অভিযাত্রা: পুরীর জগন্নাথ মন্দির, মাঝখানে, রথে ওঠার পথে জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ এবং ডান দিকে, ঈশ্বরের বার্ষিক গন্তব্য গুণ্ডিচা মন্দির
রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে কথাটা বলে রেখেছিলেন স্বয়ং জগন্নাথ। রাজার তৈরি মন্দিরের রত্নবেদিতে তিনি যাচ্ছেন একটা শর্তে! বছরে একটি বার তাঁর জন্মবেদিতে তাঁকে ফিরিয়ে দিতেই হবে। পুরীর গুণ্ডিচা মন্দির জগন্নাথদেবের সেই জন্মবেদি। ন’দিনের গুণ্ডিচা যাত্রা বা নব দিনযাত্রা জগন্নাথের কাছে নিছকই ‘সামার ভেকেশন’ নয়। এ হল ঈশ্বরের শিকড়ে ফেরার লগ্ন। ঠিক যেমন শ্রীকৃষ্ণের ব্রজে প্রত্যাবর্তন।
চার বছর আগে কোভিডের প্রথম বছরে এই যুক্তিতেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রথযাত্রার হয়ে সওয়াল করেন ভক্তজন। এটাই জগন্নাথ-সংস্কৃতি। সত্যিকারের জগন্নাথ-ভক্তের কাছে, রথযাত্রার দরকার প্রভু জগন্নাথের নিজের জন্যই। রথযাত্রার অনুষ্ঠানে ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে’র অনুভব খাটে না। তার থেকে ঢের গুরুতর, ব্রজধাম সদৃশ গুণ্ডিচায় না ফিরলে জগন্নাথদেবের কষ্ট হবে! প্রকৃত ভক্ত তা কী করে সইবেন! ঈশ্বরের এই কষ্টের পাশে তাঁকে রথে দর্শনের পুণ্যলোভও অকিঞ্চিৎকর। তাই শুধুমাত্র রথযাত্রার আচারে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে থাকা সেবায়েতকুল বাদে আর কেউ রথের ত্রিসীমানায় যাবে না— বলে গোটা শ্রীক্ষেত্রই আকুল হয়ে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানিয়েছিল।
পরম্পরার জয়
উৎকলের জগন্নাথদেবের সঙ্গে বাঙালির মা দুর্গার বড় ফারাক রয়েছে। দুগ্গা ঘরের মেয়ে। নানা সামাজিক রাজনৈতিক তাগিদে তাঁর আচার-অনুষ্ঠানে রদবদল হতে দেখা যায়। কিন্তু প্রভু জগন্নাথ উৎকলের রাষ্ট্রদেবতা। তাঁর সারা বছরের সব লীলাখেলা পূর্বনির্দিষ্ট। নট নড়নচড়ন।
ইতিহাসের দীর্ঘ পথ চলায় নানা রাজনৈতিক সংঘাতে কখনও রথযাত্রা স্থগিত থেকেছে। কখনও মন্দিরের বাইরে বিগ্রহ লুকিয়ে রাখতে হয়। আবার আঠেরো শতকের শুরুতে তৎকালীন রাজা দিব্যসিংহদেবের আমলে নানা বিপদের আশঙ্কায় নিচু তারে বাঁধা থেকেছে জগন্নাথদেবের আচার-অনুষ্ঠান। শোনা যায়, কখনও মন্দিরে রত্নসিংহাসনেই সারা হয়েছে স্নানযাত্রার পর্ব। এর পরে ভোগমণ্ডপ পর্যন্ত শ্রীবিগ্রহ নিয়ে গিয়ে নমো-নমো করে সারা হয় গুণ্ডিচা যাত্রার অনুষ্ঠান। এ দেশে কোভিডের প্রথম বছরে সর্বোচ্চ আদালতের আপত্তিতে কেউ কেউ তেমনই সমাধানসূত্র খুঁজেছিলেন। কিন্তু জগন্নাথ-তত্ত্বে বিশ্বাসী মন জোড়াতালিতে শান্তি পায়নি।
পুরীর রথযাত্রা মানে ‘ঠেলাপেলা’ আর ‘দলাচ্যাপ্টা’-রও শঙ্কা। প্রভুর রথের রশি একটি বার ছুঁতে উন্মাদবৎ লাখো ভক্তের কাড়াকাড়ি। অতিমারির দিনে পারস্পরিক দূরত্ব বিধির প্রশ্ন তুলে রথযাত্রার বাস্তবতা নিয়েই আপত্তি করে সুপ্রিম কোর্ট। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কোর্টে টানাপড়েন চলে। শেষমেশ ভক্তশূন্য রথযাত্রায় সায় দেয় সর্বোচ্চ আদালত। জয় হয় জগন্নাথ ভক্তদের আত্মত্যাগে ভরপুর ভালবাসার।
২০২০-র সেই রথযাত্রায় গোটা দেশ দেখে, শুধুমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবায়েতদের নিয়ে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার রথ গুণ্ডিচায় চলেছে। কার্ফুর চাদরে মোড়া পুরীধাম আশ্চর্য সংযমে গৃহবন্দি। যেন কোনও বিশৃঙ্খলায় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হত জগন্নাথেরই। জগন্নাথদেব মন্দিরে ফেরা পর্যন্ত নিয়ম ভেঙে দর্শনের চেষ্টার একটি ঘটনাও ঘটেনি। শুধু সব আচার-অনুষ্ঠান যথাযথ ভাবে সম্পন্ন জেনেই ভক্তেরা শান্তি পেয়েছেন। যে ভক্তের দল এত দিন জীবন তুচ্ছ করে রথের চাকায় প্রাণ দিতে গিয়েছেন, রথের ত্রিসীমানায় না ঘেঁষে তাঁরাই বুঝিয়ে দেন, জগন্নাথদেবই সব। তিনি ছাড়া সব কিছুই নিমিত্তমাত্র। অতিমারির দিনে বাঙালির দুর্গোৎসবও নিচু তারে বাঁধা থেকেছে। তবে এমন জনশূন্য উৎসব আয়োজন বোধহয় বাঙালির সাধ্যের অতীত।
উৎকলর নেতা নিজ নারায়ণ
পুরীর রথযাত্রার সড়ক ‘বড় দাণ্ড’ বা গ্র্যান্ড রোডের ধারেই চোখে পড়ে ‘ওড়িশার গান্ধী’ স্বাধীনতা সংগ্রামী গোপবন্ধু দাসের আবক্ষ মূর্তিটি। তাঁর একটি উদ্ধৃতি ওড়িশায় আপ্তবাক্য হয়ে উঠেছে কবেই। ‘উৎকলর বিশেষে নাহি প্রয়োজন/ উৎকলর নেতা নিজ নারায়ণ’! অর্থাৎ ওড়িশার কাছে জগন্নাথই সব। আর কোনও নেতা, মনীষীর দরকার নেই। উৎকলে জগন্নাথদেব শুধু ইষ্টদেবতা নন, রাষ্ট্রদেবতাও। তা বোঝা যায় সামাজিক বা রাজনৈতিক জীবনে তাঁর মর্যাদায়। রথ নিয়ে রবীন্দ্র-কবিতা বাংলায় প্রবাদপ্রতিম। “পথ ভাবে আমি দেব, রথ ভাবে আমি, মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী!” পুরীর রথযাত্রার অভিজ্ঞানে কিন্তু এমন সংশয়ের ঠাঁই নেই। ভক্ত জানেন, দেবতা একমেবাদ্বিতীয়ম্ জগন্নাথই! এই নিয়ে ধন্দের চিন্তাও হাস্যকর। তবে জগন্নাথ-সংস্রবের জোরেই রথের রশির টুকরো কিংবা কাষ্ঠখণ্ডটুকুও সাক্ষাৎ ভগবানের মেমেন্টোর মর্যাদা বহন করে।
বছর ছয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এক বার জগন্নাথ দর্শনে এসেছিলেন। শ্রীমন্দিরে তখন স্বভাবতই নিরাপত্তার সাজ-সাজ রব। জগন্নাথদেবের মুখে প্রাকৃতিক রং বুলিয়ে ভিভিআইপি অতিথি আসার আগে সামান্য ভেষজ ফেশিয়ালও করানো হয়। পুরীর মন্দিরের পরিভাষায় একে বলে, ‘বনক লাগি’। তবে তখনও অতিথিকে একান্তই জগন্নাথদেবের সঙ্গে দর্শনের সময় এবং শর্ত মেনেই মোলাকাত করানো হয়। বাঙালির পুজোয় ধর্মের ঊর্ধ্বে উৎসবের মর্যাদা। মানে দেবীপক্ষের আগেই পুজোমণ্ডপের উদ্বোধন করে উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়তে পারে। কিন্তু জগন্নাথধামে তা অসম্ভব! যেমন এ বারই পুরীতে একই দিনে সদ্য রোগমুক্ত জগন্নাথের নবযৌবন বেশ এবং রথযাত্রার সমাহার। এমন দিনে মন্দিরে ভক্তসমাগমের প্রাবল্যে আচার-অনুষ্ঠানে দেরি হতে পারে! নবযৌবন উৎসব থেকে শুরু করে জগন্নাথদেবের রথে আরোহণ বা ‘পহুণ্ডি বিজে’ দেখতেও তাই আজ কারও মন্দিরে ঢোকার অনুমতি নেই। মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির মতো মান্যগণ্যেরও এমন নিয়ম ভেঙে মন্দিরে ঢোকার কথা নয়। ২০১৫ সালে পুরীতে শেষ বারের নবকলেবরে, জগন্নাথ নবযৌবন বেশ ধারণের সময়ে মন্দিরে মাত্রাছাড়া লোকসমাগমের আশঙ্কা করা হয়েছিল। সে বারও ঠিক হয়, নব যৌবন উৎসবে মন্দিরের সেবায়েত ছাড়া কেউ থাকতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, তখন মুখ্যমন্ত্রী, নবীন পট্টনায়কও সেই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। জগন্নাথদেব পহুণ্ডির সময়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে রথে প্রকট হতে তিনিও আর সবার মতো রথযাত্রার পথের পাশে তাঁর নির্দিষ্ট আসন থেকে প্রভুর দর্শন করেন। অনেকটা প্রোটোকল মেনে উঠে দাঁড়িয়ে কোনও উচ্চ সাংবিধানিক মর্যাদাধারীর সঙ্গে দেখা করার মার্জিত ভঙ্গি। এ ভাবেই পরিশীলিত বিনয় ও সসম্ভ্রমে উৎকলের জনগণমন-অধিনায়কের মুখোমুখি হন মুখ্যমন্ত্রী। তবে গোপবন্ধু দাস জগন্নাথ বা নারায়ণকে ‘উৎকলর নেতা’ বা রাষ্ট্রদেবতা আখ্যা দিলেও এই নারায়ণের পরিচয় নেহাত সঙ্কীর্ণ অর্থে নয়। উৎকলের জগন্নাথদেবও আসলে ভারতের বহুত্ববাদ বা সমন্বয়ী সংস্কৃতির ধারক হয়ে উঠেছেন।
কৃষ্ণের দেহ, বুদ্ধের দাঁত
কলকাতার বড়বাজারের সুদৃশ্য ইহুদি সিনাগগের পরিচর্যাকারী সিরাজ, আনোয়ারেরা পুরীর নিকটবর্তী কাকরপুরের বাসিন্দা। ধর্মে মুসলিম, কিন্তু ইহুদি উপাসনালয়ের দেখাশোনা করেন পরম যত্নে। উৎকলীয় সংস্কৃতি-চেতনা থেকেই পুরীর জগন্নাথের রথের নামে তাঁরাও বিগলিত। পুরীর জগন্নাথদেবের রথ আজও চলার পথে মুসলিম কবি সালবেগের সমাধিসৌধের কাছে থমকে দাঁড়ায়। সতেরো শতকের শুরুর দিকে জগন্নাথদেবের পরম ভক্ত সালবেগ কোনও এক উল্টোরথে প্রভুকে দর্শনের জন্য তড়িঘড়ি পুরী ফিরছিলেন। তিনি ফেরা পর্যন্ত জগন্নাথের রথ নাকি মাঝপথে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ ক্ষণ তাঁর জন্য অপেক্ষা করেছিল। বড় দাণ্ডের সেই স্থলেই মৃত্যুর পরে সালবেগের সমাধি।
শ্রীক্ষেত্র বা পুরীর মহিমা অবশ্য শুধু ভক্তির এই সর্বজনগ্রাহ্য আবেদনে আটকে নেই। জিশুখ্রিস্টের শেষ পানপাত্র, হারানো ‘হোলি গ্রেল’ খুঁজতে ইউরোপীয় নাইটদের অভিযানের মতোই জগন্নাথ সন্ধান রোমাঞ্চকর রহস্যের পরতে ঢাকা পড়েছে। ভারতের পুরাণ, ইতিহাস, সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সব সেই রহস্যে মিশে।
মধ্যযুগের ওড়িয়া সাহিত্য জুড়ে দারুব্রহ্ম যেন মহাভারতে মুষল পর্বের শেষে নিহত শ্রীকৃষ্ণের দেহাংশ। উৎকলের আদি কবি সারলা দাসের মহাভারত আবার দ্বাপরের কৃষ্ণ এবং কলির বুদ্ধের সঙ্গে জগন্নাথদেবকে অভিন্ন রূপে দেখেছে। স্কন্দপুরাণাদি বইয়েও শবর জনজাতির উপাস্য দারুমূর্তির মূল স্রোতের দেবতা হয়ে ওঠার বিচিত্র আখ্যান। এ প্রসঙ্গে চার দশক আগের একটি রক্ষণশীল আবাসিক ইস্কুলের গল্প মনে পড়ে গেল। ওড়িয়া থেকে বাংলায় ‘ডাব’ করা সিনেমায় জগন্নাথ-কাহিনি দেখাতে গিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রমাদ গুনেছিলেন। ধর্মীয় ছায়াছবি বলে সিনেমাটি দেখানো হলেও ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি কর্তৃক শবরকন্যা ললিতাকে বশীভূত করার চেষ্টা যে বালক-কিশোরদের পক্ষে গুরুপাক! প্রজেক্টরের ‘যান্ত্রিক গোলযোগ’ বা কোনও কারণে সিনেমাটি মাঝপথেই বন্ধ হয়ে যায়।
জগন্নাথের গল্পে শবরদের আরাধ্য নীলমাধবের সন্ধান পেতে ললিতার হৃদয় জয় করে বিয়ে করেন বিদ্যাপতি। এবং স্ত্রীর মাধ্যমে শ্বশুর বিশ্বাবসুকে বুঝিয়ে নীলমাধবের দর্শন পান। এই কাহিনিটিই শ্রীক্ষেত্র বা নীলাচলের ভিত্তি। কাহিনির রকমফেরে মালুম হয়, বিশ্বাবসুর বাবা শবর ব্যাধ জরা-ই হরিণের কান ভেবে শ্রীকৃষ্ণের রাতুল চরণ তিরে বিঁধে তাঁকে হত্যা করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের দেহ সৎকারের সময়ে নাকি তা আগুনে পুরোটা পোড়েনি। অর্ধদগ্ধ হাতবিশিষ্ট দেহাংশ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ক্রমে তা শবরদের আরাধ্য হয়ে ওঠে। বিদ্যাপতির মাধ্যমে কাষ্ঠখণ্ড রূপে তার সন্ধান পেয়েছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। সেই কাঠ থেকেই বিশ্বকর্মা জগন্নাথের দারুমূর্তি নির্মাণ করেন।
শূন্যবাদী ওড়িয়া বৈষ্ণব কবিকুল কিংবা মহাভারতকার সারলা দাসের মতে, এই জগন্নাথই আবার বুদ্ধ অবতার। বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা অনেকে নেপালের কুশীনগর থেকে ওড়িশায় নিয়ে আসা বুদ্ধের দাঁত সপ্তম শতকে দারুব্রহ্মের মূর্তিতে স্থাপন করার কথাও বলেছেন। পুরীর মন্দিরের রীতি, সাধারণত প্রতি ১৯ বছর অন্তর দু’টি অমাবস্যা বিশিষ্ট আষাঢ় মাসে দারুমূর্তিটির বদল হবে। চৈত্র মাস থেকে প্রস্তুতি নিয়ে স্বয়ং জগন্নাথদেবের স্বপ্নাদেশে কাঠ আহরণের পরে চলবে নতুন মূর্তি তৈরির খুঁটিনাটি। পুরনো বিগ্রহ শ্রীমন্দিরের কৈলী বৈকুণ্ঠে সমাহিত বা ‘পাতালি’ করা হবে। তার আগে সেটির ভিতরের ব্রহ্মবস্তু নতুন বিগ্রহে স্থাপন করার রীতি। জগন্নাথদেবের দয়িতাপতি সেবকদের মধ্যে প্রবীণতম, তিন জন এই অতি গোপনীয় আচার পালনের সাক্ষী থাকেন। পুরীর লোককথা বলে, যাঁরা এই ব্রহ্মবস্তু স্পর্শ করেন, এক বছরের বেশি তাঁদের কারও শরীর থাকে না। ২০১৫ সালের নবকলেবরের ব্রহ্ম-পরিবর্তনের সেবায়েতরা অবশ্য এখনও রয়েছেন।
নবকলেবর উৎসবের প্রাক্কালে আজও জগন্নাথ মূর্তির অন্তর্বস্তুর স্বরূপ নিয়ে নতুন করে রহস্য গাঢ় হয়। তা শ্রীকৃষ্ণের দেহাংশ না বুদ্ধের দাঁত না অন্য কিছু, চিরকেলে চর্চা চলে। আর আচার-অনুষ্ঠান পালনে ছিটেফোঁটা বিতর্কে উৎকল জুড়ে শুরু হতে পারে তীব্র রাজনৈতিক টানাপড়েন।
মেলাবেন তিনি
ইতিহাস বলছে, আদিবাসী বা শবর জনজাতিবহুল কলিঙ্গ বা উৎকল ভূমিতে দীর্ঘদিন ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব ততটা ছিল না। পরে বৌদ্ধ, জৈন সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। জগন্নাথদেবের উৎসে তাই বিভিন্ন জনজাতির দেবতার নাম উঠে এসেছে। শ্রীমন্দিরের উত্তর দ্বারের কাছে সংরক্ষিত অসূর্যম্পশ্যা কুয়োর জল তুলে স্নানযাত্রার রীতিতেও শবর সংস্কৃতির ছায়া। অনবসর কাল বা জগন্নাথের জ্বরের সময়ে সেবার দায়িত্বেও শবর বিশ্বাবসুর উত্তরপুরুষ দয়িতা সেবায়েতদের অগ্রাধিকার।
জগন্নাথত্রয়ীতে তাঁদেরই পূর্ণ অধিকার ঘোষণা করে কখনও জৈনরা বলেছেন, বলরাম, সুভদ্রা, জগন্নাথ হলেন জৈন-ত্রিরত্ন। সম্যক জ্ঞান, সম্যক চরিত্র, সম্যক দৃষ্টি। রথের মধ্যেও নাকি জৈন চৈত্যের ছাপ। বৌদ্ধদেরও দাবি, ওই তিন জন আসলে ধর্ম, সঙ্ঘ এবং বুদ্ধ। আবার পরে হিন্দুধর্মের নানা ধারা মিশেছে ত্রিমূর্তিতে। কিন্তু বড়দা বলভদ্র, ভাই শ্রীকৃষ্ণ তথা জগন্নাথ এবং বোন সুভদ্রার ধারণাটিই শেষ কথা নয়। যেমন শাক্ত মতে, তিন জন হলেন তিন দেবী। বলভদ্র উগ্রতারা, সুভদ্রা ভুবনেশ্বরী, জগন্নাথদেব দক্ষিণা কালী।
মধ্যযুগের ওড়িয়া সাহিত্যে শবরীনারায়ণ, নীলমাধবই জগন্নাথ হয়ে উঠেছেন। তবে তেরো শতকের আগে কোনও শিলালেখ বা পুরাকীর্তিতে জগন্নাথ নামটির অস্তিত্ব মেলে না। পুরুষোত্তম নামটিও তার আগে জনপ্রিয় ছিল।
মাসি না পৌর্ণমাসী?
অত হই-হট্টগোলে জগন্নাথদেব মন্দির থেকে রথযাত্রায় বেরোলেও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীদেবী কেন রা-টি কাড়েন না, তা বোঝা দায়। তবে জগন্নাথহীন মন্দিরে এর পরে বেশ রেগেই থাকেন তিনি। অসুস্থ জগন্নাথের অধিষ্ঠানস্থল ‘অনসর পেণ্ডি’-তেই এ বার বসবেন জগন্নাথ জায়া শ্রীদেবী (লক্ষ্মী) এবং ভূদেবী (সরস্বতী)। রথযাত্রার চার-পাঁচ দিনের মধ্যে হেরা পঞ্চমীতে (মতান্তরে হোরা) গুণ্ডিচা মন্দিরে স্বামীর খোঁজ করতে যাবেন লক্ষ্মীদেবী।
শুধু পুরী নয়, রথযাত্রার পর্বে জগন্নাথ ও লক্ষ্মীর মান-অভিমান অন্য জগন্নাথ মন্দিরেরও রীতি। হেরা পঞ্চমীতে লক্ষ্মী ঠাকরুন তাঁর বরের খোঁজে পালকি চড়ে মশাল জ্বালিয়ে রওনা দেবেন। মাহেশের মন্দিরের প্রধান সেবায়েত সৌমেন অধিকারীর বড় ছেলে তমালকৃষ্ণ অধিকারী বলছিলেন, “মা লক্ষ্মী জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি বা কুঞ্জবাটীতে পৌঁছনোর সময়ে প্রভু সবে খেতে বসেছেন। লক্ষ্মী এলেও তাই জগন্নাথের হুকুমে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া রীতি। এতে লক্ষ্মী আরও কুপিত হন!” মাহেশে বন্ধ মন্দিরের সামনে সর্ষে ছুড়ে ঘরছাড়া বরের জন্য বশীকরণের মন্ত্র পড়েন বৌ— ‘বারো মুঠো সর্ষে/ তেরো মুঠো রাই/ চল রে সর্ষে কামাখ্যা যাই/ সর্ষে করে চড়বড়/ জগন্নাথের মন করে ধড়ফড়’! মাহেশে ভক্তেরা দূরদূরান্ত থেকে এসে জগন্নাথের কুঞ্জবাটী বা মাসির বাড়িতে ছোড়া সর্ষে সংগ্রহ করেন। পুরীতেও হেরা পঞ্চমীতে গুণ্ডিচা মন্দিরে গিয়েও জগন্নাথের মানভঞ্জনে ব্যর্থ হন লক্ষ্মী। ক্ষুব্ধ মনে ফেরার সময়ে রথের একটি কাঠ তিনি ভেঙে দিয়ে আসেন।
জগন্নাথের এই মাসির বাড়ির ধারণাটি অবশ্য একান্তই বাঙালির কল্পনা। পুরীর মন্দিরের সেবায়েতদের কাছে রথযাত্রা মানে গুণ্ডিচা যাত্রা। গুণ্ডিচা হলেন ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী। আর মাহেশের সেবায়েতরা বোঝান, মাসি মানে মায়ের বোন মাসি নয়। ইনি হলেন পৌর্ণমাসী। শ্রীকৃষ্ণের ব্রজের গোপিনীদের এক জন।
মথুরা নগরপতি কাহে তুম গোকুল যাও…
দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণকে দেখতে এসে গোপিনীদের মনোবাঞ্ছা পূরণ হয়নি। এর পরেই শ্রীকৃষ্ণ ঠিক করেন, আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় প্রতি বছর পৌর্ণমাসীর কুটিরে তিনি ন’দিন অতিবাহিত করবেন। গোপিনীরা সেখানে ফের নিজের মতো করে পাবেন তাঁকে। জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি যাওয়ায় আদতে সেই গোপিনীর কুঞ্জে যাত্রারই প্রকাশ। বাঙালির মুখে মুখে মাসি হলেও পৌর্ণমাসী তাই সত্যিই মাসি নন।
পুরীর গুণ্ডিচা মন্দিরের ইন্দ্রদ্যুম্নের স্ত্রী গুণ্ডিচাও মতান্তরে শ্রীরাধিকার সখী বৃন্দা। আবার অসমের বৈষ্ণব কবি শ্রীধর কন্দলি অসমিয়া ভাষায় ঘুনুচা কীর্তন পদাবলিতে বলেছেন, ঘুনুচা শব্দটি গুণ্ডিচারই অপভ্রংশ। তিনি আদতে শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী স্ত্রী। তাঁর স্মরণেই রথযাত্রার অনুষ্ঠান। পুরীতে অবশ্য গুণ্ডিচা মন্দিরের অদূরেই মাসুমা বা মৌসীমা মন্দিরেরও অবস্থান। উল্টোরথ বা বাহুড়া যাত্রার সময়ে জগন্নাথদেব সেখানে আটার মিষ্টি, মিষ্টি ‘পোড়ো পিঠে’র আস্বাদ নেন। গুলিয়ে ফেলবেন না, ইনিও কিন্তু মাসি নন। কেউ কেউ এটিকেই পৌর্ণমাসীর মন্দির বলে থাকেন। মতান্তরে তিনিই কৃষ্ণের স্নেহময়ী মা দেবকী।
মাহেশের মন্দিরের সম্পাদক পিয়ালকৃষ্ণ অধিকারী (সৌমেন অধিকারীর ছোট ছেলে) বলেন, “মোদ্দা কথা, গুণ্ডিচা বা আমাদের কুঞ্জবাটী মন্দিরে যাত্রা জগন্নাথদেবের ঐশ্বর্য লীলা ত্যাগ করে মাধুর্য লীলার বিকাশ।”
জগন্নাথের মন্দিরে ৩৬৫ দিন অষ্টপ্রহর নিরন্তর ইভেন্টের চক্রে ঈশ্বরের মানবসত্তারই উদ্যাপন। মন্দিরের রত্নসিংহাসন তাঁর কর্মবেদি। কিন্তু মানুষ তো ছকে বাঁধা যন্ত্র হতে পারে না! শুধু কর্মমুখর বিশ্বসংসারই জীবন নয়। রথযাত্রার রূপকে সংসার ছেড়ে প্রিয় সখী, পুরনো সুহৃদের কাছে যাত্রায় তাই ঈশ্বরের অহৈতুকী প্রেমেরও নির্ঘোষ। ধ্রুপদী মহাকাব্যে কি সাহিত্যরসিকের চোখেও নায়ক-নায়িকার উত্তরণে এই সংসার বা রাজ্যপাট ত্যাগ জরুরি! অনেকটা যেমন মহাকাব্যের নায়কদের বনবাস। কিংবা শেক্সপিয়রের নাটকের চরিত্রদের নগরজীবন ছেড়ে কোনও নন্দনকানন বা বিজন দ্বীপে যাত্রার ‘পাস্টোরাল রিট্রিট’।
গুণ্ডিচায় গৌরাঙ্গ
জগন্নাথের রথ গুণ্ডিচায় আসার এক দিন আগে এ মন্দিরে তাঁর পাইলট হয়ে আসতেন স্বয়ং চৈতন্যদেব। রথযাত্রা এলে ভক্তেরা আজও আলোচনা করেন, কী ভাবে রাজপুরোহিত কাশীনাথ মিশ্রকে বলে গৌরাঙ্গ ‘গুণ্ডিচা সম্মার্জন’-এর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। এক বছর বাদে প্রভু জগন্নাথ গুণ্ডিচায় ফিরছেন। সেই মন্দির সাফসুতরো করে রাখতে হবে তো! ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-এ আছে, নিমাই এবং তাঁর অনুগত ভক্তরাও রাধা-ভাবে গোপিনীর মতো আবেগে প্রভু জগন্নাথের বসত পরিষ্কারে মেতে উঠতেন। তাঁরাও বিশ্বাস করতেন, গুণ্ডিচাবাসে জগন্নাথদেব আসলে শ্রীকৃষ্ণের মতোই ব্রজে ফিরে সখীদের সঙ্গে রাসলীলায় মাতেন।
পুরীর রথযাত্রায় এই গুণ্ডিচা সম্মার্জনের অনুষ্ঠানই সম্ভবত বাঙালির সব থেকে মহতী অবদানের স্বাক্ষর। এমন বঙ্গসম্মেলনও কদাচ চোখে পড়ে। ঘরের ছেলে গৌরাঙ্গের স্মরণে দূরদূরান্তের বাঙালি বৈষ্ণব ভক্তেরা আজও রথযাত্রার আগের দিন তাঁর গুণ্ডিচা সংস্কারের ‘অ্যাকশন রিপ্লে’ মেলে ধরেন। পুরীর ঝাঁঝা পিটা মঠ থেকে পথে নামে ‘বাঙালি ব্রিগেড’। শ্রীমন্দিরের সিংহদ্বারের সামনে দিয়ে প্রথমে চৈতন্য স্মৃতিবিজড়িত রাধামাধবের গম্ভীরা মঠে যান তাঁরা। গৌরাঙ্গের খড়মে প্রণাম করেন। তার পর খালিপায়ে মাটির ঘড়া কাঁখে খ্যাংরা ঝাঁটা উত্তোলন করে আশ্চর্য শোভাযাত্রা! ঠিক যেন সপার্ষদ চৈতন্য নামগান করতে করতে গুণ্ডিচা অভিমুখী হলেন। এর পরে সেই মন্দির ঝেড়েপুঁছে তকতকে করার দৌড়ঝাঁপ।
জগন্নাথদেবের গোপিনী-সান্নিধ্যে রিইউনিয়নের লগ্নটিই বছর বছর চৈতন্যদেবের সঙ্গে বাংলায় তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তকুলের রিইউনিয়ন আসরও হয়ে উঠত। শোনা যায়, পুরীর জল ভাল হজম হত না বলে রথযাত্রার সময়েই রাঘব পণ্ডিতের বোন দময়ন্তী গৌরাঙ্গের সারা বছরের রেশন পাঠিয়ে দিতেন। ভাতে মেখে খাওয়ার করলা, আমলা, নিমপাতাসুদ্ধ চমৎকার রেডি-টু-ইট শুক্তো, নাড়ু, নিমকি, মুখশুদ্ধি মায় শৌচকর্মের গঙ্গামাটি। আজও গম্ভীরা মঠে নিমাইকে নিবেদিত ঝালা অর্পণের প্রতীকী অনুষ্ঠান হয়। জগন্নাথ ও গোপিনীদের পুনর্মিলনের প্রাক্কালে রথযাত্রার দু’দিন আগে গম্ভীরায় দেখা যায় চৈতন্যদেবের গৌড়ীয় ও ওড়িয়া ভক্তদেরও মিলন সমারোহ। ওড়িয়ারা গৌড়ীয়দের মালা পরিয়ে বরণ করে নেন। আর রথযাত্রার আগের দিন ভক্তদের মনের চোখে অবধারিত ফুটে ওঠে গৌরাঙ্গের অপরূপ ধূলিধূসরিত কান্তি। যেন রাধা-ভাবে এইমাত্র জগন্নাথের গুণ্ডিচার রত্নসিংহাসন ঘেমেনেয়ে পরিষ্কার করে উঠেছেন তিনি!
কালের যাত্রা
জগন্নাথদেব ও রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের গল্পে, গুণ্ডিচাতেই দারুমূর্তির নির্মাণে প্রভু প্রকট হন। গুণ্ডিচায় তাঁর জন্মবেদি। আবার গুণ্ডিচা ব্রজধামেরও প্রতীক। রথে আসীন হয়ে এ ব্রজধামে প্রত্যাবর্তনে জগন্নাথদেবের প্রতিশ্রুতি রক্ষারও তাগিদ। তবু কিছু বেয়াড়া প্রশ্নও ওঠে, সংসার ছেড়ে ক’দিন ছুটির এই অবকাশ কি পুরুষমানুষেরই অধিকার? প্রতি বছর উল্টোরথের পরে জগন্নাথের মন্দিরের ফেরার সময়েও তো এই নিয়ে তাঁর ও লক্ষ্মীদেবীর মধ্যে ফাটাফাটি হয়ে যায়।
মাহেশের সেবায়েতরা বলেন, উল্টোরথ যাত্রায় কিন্তু জগন্নাথদেব দক্ষিণাকালী রূপে বিরাজ করেন। তখন তিনি অর্ধনারীশ্বর। তাই সব রীতি পুরুষ-নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জবাব না-ও মিলতে পারে।
তবু পুরীর মন্দিরের রীতি, গুণ্ডিচা-ফেরত জগন্নাথদেব মন্দিরে ঢোকার সময়ে বহু কাঠখড় পুড়িয়ে রত্নবেদিতে বসার পাসওয়ার্ড জোগাড় করতে হবে। জগন্নাথের প্রতিনিধি দয়িতাপতির সঙ্গে লক্ষ্মীর প্রতিনিধি দেবদাসী তখন তরজায় জড়ান। পুরীর মন্দির বহু দিনই দেবদাসীহীন। অতএব তাঁদের বদলে মা লক্ষ্মীর পান্ডাদের এক জন এখন দেবীর হয়ে সওয়াল করেন। রীতিমাফিক এই তর্কে হার হয় জগন্নাথদেবের প্রতিনিধিরই। শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ হবে রসগোল্লায়। আর কখনও এমন ভুল হবে না, স্বীকার করে লক্ষ্মীকে রসগোল্লা খাইয়ে মন্দিরে ফেরেন জগন্নাথ।
এ-ও বাহ্য! সকলেই জানেন, বছরের নির্দিষ্ট মুহূর্তটি চলে এলে দারুব্রহ্মকে তাঁর লক্ষ্য থেকে আটকানো যাবে না কিছুতেই। হ্যাঁ ঠিকই, যত বড় এ রাজধানী, তত বিখ্যাত নয় এ হৃদয়পুর। তবু আমরা জানি, রাজধানী ও হৃদয়পুরের সংঘাতে সব সময়ে হৃদয়েরই হার হয় না। রাজপ্রাসাদের সজ্জাও কখনও কণ্টকসম হয়ে ওঠে। রাজদণ্ড ফেলে মথুরানগরপতি বাঁশিটি হাতে তুলে নেন। রথযাত্রার হাজারো বছরের সাংস্কৃতিক ধারাটি সেই নাছোড় হৃদয়বত্তায় বিশ্বাসেরও স্মারক।