রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

-

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

ক্রিস্টোফার কলম্বাস নাকি তাঁর আবিষ্কৃত ‘ভারতবর্ষ’-এ (ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে) দ্বিতীয় সফরের সময়ে আখ হাতে হাজির হয়েছিলেন। আর সেই ইক্ষু-বংশ ছড়িয়ে পড়ে জামাইকা, কিউবা সহ বিভিন্ন দ্বীপে, আর সেইখান থেকে পৌঁছে যায় সুদূর আমেরিকার মেক্সিকো, ব্রাজিল আর ভেনেজুয়েলাতে। গোলার্ধের ওই অংশে সব দেশ, বিশেষ করে ওলন্দাজরা আখ থেকে চিনি তৈরিতে মেতে ওঠে। সে যুগে চিনি বানানোর কৌশল ছিল সাদামাটা— আখের রস জ্বাল দিয়ে প্রথমে গুড় বানানো হত, আর তা থেকে চিনি। সেই গুড়ের কিছুটা যেত ক্রীতদাস আর পোষা জীবজন্তুর পেটে, আর বাকিটা ফেলে দেওয়া হত। সপ্তদশ শতাব্দীতে, যখন ক্রমে চিনির উৎপাদন বাড়তে লাগল, এই গুড় এক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল। দুই পাউন্ড চিনি বানানো হলে এক পাউন্ড গুড় নির্যাস হিসেবে পড়ে থাকে— আর এই গুড়ের কোনও উপযোগিতাও জানা ছিল না— সমুদ্রে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না— অতএব লাভের গুড় পিঁপড়ে আর সমুদ্র খেতে লাগল। অবশেষে এই সমস্যার সমাধান করলেন ফরাসি ধর্মযাজক পেয়ার লাবাত্। তিনি লক্ষ করেছিলেন, এই গুড় খোলা আকাশের তলায় কয়েক দিন রাখলে গুড় পচে এক মদ তৈরি হয়— কিন্তু তা খেয়ে নেশা করার দুঃসাহস ক্রীতদাসরাই একমাত্র করত অভাবের তাড়নায়। লাবাত্ সাহেব এই গুড়-পচা মদকে পরিশোধন করে এক পানীয় তৈরি করলেন। নাম দেওয়া হল ‘রাম’। আর খুব কম দিনের মধ্যেই রাম এমন জনপ্রিয় হয়ে গেল আমেরিকার ভূখণ্ডে যে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তার কলোনিগুলোর বসবাসকারীরা বয়স নির্বিশেষে গড়ে বছরে ১৪ লিটার রাম খেত! আর বার্বাডোজে তৈরি রাম এতটাই বিখ্যাত হল, ১৭৮৯ সালে জর্জ ওয়াশিংটন তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের জন্য এক ব্যারেল বার্বাডোজ-রাম আনিয়েছিলেন।

‘রাম’ নামটা ঠিক কোথা থেকে এসেছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় পানীয় রাম্‌বুজল-য়ের সঙ্গে রাম নামের যতই মিল থাকুক— বাস্তবে কোনও ভাই-বেরাদরি নেই। কারণ রাম্‌বুজল তৈরি হত ডিম, ওয়াইন, চিনি আর বিভিন্ন মশলা মিশিয়ে; তাতে গুড়ের কোনও ভূমিকাই নেই। বরং চিনির ল্যাটিন ‘স্যাকারাম’ আর ‘থেরাম’— যার মানে ‘পুনর্বার’, ফরাসি শব্দ ‘আরোম’— যার অর্থ গন্ধ, আর ওলন্দাজ নাবিকদের ব্যবহার করা মস্ত সাইজের গেলাস ‘রামার্‌’-এর ভূমিকা আছে।

Advertisement

চিনি বা শর্করা থেকে মদ তৈরি সেই আদ্যিকাল থেকে চলে এসেছে ভারতবর্ষে ও চিনে। মালয় দেশের ‘ব্রুম’্‌ হাজার হাজার বছর আগে তৈরি, যা কিনা আখের রস থেকে বানানো হত। মার্কো পোলো তাঁর চতুর্দশ শতাব্দীর ভ্রমণবৃত্তান্তে লিখেছেন, ইরানে তাঁকে ‘চিনি থেকে উৎপন্ন এক অতি উৎকৃষ্ট মদ্য’ পরিবেশন করা হয়েছিল। রাম-এর জনপ্রিয়তার এক প্রধান কারণ, ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে রামকে বিভিন্ন অসুখের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা। আর শিল্পবিপ্লবের ফলে যখন চিনির উৎপাদন অনেক বেড়ে গেল, তখন যে গুড় গতকাল অবধি ছিল আবর্জনা, সেই গুড়ই রাম তৈরিতে ব্যবহার হয়ে, চিনি-কারখানার মালিকদের মুনাফা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। আর তৈরি হয়ে গেল এমন এক পানীয়, যা অন্যান্য কুলীন পানীয়দের চেয়ে অনেক কম দামে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

দুর্গাপুজোর ক’দিন আগে একটা হলুদ পোস্টকার্ড বাড়িতে আসত। উপরে লেখা ‘শ্রীশ্রী দুর্গায়ৈ নমঃ’, আর লাল কালিতে লেখা থাকত, ‘কল্যাণীয়া কমলা, প্রতিবারের ন্যায় এইবারও বাড়ির মাতৃপূজায় পূর্বাহ্নে উপস্থিত হইয়া আবশ্যক কার্যাদি করিয়া...।’ কমলা আমার ঠাকুরমা। ওঁর দাদার বাড়ি— মানে আমার বাবার মামার বাড়িতে, পুজো হত। বাবার মামাকে ইলেকট্রিক দাদু ডাকতাম, কারণ ওই দাদুর একটা টিকি ছিল, ধরতে গেলে বলতেন— ধইরো না, ইলেকটিরিক কারেন্ট আছে। ঠাকুরমার সঙ্গে আমিও কয়েক বার গিয়েছি, পুজোবাড়িতে থেকেছি।

পুজোবাড়িতে ঢাকের শব্দ শুরু হবার আগে থেকেই পুজোর আবহ শব্দ ছিল ভ্যাঁ-ভ্যা।ঁ কয়েকটা কালো পাঁঠা আগেই হাজির থাকত কিনা, যাদের বলি হবে। আর ছিল উলুধ্বনি। নানা অছিলায় উলুধ্বনি। নারকোল কোরানো শুরু হবে— জোকার দাও, সন্দেশের ছাঁচ গঙ্গাজলে ধোয়া হচ্ছে— জোকার দাও, নাড়ুর পাক শুরু হল— জোকার দাও, প্রতিমার চোখ আঁকা হবে— জোকার দাও।

ওখানে দিদিমা-পিসিমা-জেঠিমা-কাকিমা’রাই জোকার দিতেন, সেই জোকারের দলে এক জন পুরুষমানুষকেও দেখতাম। তাঁকে মনাকাকু বলে ডাকতাম। লম্বা বারান্দায় দিদিমা-জেঠিমা-কাকিমারা যখন নারকোল কোরাতেন, তাঁদের মাঝখানে বসে মনাকাকুও শুদ্ধ বসনে নারকোল কোরাতেন। তিনিও মহিলাদের সঙ্গেই সকালে স্নান করে নিতেন, ধুতিই পরতেন এবং গেঞ্জি, ধুতির খুঁটটা অনেকটা আঁচলের মতোই গায়ে জড়াতেন। মেয়েলি গল্পের মধ্যেও থাকতেন, মাঝেমাঝে জিভ বের করে বলতেন, ‘অ্যা-মা-লাজ!’ আঁচলে মুখটাও ঢাকতেন কখনও, লজ্জা পেয়ে। ভাল নাম ছিল সম্ভবত মনোরঞ্জন। মনা বলেই ডাকত সবাই, মেয়েদের কেউ কেউ ‘মনা’র মাঝখানে একটা আলতো ‘য়’ জুড়ে দিত বলে ‘ময়না’র মতো শোনাত। মনাকাকু খুশিই হতেন।

যখন নাড়ু পাকানো হত, কিংবা ছাঁচে ফেলে তিল বা নারকোলের সন্দেশ বানানো হত, তখন বারান্দার বাইরে কাক, আর ভিতরে মানবশিশুদের লাইন দিয়ে বসে থাকা। নাড়ু বাঁধতে গিয়ে একটু গুড়-নারকোলের মশলা মেঝেতে পড়ে গেলে, ওটা দিয়ে পুজোর সন্দেশ হবে না বলে সামনে ছুড়ে দেওয়া হত। আমরা কুড়িয়ে নিতাম, দূরে ছুড়ে দিলে কাকেরা। মনাকাকু খুব ভাল ছিলেন, ওঁর হাত থেকে অনেক মশলা খসে পড়ত। আমার দিকেই বেশি ছুড়তেন। আমি এক দিন ছাগলছানাদের তরকারির খোসা খাওয়াচ্ছিলাম, মনাকাকু আমাকে কোলে নিলেন। কানে ফিসফিস করে বললেন, আমারে ক’: ও ময়নাকাকি, লজেন কিনার পয়সা দিবা? আমি ওঁর শেখানো কথা বললাম, তখন গেঞ্জির ভিতর থেকে একটা ছোট বটুয়া বের করে একটা সিকি হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন— সোনা পোলা। তার পর বটুয়াটা গেঞ্জির ফাঁকে গুঁজে রাখলেন, গেঞ্জিটা যেন ব্লাউজ।

বলির সময় কাঁসর ঘণ্টা বাজত, ঢাক বাজত, মনাকাকুও এসে দাঁড়াতেন, কিন্তু চোখের সামনে ধুতির কাপড় ঘোমটার মতো ফেলা। হাড়িকাঠের রক্ত অনেকেই কপালে ছোঁয়াত। মনাকাকুও। কাকে যেন মনাকাকু বলেছিলেন, সিন্দুরের মতো লাগে না? মনাকাকু ভোগের তরকারিও কুটতেন। কিন্তু বলির পাঁঠার যেখানে ছাল ছাড়ানো হত এবং মাংস কোটা হত, ও দিকে যেতে দেখিনি। অথচ রক্তের ফোঁটা দিতেন কপালে। বলতেন সিন্দুর সিন্দুর!

দশমীর দিন সকালে বরণ হত। ডালায় ফুল মিষ্টি নিয়ে প্রতিমার সামনে দাঁড়াত মহিলারা। মনাকাকুও হাতে ডালা নিয়ে ওখানে। দিদিমারা কেউ কেউ নিষেধ করেছিলেন, বলেছিলেন তরিতরকারি কোটা সহ্য করা যায়, কিন্তু এ সব চলবে না। এটা শুধু মেয়েদের পার্বণ। মনাকাকুকে কাঁদতে দেখেছিলাম। সিঁদুর খেলার সময় ঠিক ওদের মাঝখানে আবার হাজির। কেউ মনাকাকুর মাথায়-গালে সিঁদুর মাখায়নি। নিজেই এক খাবলা সিঁদুর মুখে মেখে দুর্গাঠাকুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলতে গেলেন। জানি না কী বলেছিলেন, দিদিমা জেঠিমারা ওঁকে টেনে বার করে দিলেন, ইলেকট্রিক দাদু এসে বললেন, এক চোবাড়ে দাঁত ফালাইয়া দিমু। সামনের বছর তুই আর আইবি না মনা।

পরের বছরও গিয়েছিলাম। মনাকাকুকেও দেখেছিলাম। কিন্তু দাদুর আদেশে মনাকাকু নারকোল নাড়ুর টিমে মেয়েদের সঙ্গে থাকতে পারেননি। মনাকাকু মনমরা হয়ে এক কোণে চুপচাপ, চোখে জল। আমার এক কমবয়সি কাকিমা মনাকাকুকে বলেছিলেন, মনা ঠাকুরপো, দুঃখ কোরো না, অশুচি হলে আমরাও তো ঠাকুরের কাজ করতে পারি না।

অশুচি হওয়ার মানে তখন বুঝতাম না, তবে এটা দেখতাম কখনও কখনও কাকিমা-বউদিরা দূরে দূরে থাকে। রান্নাঘরেও যায় না। পুজোবাড়িতেও অনেক মহিলা, তাদের কেউ কেউ এ রকম অশুচি হত।

বাড়ির পিছনে কচুগাছ-কলাগাছের ফাঁকে কিছু কাপড়ের টুকরো শুকোতে দেওয়া হত। পাখি বা গিরগিটি দেখতে ও দিকে গেলে বড়রা বলত ও দিকে যাবি না। নোংরা।

বোধনের আগের দিন মেয়েদের মধ্যে ফিসফাস। অশুচি কাপড়গুলো নেই। মনাকে এ ধারে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। দাদুর কানেও যায়। দাদু মনাকাকুকে একটা ঘরে নিয়ে যান। মনাকাকুর অন্তর্বাসের ভিতরে নাকি ওই সব কাপড় গোঁজা ছিল।

দাদু সত্যি সত্যি থাপ্পড় মেরেছিলেন। মনাকাকু কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন— আমি কী করুম, আমি তো এখন ছত্তি।

পূর্ববাংলার কোনও কোনও অঞ্চলের এটি একটি গোপন মেয়েলি শব্দ।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement