বসান।
তার পর হঠাৎ করেই ওই হকারটিকে ট্রেনের কামরায় দেখতে পেতাম না। বনগাঁ লোকালে নিয়মিত যাতায়াতের প্রয়োজনটাও ফুরোল। তবে মাঝেমধ্যে তো উঠতেই হয়। সে দিন কানে এল— কেউ কথা রাখেনি...তেত্রিশ বছর কাটল...কেউ কথা রাখেনি...মহাশয়গণ, এটা তেত্রিশ নয়, চৌত্রিশ করে নিন। এখন চৌত্রিশ বছরটাই বাজারে খাচ্ছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে ওটাকে চৌত্রিশ করে দেবার জন্য ওঁর উপর চাপ আসত। মহাশয়গণ, কেউ কথা না রাখলেও আমি কথা রেখেছি। প্রতি রবিবারের মতোই আপনাদের শরীরে ও মনে একটু রসের জোগান দিতে আমি এসে গেছি...
ছেলেটাকে দেখি। কম বয়স, চোখে চশমা, বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। কাঁধে ব্যাগ। কী বেচবে ও? ছেলেটা বলছে— জীবনে কী পাব না, কী হবে সে ভাবনা? সামনে যা পাচ্ছেন সেটা নিয়ে নিন। আমার কাছে আজ যেটা পাচ্ছেন, আগামী রোববারের আগে পাবেন না। এক প্যাকেট হাসি নিয়ে যান। আনন্দ করুন। দুঃখ-গ্লানি হেসে উড়িয়ে দিন। আপনি যদি বাঙালি হিন্দু হন, ছেলের নাম দিন শ্রী হাসিনাথ। মুসলমান হলে: হাসব বলে আসলাম কিংবা হেসে খানখান। এক চিনা সুখী লোকের নাম হল কচি হাসি চুংমুং। জাপানি সুখী লোকের নাম: কাকা হাসে কাকি হাসে। শ্রীলঙ্কার? মুখ তুলে হাসি তুঙ্গে। নেপালি— হাসুন বাহাদুর। নাইজেরিয়া থেকে এখন ফুটবল খেলোয়াড় আসে। নাইজেরিয়ার লাফিং ক্লাবের সভাপতির নাম কী জানেন? ওমা ওমা হাসিলো। এক সুখী রাশিয়ানের নাম শুনবেন?— হাসবো না বলিস কী! কোরিয়ান হাসিখুশি লোকের নাম: চোখ বুজে সে কী হাসি! কেনিয়ার সুখী লোকের নাম: মুচুকি হাসিবো।
ট্রেন জুড়ে তখন হাসির হিল্লোল। চোখের তলায় কালি-পড়া প্রৌঢ়টির দিকে লতপত শার্টের হাতা ঝোলা হাত-কাটা মানুষ হাসি ছুড়ে দিচ্ছে, গলায় লোহার চাবি বাঁধা কাছা পরা সদ্য পিতৃহীন ছেলেটিও হাসছে। আমার পাশে বসা সহযাত্রীটি আমায় বললেন, আগের এক রোববার এই ছেলেটির মুখে শুনেছেন— কলকাতার কোন ট্রাফিক সিগনালে কোন রবীন্দ্রসংগীত উপযুক্ত। যেমন ধাপার মাঠে ‘মধুগন্ধে-ভরা’, কিংবা হাওয়া অফিসের সামনে ‘যা হবার তা হবে’।
ছেলেটি বলল, মাননীয়গণ, এই খুশির প্রদীপে ইন্ধন দরকার, তাই না? যেমন গাড়ির ডিজেল, ধূপের ধুনো। সেই সুখের গুঁড়োর নাম হল— সুখময় চাটনি। সামান্য আলুসিদ্ধতে সুখবৃষ্টির মতো ছড়িয়ে দিন, কিংবা মুড়িতে, দেখবেন আনন্দ কী ভাবে ধরা দেয়। এতে আছে বিটনুন, আমচুর, গোলমরিচ...
আমি তক্ষুনি কিনলাম, এবং বললাম: সাত-আট বছর আগে এক জন হকার ছিল, নাম তার দুখী, সেও... কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটি বলল, বাবা ক্যান্সারে। মায়ের টাকা সারদায়। টেট পাশ করে চাকরি হয়নি। টিউশনি, রোববারে হকারি। আমিই সুখময়। আনন্দ আর হাসি নিয়ে যা বলি— সব বানানো।
swapnoc@rediffmail.com
ওরে ওঠ, হাইবারনেশনে পড়ে থাকলে নেশনটা জাগবে কী করে?
—রামতাড়ু