রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০০:০৩
Share:

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

আদা আদতে গরম মশলার তুতো ভাই। এলাচ-লবঙ্গ-দারচিনির সঙ্গে এক ধরনের আত্মীয়তা আছে আদার। এর ইউরোপ যাত্রা শুরু হয়েছিল দু’হাজার বছর ধরে আরব বণিকদের জাহাজে। কিন্তু তারও দু’হাজার বছর আগে আদার উল্লেখ পাওয়া যায় এক্কেবারে প্রথম যুগের চিনে চিকিৎসা-শাস্ত্রের পুঁথি ‘নং কাও জিং’-এ। যিশুর জন্মের ৫০০ বছর আগে চিনের মহাপণ্ডিত কনফুসিয়াস ঘোষণা করেছিলেন, আদা বিনা খাবারে ওঁর রুচি নেই।

ভারতে লেখা আয়ুর্বেদিক গ্রন্থ ‘চরক সংহিতা’ আর ‘সুশ্রুত সংহিতা’তে আদার ব্যবহারের উল্লেখ আছে। আর আরব বণিকরা আদা নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই, ৭৭ খ্রিস্টাব্দে, গ্রিসের দিওস্করদেস তাঁর অমর ‘মেতেরিয়া মেদিকা’তে আদার গুণগান করেছিলেন। রোমে সৈনিকদের দৈনিক খাবারের অঙ্গ ছিল আদা, তার ব্যথা কমানোর আর হজমশক্তি বাড়ানোর সুনামের জন্য। কিন্তু রোমের পতনের পর আদা ইউরোপের রান্নাঘর থেকে প্রায় হারিয়েই গিয়েছিল।

Advertisement

আদার গপ্প আবার দেখতে পাওয়া যায় প্রায় হাজার বছর বাদে, ১১২৮ সালে, যখন ফ্রান্সের মার্সেই বন্দর আর তার কিছু দিন বাদে প্যারিস ১২৯৬ সালে আদা আমদানির ওপর কর ঘোষণা করে। আদা নিয়ে বিশদ লেখা দেখতে পাওয়া যায় তার কিছু দিন বাদে, দক্ষিণ ওয়েলস-এর প্রিন্সের আদেশে সেই সময়ের নামী চিকিৎসক রিওয়ালঅ-র লেখা ‘ফিজিশিয়ান্স অফ মাইডভাই’তে।

চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে আদা আবার স্বমহিমায় হেঁশেলে বিরাজমান— রান্নায় ব্যবহৃত মশলা আর অনুপানের মধ্যে আদার স্থান ঠিক গোলমরিচের পরেই। এমনকী রানি প্রথম এলিজাবেথও আদার স্বাদের ভক্ত হয়ে ওঠেন— এতটাই যে, কেউ কেউ বলেন আজকের ক্রিসমাসের জনপ্রিয় জিঞ্জার ব্রেড প্রথম তাঁর বেকারিতেই তৈরি হয়! এশিয়াতেও আদার ব্যবহার সমান জনপ্রিয় ছিল রান্নাঘরে— মার্কো পোলোর ভ্রমণকাহিনি তার সাক্ষী।

কিন্তু আদা ব্যবহার হত মূলত ধনীদের খাবারে। এক শিলিং সাত পেন্স-এ যেখানে একটা ভেড়া পাওয়া যেত, এক পাউন্ড আদারও ছিল একই দাম। ইউরোপে মধ্যবিত্তের সাধ্যের বাইরে ছিল আদার ব্যবহার। সেই কারণে ভাস্কো ডা গামা আর সমসাময়িক অভিযাত্রীরা পুব দেশ থেকে আদার চাষের খুঁটিনাটি দস্তুরমত লিখে নিয়ে যেতেন দেশে আদার চাষ করার জন্য। কিন্তু বিধি বাম, ইউরোপের মাটির তাতে ছিল ঘোর অনীহা।

স্প্যানিশরা ছিল ব্যবসার ব্যাপারে দড়। তারা ইউরোপে আদার চাষ না করে, বেছে নিল সেই সব জায়গা, যার প্রকৃতি আর মাটির সঙ্গে ভারতের প্রকৃতি আর মাটির মিল আছে। তারা চাষ শুরু করল ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোয়, যার অনেকগুলো ইতিমধ্যেই তারা জয় করেছে। ১৫৮৫ (মতান্তরে ১৫৪৭) সালে এই নতুন দুনিয়ার সান্তা দমিনিগো থেকে প্রথম আদার জাহাজ ইউরোপে পাড়ি দিল। আর ক্রমে আদার চাষ ছড়িয়ে পড়ল মেক্সিকো, ব্রাজিল আর সেখান থেকে আফ্রিকায়।

আদা কেন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল এত কম দিনের মধ্যে? তার কারণ আদার উপযোগিতা রান্নার স্বাদ বাড়ানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ভেষজ হিসেবেও আদা অনন্য। আর একটা কারণ বোধহয় সেই গুণ— যেটার কথা ভেবে ইতালির ঐতিহ্যশালী সালের্নো মেডিকাল স্কুল ঘোষণা করেছিলো— আদা খেলে আদর পাবেন, আর আদর করবেন জীবনভর যৌবন ধরে রেখে।

pinakee.bhattacharya@gmail.com

একসঙ্গে ঢুকি, কিন্তু আমি ‘লেট’

প্রায় পনেরো বছর ওয়েস্ট বেঙ্গল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনে কাজ করেছি। প্রথম দিকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, পরে মেনটেন্যান্স ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে। যে দিন প্রথম ইন্টারভিউ দিতে গেলাম, আমাকে নিয়ে চল্লিশ জন চাকরিপ্রার্থী। পদ একটি মাত্র। হবে না, নিশ্চিত ছিলাম। কারণ আমার না ছিল মামা, না দাদা। তবু হল, বাড়িতে নিয়োগপত্র এল।

ভয়ে ভয়েই হাজির হলাম। চেয়ারম্যান নলেন গুড়ের সন্দেশে কামড় দিয়ে বললেন, বাবা, কনফার্মেশন কিন্তু বম্বেতে ট্রেনিংয়ের পর। ভয়ে ভয়েই ঘাড় নাড়লাম, যদিও নিয়োগপত্রে ট্রেনিংয়ের কথা কিছুই লেখা ছিল না। অফিসে সবাই ওঁকে ‘বাবা’ বলেই ডাকত।

এক এসি-প্ল্যান্ট অপারেটরের সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়েছিল। ও ছিল খ্রিস্টান, বড়দিনের সময় দারুণ দারুণ সব কেক বিস্কুট আসত তার বাড়ি থেকে। ওর বানানো, স্ক্রু-র মতো দেখতে বিস্কুট আমার ছেলের খুব প্রিয় ছিল। আমি ওকে একটু ফেভারই করতাম, তবে সেটা কেক বিস্কুটের জন্য নয়, ব্যবহারের জন্য। দুর্জনে অবশ্য আড়ালে ওকে বলত, দাসবাবু তো তোর বাপ।

বম্বেতে গিয়েছিলাম মাসখানেকের জন্য। কিন্তু ট্রেনিংয়ের কোনও ব্যবস্থাই সেখানে ছিল না। তাতেই চেয়ারম্যান খুশি। নলেন গুড়ের সন্দেশে কামড় দিয়ে কনফার্মেশন হয়ে গেল।

ইউনিয়ন নেতা অফিসের বাইরে প্লাইউডের ব্যবসা করত। কিন্তু অঙ্কে মাথামোটা ছিল, ব্যবসায় আরও বেশি খদ্দের ধরার জন্য ১০% দাম বাড়িয়ে ১০% ডিসকাউন্ট দিল। তাতে লোকসান বাড়ল, কিন্তু ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকল না। অঙ্ক কষে বহু গলদঘর্ম হয়ে তাকে বোঝাতে হয়েছিল। এর পর থেকে সে আমার টেবিল চাপড়ে কথা বলত না। তবে পিন মারতেও ছাড়ত না। এক বার তার পিন মারায় তিতিবিরক্ত হয়ে অ্যাশট্রে ছুড়ে মেরেছিলাম। টিপ খুব খারাপ ছিল, লাগেনি।

অফিসে আমার স্কেল ছিল ১১০০-১৩০০। অনেক পুরনো সরকারি স্কেল, বেশ সিনিয়র এবং লুক্রেটিভ স্কেল। অনেক কম বয়সে এই স্কেল পেয়ে যাওয়ায় আমার চেয়ে পুরনো যে-সব পক্বকেশ অফিসার এই স্কেলে ছিলেন, আমি অচিরেই তাঁদের চক্ষুশূল হলাম।

অফিসে একটা এসি এলাকা ছিল, অফিসাররা সব সেখানেই বসতেন। আমার সেখানে বসার জায়গা হল না। নন-এসি এলাকায় আমার জন্য একটা ঘর তৈরি হল। আমার কাজ ছিল কিছু সফিসটিকেটেড যন্ত্রপাতি দেখভাল করা, যেগুলো এসি এলাকার বাইরে আনার কথা নয়। আমার বস আমার ঘরে একটা উইন্ডো এসি বসাবার প্রস্তাব দিলেন, কিন্তু তাতেও বাধা। আমার স্কেলে নাকি উইন্ডো এসি পাওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমি তখন যন্ত্রপাতিগুলো নন-এসি এলাকায় এনে রিপেয়ার করা শুরু করলাম। তাতে যন্ত্রপাতির সমস্যা বাড়ল। শেষমেশ এসি এলাকাতেই আমার ঘর বরাদ্দ হল যন্ত্রপাতির দৌলতে।

একটা গাড়িতে আমি আর কোম্পানি সেক্রেটারি একসঙ্গে অফিসে যেতাম। কোম্পানি সেক্রেটারির নানান এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির জন্য রোজই আমাদের দেরি হত পৌঁছতে। অ্যাটেনডেন্সের জন্য পাঞ্চ কার্ড সিস্টেম চালু হওয়ার এক মাস পর দেখা গেল, আমরা একসঙ্গে এলেও, সেক্রেটারি প্রতি দিনই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌঁছেছেন, আর আমি প্রতি দিনই লেট। তখন নিয়ম ছিল, তিন দিন লেট হলে একটা সি.এল কাটা। আমি নিয়মমাফিক দশটা সি.এল-এর দরখাস্ত দিয়ে দিলাম। পরে জানা গেল, কোম্পানি সেক্রেটারির কার্ড পাঞ্চ করে দিত তারই চাপরাশি। আমার দশটা সি.এল-এর দরখাস্তটা এর পর কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

অফিসের সমস্ত স্টেশনারি প্রিন্টিং-এর অর্ডার বরাবর এক জন ভদ্রলোকই পেতেন। অর্ডার নেওয়ার সময় তাঁর মিসেস নাকি এক বার করে আসতেন খুব সাজগোজ করে, তাঁর সঙ্গে অ্যাকাউন্টস অফিসারের ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট লম্বা মিটিং হত ঘরের দরজা বন্ধ করে।

অফিসের ডব্লুবিসিএস ম্যানেজিং ডিরেক্টর বদল হতেন দু’তিন বছর অন্তর। তাঁরা মনে করতেন, টেকনিকাল লোকেরা সব সময়ই তাঁদের বোকা বানাচ্ছে। এক বার এক ম্যানেজিং ডিরেক্টর এলেন যিনি স্বঘোষিত টেকনিকাল এক্সপার্ট, কারণ তিনি নাকি গ্রামে প্রচুর হ্যাজাক-ট্যাজাক সারিয়েছেন!

অফিসে নিয়ম ছিল, কোনও মেশিনের কোনও পার্ট খারাপ হলে একটা ভাল পার্ট স্টোর থেকে নিয়ে খারাপটা তৎক্ষণাৎ ফেরত দিতে হবে। অথচ ওই খারাপ পার্টের ছোট্ট একটা অংশ পরে কাজে লেগে যেতে পারত। এই রকম ছোট ছোট অংশগুলো যেখানে জমিয়ে রাখা হয়, তাকে বলে জাংক বক্স। এক দিন ওই রকমই একটা ছোট্ট অংশের জন্য মেশিনটা বন্ধ হয়ে গেল। ম্যানেজিং ডিরেক্টরকে বললাম, আমাদের যদি একটা জাংক বক্স থাকত তা হলে সমস্যাটা সহজেই মিটে যেত। ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঙ্গে সঙ্গে পারচেজ ম্যানেজারকে বললেন, ওকে এখুনি একটা জি.এম বক্স এনে দিন, ওটা লাগিয়ে দিলেই মেশিনটা চালু হয়ে যায়!

এক দিন রাতে মেশিনের একটা সূক্ষ্ম স্ক্রুর প্যাঁচ নষ্ট হয়ে গেল। ম্যানেজিং ডিরেক্টর নিজেও খুব চিন্তিত, নানা রকমের সলিউশন বাতলাতে লাগলেন— আচ্ছা, মেয়েদের কানের দুলের যে বুঁজি, সেটা এখানে লাগালে হয় না! এক বার নিজের প্যান্টের পকেটের ভেতর দিক থেকে খানিকটা সুতো টেনে বের করে বললেন, টেরিকটের পাতলা সুতো, খুব শক্ত, স্ক্রুর প্যাঁচে পেঁচিয়ে দিলে নিশ্চয়ই কাজ চলে যাবে!

এক বার ঠিক হল, একটা পুরনো মেশিন কেনা হবে। আমাকে বম্বে পাঠানো হল ইন্সপেকশনে। বিক্রেতা ১৫ লাখে বেচতে রাজি হল। দামটা বেশ কম, কারণ মেশিনটা ভাল অবস্থায় থাকলেও সেটা বেশ পুরনো, আর তার স্পেয়ার পার্টস পাওয়াও সমস্যা। কম দাম দেখে ফাইলটা চাপা পড়ে গেল। এর বছর দুয়েক পর অ্যাকাউন্টস অফিসার গেলেন ওই একই মেশিন ইন্সপেকশনে। কোটেশন এল ৩৫ লাখ টাকা। তৎকালীন ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং চেয়ারম্যান ‘বাবা’ খুব খুশি হলেন। অবশ্য শেষ অবধি মেশিনটা কেনা যায়নি।

বিশ্বজিৎ দাস, যাদব ঘোষ রোড, সরশুনা

dasbiswajit@hotmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement