ছবি: সুব্রত চৌধুরী
আমরা যখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন দেশ জুড়ে সরকার-বিরোধী আন্দোলন বেশ জোরালো ভাবে হত। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ স্লোগানে গলা মেলাতে বেশ লাগত। স্বাধীনতার পর পর কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা সাধারণ মানুষ ভাল চোখে দেখেনি। ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দিয়েও ব্রিটিশরা কংগ্রেসের বড় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছিলেন, যা সাধারণ মানুষ খারাপ চোখে দেখেছিল। কংগ্রেসের শান্তিপূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলনে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজরা স্বাধীনতা দান করে গিয়েছিল বলে অনেকে ব্যঙ্গ করতেন। আসলে তখন সেই সময়টা এসেছিল, যখন ইংরেজরা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছিলেন না। ভুললে চলবে না, কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি বিপ্লবীদের আন্দোলনও মানুষের শ্রদ্ধা আদায় করেছিল। ক্ষুদিরাম, চট্টগ্রামের আন্দোলন, বিভিন্ন আন্দোলনে নিহত বা শহিদ হয়েছেন এমন অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীর দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও দেশের আশি ভাগ মানুষ স্বাধীনতা পাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হননি। উলটে ছোটবেলায় শুনেছি, অনেক প্রবীণ বলতেন, ব্রিটিশ আমল অনেক ভাল ছিল। পঞ্চাশ সালের পর থেকেই স্লোগান ছড়িয়ে পড়ল, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। ইংরেজরা বাধ্য হয়ে কংগ্রেসকে স্বাধীনতা দান করে গেছে।
দেশ স্বাধীন হল, কিন্তু ব্রিটিশরা থেকে গেল কর্তাদের আচরণে, অভ্যেসে। মনে আছে, সকরিগলি-মনিহারিতে নদী পার হতে হত স্টিমারে চেপে। তার দোতলায় দিশি-বিদেশি সাহেবরা বসার অধিকার পেতেন। ধুতি পরা ভারতীয়দের বসতে দেওয়া হত না স্বাধীনতার নয় বছর পরেও। তাদের জন্যে ব্যবস্থা ছিল এক তলায় ভিড়ের মধ্যে।
আমরা বড় হয়েছি সেই সময়ে, যখন ভারত সবে স্বাধীন হয়েছিল। সাতচল্লিশ সালের পনেরোই আগস্ট এবং তার পরের স্বাধীনতা দিবসগুলোয় খুব প্রভাতফেরি হত, এটুকু মনে আছে। বাকি দিনগুলোয় উত্তর-বাংলার ভারত কতটা স্বাধীন ছিল তা বুঝিনি। ভাবিওনি। স্কুলেও বোঝানো হয়নি। খাদ্য আন্দোলনে যখন বেশ কিছু মানুষ যোগ দিলেন, পুলিশ তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে সেটা থামাতে চাইল, তখন একটা কথা বলে আমাদের উত্তেজিত করা হত। এই পুলিশদের ব্রিটিশরা চাকরি দিয়েছে, ব্রিটিশরা চলে গেলেও এরা স্বভাব বদলায়নি, তাই মারো ব্যাটাদের। স্লোগান উঠল, পুলিশ তুমি যতই মারো, মাইনে তোমার একশো বারো।
ভারত-চিন যুদ্ধ দেশের মানুষের মনে স্বদেশপ্রেমের মলম লাগিয়েছিল। বিধানচন্দ্র রায় মারা গেলেন, সাদাসাপটা মানুষ প্রফুল্লচন্দ্র সেনকে অশ্রদ্ধা করেনি বাঙালি। কিন্তু তাঁকে তির্যক বাক্যবাণ সহ্য করতে হয়েছিল। এবং এর মধ্যে চিনের কল্যাণে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হল। আমরা শুনেছিলাম এক ভাগ রাশিয়ার অনুসারী, অন্য ভাগ চিনের। পরে ব্যাপারটাকে খুব হাস্যকর মনে হয়েছে। ভারতবর্ষের মানুষ মাও জে দং বা লেনিনের মতাদর্শে কতটা বিশ্বাসী ছিলেন তা তাঁরাই জানতেন না। ফলে দেখা গেল, মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী সিপিআই-তে থেকে গেলেন, লড়াকু ক্যাডাররা সিপিএম-এ। সে সময় জ্যোতিবাবু কোন দলে যাবেন তা নিয়েও জোর জল্পনা ছিল। তিনি যে দূরদর্শী ছিলেন তা পরবর্তী কালের ইতিহাস প্রমাণ করেছে।
সাতচল্লিশের স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বলে মেনে নিতে পারেনি ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি রাজ্যের মানুষ। কিন্তু এই মেনে নিতে না পারার জন্যে যে সংগঠিত শক্তির দরকার তা তৈরি হয়নি। খাদ্য আন্দোলন, বাসভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ট্রাম পোড়ানোর মধ্যেই শক্তি প্রদর্শন সীমিত ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির মার্ক্সবাদী শাখা নাকি চিনের সমর্থক, সেই চিন যে ভারত আক্রমণ করেছে। প্রচার হল, পরবর্তী কালে এদের হাত ধরেই চিন চলে আসবে কলকাতায়। তখন কংগ্রেস আমল। চলছে তীব্র অস্থিরতা। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে অনভিজ্ঞ এ দেশের মানুষ দেখল, কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদী থেকে বেরিয়ে এসে কিছু ছেলে স্লোগান দিচ্ছে, চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। স্লোগানটা দ্রুত ছড়িয়ে গেল মুখে মুখে। রেড বুকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রছাত্রী। সাতচল্লিশের আগে রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা আনতে চেয়েছিল যারা, তাদের সমর্থন করেনি কোনও রাজনৈতিক দল। এই স্বাধীনতাকে নীরক্ত স্বাধীনতা বলে প্রচার চলছিল আটচল্লিশ সাল থেকে।
১৯৬০ সালে আমি যখন স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র, এক সহপাঠী খাতা এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘দেখ তো, এটা কবিতা হয়েছে কি না!’
জলপাইগুড়ি থেকে কলকাতায় সদ্য আসা সেই দুই লাইনের কবিতায় যে নামগুলো পড়েছিলাম তারা একেবারেই আমার কাছে অজানা ছিল। ‘আঁধার সাগর পার হয়ে যাও ক্ষুদিরামের ভাই, আলোক দেখায় বন্ধু স্তালিন, চিনের চৌএন লাই।’ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মানে কী? উত্তর দেয়নি শৈবাল, শৈবাল মিত্র। শুধু হেসেছিল।
এই লাইন দুটোতে যে বিশ্বাস ছিল তা যেমন সে সময় বোধগম্য হয়নি, তেমনি কানু সান্যাল মশাইরা যখন সত্যিকারের স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিলেন, তখনও আমি বুঝতে পারিনি। তখন কংগ্রেস রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রায় অসহায়, সিপিআই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, সিপিএম চিৎকার চেঁচামেচি করলেও নিজেদের ওপর ভরসা হারিয়ে অজয় মুখোপাধ্যায়ের বাংলা কংগ্রেস-এর পেছনে মুখ লুকোতে চাইছে। আর কী আশ্চর্য, মহাত্মা গাঁধী, বিধানচন্দ্র রায়ের কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে গেল। কিন্তু জয়টা এত কম সময়ের জন্যে যে অনেকের পক্ষে মনে রাখা মুশকিল হল।
কিন্তু কংগ্রেসকে হারানো যায়, এটা জানার পর নকশাল আন্দোলন জোরদার হল। কিন্তু গোটা ভারতবর্ষের আশি ভাগ অংশের মানুষ আন্দোলনটা বোঝেনি, যোগও দেয়নি। পশ্চিমবঙ্গ বা অন্ধ্রের মানুষদের অনেকেই ভেবেছিল, চিন এসে তাদের উদ্ধার করবে। আর যাঁরা সত্যি বিপ্লব চেয়েছিলেন তাঁরা চারপাশে বিশ্বাসঘাতকতা দেখলেন। যে পুলিশ ব্রিটিশ আমলে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের নির্দয় ভাবে খুন করতে পারেননি, তাঁরা সেই আক্ষেপ মিটিয়ে নিলেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশাল ছাত্রছাত্রীদের ওপর তুমুল অত্যাচার করে। তখন রোজই যুদ্ধ চলছে পেটোর সঙ্গে রাইফেলের গুলির। তখন মানুষ সকালে অফিস করছে, সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরছে। যার সামর্থ্য আছে সে বাবার টাকায় বিদেশে পালাচ্ছে। ’৭০/৭১-এ প্রচুর নকশালপন্থী ছেলে বিদেশে চলে গেছে, যাদের অনেকেই দেশে ফিরতে লজ্জা পেয়েছে।
অনভিজ্ঞতা, সামরিক ট্রেনিং না থাকা এবং আধুনিক অস্ত্রের অভাব সাতষট্টি থেকে একাত্তরের আন্দোলনকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। বাতাসে গুজব ছড়ানো হয়েছিল, চিন নাকি আন্দোলনের পেছনে আছে। আমি এখনও এর কোনও প্রমাণ পাইনি। শুধু আবেগ সম্বল করে যুদ্ধ কেন, একটা ফুটবল ম্যাচ জেতা যায় না এটা যাঁরা ভাবেননি, তাঁদের সততা ছিল, সামর্থ্য ছিল না। নকশাল আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেখা গিয়েছিল মধ্য বা নিম্নবিত্ত বাড়ির মৌন সমর্থন ওরা পাচ্ছে। কিন্তু পুলিশ নয়, রাজনৈতিক দলগুলো নকশালপন্থীদের মধ্যে বেনোজল ঢুকিয়ে আন্দোলনকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে দিল না।
‘দেশ’ পত্রিকায় ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসটি ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলাম ১৯৭৯-’৮০ সালে। তার দশ বছর আগে নকশালপন্থী আন্দোলন শেষ হয়ে গিয়েছে। জরুরি অবস্থার পর নির্বাচন হল, বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এল। কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আসবে, এ কথা ১৯৬৭ সালে বিশ্বাস করা যেত না। যদি নকশাল আন্দোলন না হত, স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি মানুষের মন থেকে সরিয়ে দিয়ে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসত কি না তাতে সন্দেহ আছে।
‘দেশ’ পত্রিকার শ্রদ্ধেয় সম্পাদক সাগরময় ঘোষের চিঠি পেয়েছিলাম এই রকম, ‘সমরেশ, একটি ধারাবাহিক উপন্যাস শুরু করুন। অবিলম্বে।’ একটি ৩৫ বছরের যুবকের কাছে ওই চিঠি স্বপ্নের মতো। প্রথম পর্বের নাম ‘উত্তরাধিকার’। ১৯৪৭ থেকে খাদ্য আন্দোলনের পশ্চিম বাংলা ছিল পটভূমি। কী করে সাধারণ মানুষ কংগ্রেস সম্পর্কে মোহমুক্ত হচ্ছে, অথচ বিরোধীরা দলবদ্ধ হতে পারছে না, তা একটি কিশোরের চোখ দিয়ে দেখাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জীবনে সেই প্রথম অত বড় পটভূমিতে লিখতে গিয়ে মনে হয়েছিল, আমি পারছি না। তাই অনিমেষ আন্দোলনে উত্তাল কলকাতায় পা দিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর উপন্যাস শেষ করেছিলাম।
কিন্তু পাঠকরা দাবি করলেন, উপন্যাস ওখানে শেষ হতে পারে না। সম্পাদক দ্বিতীয় পর্ব লিখতে বললেন। স্বীকার করছি, উনিশশো ষাট থেকে গোটা পাঁচেক বাদ দিয়ে ‘কালবেলা’ শুরু করেছিলাম। অনিমেষ মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে সরে এসে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সেই সময় অনেক মেধাবী ছেলে নিজের কেরিয়ারের কথা না ভেবে ভারতবর্ষে মুক্তি আনার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এক দল ছিল পিছনে, যারা আন্দোলন সংগঠিত করত, অন্য দল অ্যাকশনে নামত। আমার সহপাঠী শৈবাল মিত্র প্রথম দলে ছিল। আজ স্বীকার করছি, ‘কালবেলা’-র অনিমেষের চরিত্রে শৈবালের কিছুটা ছায়া পড়েছিল।
একটা কথা মনে পড়ছে, ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশিত হওয়ার পর যখন খুব সামান্য বিক্রি হয়েছে, প্রস্তাব এসেছিল, বিজ্ঞাপনে যদি লেখা হয় বইটি কমিউনিস্ট পার্টির সংগ্রামের পটভূমিতে লেখা হয়েছে, তা হলে দশ হাজার কপি কিনে নেবে সরকার। এক জন নতুন লেখকের কাছে এত বিক্রি হওয়া স্বপ্নের চেয়ে বেশি। কিন্তু প্রকাশক বিজ্ঞাপন দিতে রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘এই বিজ্ঞাপন দিলে বইটির বিক্রি শেষ হয়ে যাবে।’ পরের ইতিহাস প্রকাশককেই সমর্থন করেছে। ‘কালবেলা’ বের হওয়ার পরে বামফ্রন্টের সেই মন্ত্রী যিনি ‘কালবেলা’ কিনতে চেয়েছিলেন, তিনি মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত পেছন থেকে ছুরি মারলেন?’
‘কালবেলা’-র বয়স তো বত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেল। পঞ্চাশ বছর হল নকশাল আন্দোলনের বয়স। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভাবেন না অনেক লেখক। কারণ ভরদুপুরে নিজের ছায়া দেখা যায় না। প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠক অনিমেষ-মাধবীলতা সম্পর্কে একই ভাবে আগ্রহী।
‘কালবেলা’ লেখার শেষ সময়ে এক জন মহিলার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন, ‘এই বইতে বাইরের যে বিপ্লবের কথা বলা রয়েছে তার টান হয়তো এক সময় ফুরিয়ে যাবে কিন্তু ভিতরের যে বিপ্লবের কথা পড়ে শিহরিত হয়েছি তাতে বলতে পারি, বিপ্লবের আর এক নাম মাধবীলতা, যা বাঙালি মেয়েদের সম্মানিত করবে চিরকাল।’
‘কালবেলা’ অকাদেমি পেয়েছিল চুরাশিতে। আমি তার চেয়ে অনেক বড় পুরস্কার পেয়ে গিয়েছিলাম উপন্যাস শেষ হওয়ার আগেই।