কলেজ লাইফ মানে শুধু কলেজ-কেন্দ্রিক লাইফ নয়। সেটা আসলে মাতমাত যৌবনের সময়। যখন সদ্য A-মার্কা সিনেমা দেখার ছাড়পত্র পেলেও কপালের ট্যারাব্যাঁকা লাইনের জন্য হয় তেমন A-মার্কা সিনেমা আসে না নয়তো A-মার্কা সিনেমায় ঢোকার মতো কলজের জোর জড়ো করা যায় না। গল্পটা অবশ্য সিনেমার নয়, এই সময়টার।
আমার মা এক দিন অর্ডার হাঁকলেন, আমায় নাকি বাবার কোনও এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার শ্রাদ্ধে যেতে হবে। দুপুরবেলায় দাদার সঙ্গে গজগজ এবং আরও এক লক্ষ গজগজ সহ চললাম। মেট্রো স্টেশনে হাঁটছি, তখনও আমার রাগ কমার চিহ্নমাত্র নেই। দাদাকে বলেই চলেছি, কেন যে বড়রা কিছুই বোঝে না! আর মা’র ওপর রাগটা ঝাড়তে না পেরে দাদাকেই দুষছি, ‘তুই কেন ভাল ছেলের মতো রাজি হয়ে গেলি বল তো? তোর জন্যই আমার কথা কেউ শোনে না। আর তোর মতলব হচ্ছে, এমন করে আমাকে সারা ক্ষণ হ্যাটা করা, যাতে আমার কোনও আপত্তি কেউ না শোনে। আমি বাড়ির ছোট বলে, তোদের ইচ্ছেমত ছড়ি ঘোরাস। তুই বা দিদি কেউ এক জনও ‘না’ বললে, আমাকেও এই ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুর যেতে হত না। আসলে তোরা আমার আনন্দ একদম সহ্য করতে পারিস না। তুই মনে হয় মা’কে লাগিয়েছিস যে আজ আমার বন্ধুদের সঙ্গে বেরনোর কথা ছিল।’
এতটা ডায়ালগ দিয়ে দম নেওয়ার জন্যে একটু দাঁড়িয়েছি, কেমন খটকা লাগল। দাদা হঠাৎ বিনা বাক্যব্যয়ে আমার কথা শুনে যাচ্ছে? কোনও উত্তর দিচ্ছে না, বকছে না? আমি যে কী সাংঘাতিক আড়বোঝা ও অসহ্য ছিঁচকাঁদুনে সে বিষয়ে একটা প্রেসিও আবৃত্তি করছে না? ব্যাপারখানা কী? শেষে কি দাদাও বড়দের দলে গিয়ে আমায় ঝগড়া-অযোগ্য ভেবেছে? পাশে তাকিয়েই, এক গাল মাছি! এ কী, এ কে!
এ তো একটা অচেনা লোক! দাদারই বয়সি এক জন ছেলে, দাদার মতই গড়নখানা। আমি তার পাশে পাশে মেট্রো স্টেশনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে চলেছি! শুধু হাঁটছি নয়, তাকেই টার্গেট করে জোরসে, ঝাঁঝিয়ে গজগজ করছি! আমার তখন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থা। সরি বলব? হনহনিয়ে উলটো দিকে চলে যাব? রেগে উঠব? আপনি কেন মশাই আমায় কিছু বলেননি! আর দাদাটা? কী দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলে রে বাবা। বোনটা কার সঙ্গে হেঁটে চলে গেল এক বার দেখলও না? আর আমিই বা কী উজবুক। এত হ্যাবলার মতো পথ চললে হয়?
কোনও মতে শুকনো গলায় বললাম, ‘সরি। আসলে আমি না একদম খেয়াল করিনি। ভেবেছি আমার দাদা হাঁটছে পাশে। ইস, কী করে যে এ রকম ভুল হল!’ বলে ইতস্তত করছি। একটি দুটি অন্য লোকজনও দেখছি হাঁ করে আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার তখন মনে হচ্ছে দেবতা-রাক্ষস-মানুষ সবাই আমার বিরুদ্ধেই চক্রান্ত করছে। এক সেকেন্ড আগের আমার এত ত্যান্ডাইম্যান্ডাই— সব নিতান্তই ফুস!
ছোকরাও তেমনি। কেতা-র বাবা। এ অবস্থায় অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই বলত, ‘না না ঠিক আছে, এ রকম ভুল হতেই পারে।’ কিন্তু সে তো আলট্রা-স্মার্ট। তাড়াতাড়ি সে উপদেশের মোড-এ চলে গেল। গড়গড়িয়ে বলে গেল, ‘আমি এত ক্ষণ ধরে অবজার্ভ করছিলাম আপনাকে। এত কম বয়সে এত রেগে যান কেন? খুব রাগ হলে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেবেন। বাই, হ্যাঁ?’