অশ্বত্থামার চেনা গল্পটা দিয়েই শুরু করা যাক। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে সৌপ্তিক পর্ব। রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকেছেন অশ্বত্থামা। উদ্দেশ্য, পিতা দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর প্রতিশোধ। তাঁকে মিথ্যা কথা বলা হয়েছিল। অশ্বত্থামা নামের এক হাতিকে মেরে ঠারেঠোরে বলা হয়েছিল, ‘আপনার পুত্র যুদ্ধে মৃত’। হাতের অস্ত্র ফেলে ধ্যানে বসেছিলেন পিতা, তখনই দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ছুটে গিয়ে তরবারির এক কোপে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর মাথা। এই হত্যাকারীরা আদতে ক্ষমার যোগ্য নয়!
অন্ধকার পাণ্ডব শিবিরে সে দিন প্রথমেই নিদ্রিত ধৃষ্টদ্যুম্নকে পেয়ে গিয়েছিলেন অশ্বত্থামা। দেখেই একের পর এক পদাঘাত, চুলে হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে বিছানা থেকে মাটিতে ফেলে তাঁকে চেপে ধরলেন। তার পর পা দিয়ে তাঁর বুক আর গলা চেপে ধরে পশুর মতো নিধন করলেন।
মহাভারতকার জানাচ্ছেন, আক্রান্ত ধৃষ্টদ্যুম্ন এক বার কাতর আবেদন করেছিলেন, “আচার্যপুত্র, আমাকে অস্ত্রপ্রহার দ্বারা অবিলম্বে সংহার করো।” উত্তরে অশ্বত্থামা পাল্টা বলেছিলেন, “রে কুলাঙ্গার, আচার্যহন্তাদের কোনও লোকে যাওয়ার অধিকার নেই, তোর উপর অস্ত্রনিক্ষেপ তাই একান্ত অকর্তব্য।” এ ভাবেই সে দিন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন দ্রোণতনয়। উত্তমৌজা ও যুধামন্যু নামের দুই পাঞ্চাল রাজকুমার অন্ধকার হট্টগোলে ছুটে এসেছিলেন, অশ্বত্থামা ওই ভাবেই পাদিয়ে তাঁদের বুক, গলা বারংবার মাড়িয়ে মাড়িয়ে যমালয়ে পাঠালেন।
আর মহাবীর অ্যাকিলিস? বন্ধুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তিনিও প্রথমে তরবারি বা অস্ত্র ব্যবহার করলেন না, ট্রয় নগরীর বিশাল প্রাচীর ধরে ছুটিয়ে ছুটিয়ে মারলেন সেখানকার রাজপুত্র হেক্টরকে। “যত বারই হেক্টর বুরুজগুলির দিকে ছুটে গেল, যাতে উপরে থাকা সহযোদ্ধারা তির ছুড়ে তাকে সুরক্ষা দিতে পারে, তত বারই ক্ষিপ্র পায়ে অ্যাকিলিস তার সামনে চলে এল, প্রায় উড়ে উড়ে গিয়ে তাকে বাধ্য করল সমতলের দিকে ঘুরে যেতে,” লিখছেন হোমার। ধৃষ্টদ্যুম্নের আর্তি সত্ত্বেও অস্ত্রাঘাতে ক্ষত্রিয় বীরের সদ্গতি নাকচ করে দিয়েছিলেন অশ্বত্থামা, অ্যাকিলিসের রাগও যেন অনেকটা সে রকম। হেক্টর বললেন, “এই দ্বন্দ্বযুদ্ধে হয় আমি মারা যাব, নয় তুমি। এসো অ্যাকিলিস, একটা চুক্তি করি। যদি আমি তোমাকে মারতে পারি, তোমার মৃতদেহ সসম্মানে তুলে দেব গ্রিকদের হাতে। আর তুমিও ঠিক তা-ই করবে।” অ্যাকিলিস জবাব দিলেন, “হেক্টর, তোমার মতো ঘৃণ্য লোকের সঙ্গে চুক্তি? নেকড়ে আর ভেড়ার মধ্যে চুক্তি হয় নাকি?”
এই দ্বন্দ্বযুদ্ধের শেষে ট্রয়ের যুবরাজের মৃত্যু। দুই যুযুধান দু’জনের দিকে বল্লম ছোড়েন। হেক্টরের বল্লম অ্যাকিলিসের ঢালে লেগে ছিটকে যায়। আর অ্যাকিলিস? তিনি বল্লমটা ছুড়ে দেন হেক্টরের বর্মহীন কাঁধের হাড়ে, তাতেই ট্রয়রাজ্যের মহাবীরের মৃত্যু। রাগের চোটে অশ্বত্থামা শত্রুর গলা পা দিয়ে চেপেছেন, অ্যাকিলিস কণ্ঠার হাড়ে বল্লম ছুড়েছেন। মিল এখানেই শেষ নয়, এর পর মৃত হেক্টরকে রথের পিছনে চাকার সঙ্গে বেঁধে ঘষটাতে ঘষটাতে গ্রিক শিবিরে নিয়ে যাবেন অ্যাকিলিস। দুই বীরই রাগে ভয়ঙ্কর, শত্রুর অন্ত্যেষ্টি সৎকারের সুযোগটুকুও দিতে নারাজ তাঁরা।
‘ইলিয়াড’-এর গল্পটা অনেকেরই জানা। স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেন পরমাসুন্দরী, ট্রয়ের যুবরাজ প্যারিস স্পার্টায় আতিথ্য নিতে এসে হেলেনের প্রেমে পড়েন, দুজনে ‘ইলোপ’ করে ট্রয়ে ফেরেন। হেলেনের সম্মতি ছিল কি না, সে বিষয়ে হোমার নীরব। মেনেলাউসের দাদা, আর্গসের রাজা আগামেমননের নেতৃত্বে গ্রিকরা তখন ট্রয় আক্রমণে রণতরী ভাসায়। তাঁর সঙ্গে অ্যাকিলিস, অ্যাজাক্স, অডিসিয়ুস এবং আরও গ্রিক বীর। এই ট্রয় যুদ্ধ নিয়েই হোমারের ‘ইলিয়াড’। অ্যাকিলিস কী ভাবে মারা যান, তা নিয়ে এই মহাকাব্যে কিছু নেই। কিন্তু হোমারের অন্য মহাকাব্য ‘ওডিসি’তে মৃতদের রাজ্যে অ্যাকিলিসকে দেখতে পান ওডিসিয়ুস। তাঁকে সম্মান দিয়ে বলেন, “বাহ, আপনি তো এখানেও রাজা।” উত্তরে অ্যাকিলিস বলেন, “বেশি বকবক করবেন না। কে চায় মৃতদের রাজা হতে? এখান থেকে এক বার বেরোই, তার পর দেখে নিচ্ছি।” বোঝা যাচ্ছে রাগের বহর? অ্যাকিলিস বরাবরই এ রকম রাগী, আগামেমনন সেনাপতি হলেও মহাকাব্যের শুরুতে তাঁকে কথার চোটে প্রায় ধুইয়ে দেন অ্যাকিলিস, “এই নির্লজ্জ কুকুরমুখো। ট্রয়ের লোকদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই, তবু এসেছি। আর তুমি এখন বলছ, আমার তাঁবু থেকে ব্রাইসিস নামের মেয়েটাকে তুলে নিয়ে আসবে? আমি যুদ্ধে জিতে ওকে লুঠ করে এনেছি। লুঠের ভাগ তোমাকেও দিয়েছি, এখন ওকে ছাড়ব কেন?”
রাগের চোটে অ্যাকিলিস কয়েক দিন যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ান, বন্ধু পেট্রোক্লাসের মৃত্যুর পর ফের রণভূমে ফিরে আসেন।
এই যে রাগের চোটে খোদ সেনাপতিকেও পাত্তা না দিয়ে দু’-চার কথা শুনিয়ে দেওয়া, মহাভারতে এটি অশ্বত্থামারও বৈশিষ্ট্য। বিরাটপর্বে দুর্যোধন, দুঃশাসনরা গরু উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে আসে। তারা জানত না, পাণ্ডবরা ওই রাজ্যেই এক বছর অজ্ঞাতবাস কাটিয়েছে। কর্ণ বলেন, “আরে, অর্জুনটাকে পেলেই হবে। ওকে আমি বধ করেই ছাড়ব আজ।” অশ্বত্থামা আচমকা বলে ওঠেন, “বেশি বক্তিমে দিয়ো না কর্ণ। অর্জুন-টর্জুন ছাড়ো, কোনও দিন সহদেবকে যুদ্ধে হারিয়েছ?” ‘বস ইজ় অলওয়েজ় রাইট’— এ যুগের আপ্তবাক্য। মহাভারত এবং ইলিয়াড দুই মহাকাব্যের দুই মহাবীর এ সবের ধার ধারেননি।
অ্যাকিলিস যেমন সাফ বলেছিলেন, ট্রয়ের লোকদের সঙ্গে আমার কোনও ব্যক্তিগত বিরোধ নেই; কর্ণপর্বে অশ্বত্থামাও দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করার পরামর্শ দেন, দুর্যোধন নারাজ। অ্যাকিলিস যেমন হেক্টরের হাতে বন্ধু পেট্রোক্লাসের মৃত্যুর পর প্রায় ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধে ফিরে আসেন, অশ্বত্থামাও অনেকটা সে রকম। দুর্যোধনকে বললেন, ‘ধৃষ্টদ্যুম্নমহত্বাহং ন বিমোক্ষ্যামি দংশনম্।’ আমার পিতার হত্যাকারী ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ না করে আমি যুদ্ধসজ্জা ত্যাগ করব না।
এত সব কথা মনে পড়ল অমিতাভ বচ্চন অভিনীত সাম্প্রতিক ব্লকবাস্টার ‘কল্কি ২৮৯৮ এডি’ দেখতে গিয়ে। সেখানে চিরঞ্জীবী অশ্বত্থামা ভাবী নির্জলা যান্ত্রিক পৃথিবীতে কাশীর মন্দির তথা ‘কমপ্লেক্স’-এ বেঁচে, সুমতি বা দীপিকার গর্ভস্থ কল্কি অবতারকে বাঁচানোর সংগ্রামে ব্যস্ত। কল্কিপুরাণ বলে, এক ব্রাহ্মণের ঔরসে সুমতি নামক নারীর গর্ভে আসবেন ভাবী অবতার। তাঁকে অশ্বত্থামা বাঁচিয়ে উত্তরার গর্ভস্থ পরীক্ষিৎ-হত্যার পাপ থেকে মুক্ত হবেন। ভারতীয় পুরাণে অশ্বত্থামার পাশাপাশি কৃপাচার্য, হনুমান, বিভীষণ, পাতালের বলিরাজা, ব্যাসদেব, পরশুরাম… মোট সাত জন চিরঞ্জীবী আছেন। কিন্ত পূতিগন্ধময় শরীরে একমাত্র অশ্বত্থামার এই চিরকাল বেঁচে থাকাটা শিশুহত্যার পাপের ফল। মৃতদের রাজ্যে অ্যাকিলিসের মতো অশ্বত্থামাও তাই বলতেই পারেন, কে চায় চিরকাল অভিশপ্ত এই অমরত্বে থাকতে?
অমর তো অ্যাকিলিসও! হোমারের পরবর্তী গ্রিক কবিরা কেউ কেউ লিখে গিয়েছেন, দানিয়ুব নদী যেখানে কৃষ্ণসাগরে পড়ছে, সেখানে অরণ্য ও হিংস্র শ্বাপদ আচ্ছন্ন এক দ্বীপে আজও হেলেন এবং অ্যাকিলিস আছেন। রাতে তাঁরা হোমারের মহাকাব্যের প্রশস্তি ও বীরত্বগাথা গাইতে থাকেন। গ্রিক পুরাণকারদের কারও কারও মতে, অ্যাকিলিসের সঙ্গে পরে হেলেনের বিয়েও হয়েছিল। হতেই পারে! ‘ইলিয়াড’-এ যুদ্ধের মাঝে হেক্টর এক বার প্রাসাদে ফিরে দেখেন, ছোট ভাই প্যারিসের জন্য তাঁর স্ত্রী হেলেন বর্শা, বল্লম ও যুদ্ধাস্ত্র গুছিয়ে দিচ্ছেন। প্যারিসকে হেলেনপতিত্বে বরণ করেছিলেন, হোমারই ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছেন। মেনেলাউসই হেলেনের এক এবং একমাত্র স্বামী নন।
অ্যাকিলিসও বিবাহিত। তাঁর মা জানতেন, ট্রয়যুদ্ধে বীরত্ব দেখালেও নিয়তির নির্বন্ধে সেখানেই অ্যাকিলিসের মৃত্যু। ফলে অ্যাকিলিসের যুদ্ধযাত্রার সম্ভাবনা নাকচ করতে তিনি নারীর বেশে সাজিয়ে ছেলেকে স্কাইরোস দ্বীপের রাজা লাইকোমিদিসের প্রাসাদে রেখে এলেন। আমাদের মহাভারতে অর্জুন যেমন নারীর বেশে বিরাট রাজার প্রাসাদে এক বছর অজ্ঞাতবাসে ছিলেন।
কিন্তু দ্রৌপদী এবং সুভদ্রার প্রৌঢ় স্বামীর সঙ্গে বালক অ্যাকিলিসের ভাগ্যের কিছু ফারাক আছে। অজ্ঞাতবাসের শেষে বিরাট রাজা কন্যা উত্তরাকে অর্জুনের হাতে তুলে দিতে চাইলেও অর্জুন সেই প্রস্তাব নাকচ করেন। শিষ্যা উত্তরা তাঁর কাছে নিজের মেয়ের তুল্য, তাকে বিয়ে করবেন কী ভাবে? তাই পুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব দেন, বিরাটও রাজি হন।
কিন্তু অ্যাকিলিস তো বালক মাত্র, সদ্য যৌনতার উন্মেষ তাঁর শরীর ও মনে। মেয়ের বেশে থাকতে থাকতেও সেই বালক লাইকোমিদিসের কন্যা বালিকা ডেইডিমিয়ার প্রেমে পড়ল। অতঃপর বিবাহবন্ধন। দম্পতির একটি ছেলে হল— নেপ্টোলেমাস। নেপ্টোলেমাসও বাবার মতোই বীর, ট্রয়যুদ্ধের শেষে সে হেক্টরের বিধবা স্ত্রী অ্যান্ড্রোমেশে-কে টেনে হিঁচড়ে ক্রীতদাসী হিসাবে গ্রিক জাহাজে তুলে নেয়, রানির শিশুপুত্রকে প্রাচীর থেকে ছুড়ে হত্যা করে। শুধু অশ্বত্থামাই শিশুহত্যার দোষে দুষ্ট নন।
মায় গ্রিক রাজা আগামেমনন! তিনি তো নিজের মেয়েকেই বলি দিতে গিয়েছিলেন! ট্রয় যাত্রার পথে সকলে নির্বিঘ্ন সমুদ্রযাত্রায়, কিন্তু আর্গস-রাজ, সেনাপতি আগামেমননের জাহাজ নট নড়নচড়ন হয়ে আটকে যায়। শিকার ও প্রকৃতির দেবী আর্টেমিসের অভিশাপে। বিষ্ণু দে-র ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ কবিতার কল্যাণে বাঙালি অবশ্য এই দেবীর সঙ্গে ভালই পরিচিত।
ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, যাত্রাপথে আর্টেমিসের সংরক্ষিত আউলিসের পবিত্র অরণ্যে একটি হরিণ শিকার করেছিলেন রাজা। তাতেই দেবীর ক্রোধ। তাঁর অরণ্যে, যেখানে তিনি সকল পশুপাখির অভয়দাত্রী, সেখানে শিকার!
গ্রিক পুরোহিত ক্যালচাস জানালেন, দেবী বলি চান। আগামেমননের নিজের মেয়ে ইফিগেনিয়াকে বলি দিলে দেবী তুষ্ট হয়ে জাহাজ ছেড়ে দেবেন। আর্গসের প্রাসাদে খবর পাঠালেন রাজা। তাঁর স্ত্রী সকন্যা সেখানে এসে পৌঁছলেন। বালিকা ইফিগেনিয়া তখন আনন্দে মুখর,সে জানে অ্যাকিলিসের সঙ্গে তার বিয়ে হবে। নৌবহর আটকে, অ্যাকিলিসও তাঁর ৫০টি জাহাজ নিয়ে সেই আউলিসেই।
কিন্তু বলি দেওয়ার মুহূর্তে প্রবল ঝড়। ইফিগেনিয়াকে আর দেখা গেল না। দেবী শেষ মুহূর্তে মত বদলে ইফিগেনিয়াকে নিয়ে আসেন আর এক শহরে, তাঁর মন্দিরে। মহাকাব্যবেত্তারা কেউ কেউ বলেন, এই পলায়নে অ্যাকিলিসের হাত ছিল। তিনি নাকি ইফিগেনিয়াকে বিয়েও করেছিলেন। অশ্বত্থামা ব্রহ্মাস্ত্র ফেরাতে না পেরে উত্তরার গর্ভস্থ পরীক্ষিৎকে হত্যা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কোনও বালিকাকে হাড়িকাঠ থেকে পালাতে সাহায্য করেননি। হস্তিনাপুরের প্রাসাদে সে রকম ঘটনা ঘটাও অসম্ভব। তবু অশ্বত্থামার ভাগ্যে মহাভারতকার চিরকাল বেঁচে থাকার অভিশাপ দিয়েই থেমে থাকেননি, কোনও প্রেয়সীও দেননি। বিয়ে-থা তো দূর অস্ত!
দুই মহাবীরের বংশলতিকাতেই আছে অপ্সরা-সংযোগ। ঘৃতাচী নামের অপ্সরাকে দেখে এক দিন ভরদ্বাজ মুনির রেতঃস্খলন হয়, সেটি তিনি দ্রোণ বা কলসিতে ভরে রাখেন। সেখান থেকেই দ্রোণাচার্যের জন্ম। মায় দ্রোণাচার্যের স্ত্রী, অশ্বত্থামার মা কৃপীও অপ্সরাজাত। এক অপ্সরাকে দেখে শরদ্বান ঋষির রেতঃস্খলন হয়, সেই অপ্সরাগর্ভেই দুই শিশুর জন্ম। যমজদের এক জন ছেলে, অন্য জন মেয়ে। কিন্তু ঋষি বা অপ্সরা কেউই তো তাদের পালন করবেন না। তাই বাচ্চাদুটোকে ফেলে দেওয়া হল শরবনে। হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনু সেখান দিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলেন শিশুর কান্না। ছেলেমেয়ে দু’টিকে প্রাসাদে এনে তিনি মানুষ করতে লাগলেন। রাজার কৃপা, ফলে ছেলেটির নাম হল কৃপ, মেয়েটির নাম কৃপী। কৃপীর সঙ্গে বিয়ে হল আর এক ঋষি-অপ্সরা মিলনের সন্তান দ্রোণের। কৃপী আর দ্রোণাচার্যের একমাত্র পুত্রই অশ্বত্থামা। আর সমুদ্রের অতলে থেটিস নামে এক জলপরি ও পেলিয়ুস নামে এক রাজার মিলনে অ্যাকিলিসের জন্ম। এই জলপরিরা অলিম্পাস পাহাড়ে দেবরাজ জ়িউসের সভাগৃহে যেতে পারেন, কিন্তু হেরা বা আথেনার মতো দেবী-সম্মান তাঁদের নেই। আমাদের উর্বশী, মেনকা, রম্ভা প্রমুখ অপ্সরাদের মতো।
কিন্তু ট্রয়ের যুদ্ধে দেবতারা ভাগাভাগি হয়ে দুই শিবিরে। কখনও অলিম্পাস পাহাড়ে, কখনও বা তাঁরা ট্রয় নগরীর বাইরে বসে বসে যুদ্ধ দেখেন। আর সময় এলে নিজ ভক্তদের সাহায্য করে আসেন। যেমন সূর্যদেবতা অ্যাপোলো হেক্টরের পক্ষে, দেবী আথেনা অ্যাকিলিসের পক্ষে। হেক্টরের ছোট ভাইয়ের ছদ্মবেশে তিনি যুবরাজকে প্রায় অ্যাকিলিসের হাতে তুলে দেন, “দাদা, নগরীর প্রাচীরের বাইরের তোরণে যাও।” থেটিস মাঝে মাঝেই এসেছেন ছেলের কাছে এবং অ্যাকিলিসকে জানিয়েছেন তার ভবিতব্য। হেক্টর বধের পর সে-ও কিন্তু আর বেশি দিন পৃথিবীতে থাকবে না। কিন্তু অ্যাকিলিস কি থেমে থাকার লোক?
গ্রিক দেবদেবীরা শিবির বদল করেননি, কিন্তু অশ্বত্থামা যেখানে রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকে ধৃষ্টদ্যুম্ন থেকে দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র সবাইকে নারকীয় ভাবে বধ করেছেন, মহাভারতের সেই সৌপ্তিক পর্বে এক জন দেবতা আক্ষরিক অর্থেই শিবির বদলেছেন। তিনি স্বয়ং আশুতোষ শিব। সেই রাতে অশ্বত্থামা পাণ্ডব শিবিরে ঢুকতে গিয়ে দেখলেন, অগ্নিশিখায় প্রদীপ্ত, সর্পবিভূষিত, ভীষণদর্শন এক পুরুষকে। অশ্বত্থামা যত অস্ত্র ছোড়েন, সে হাঁ করে তা গিলে নেয়। তখন অশ্বত্থামা ভাবলেন, আমি স্বেচ্ছায় অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকে অধর্মে প্রবেশ করছি। এই বিশাল পুরুষ দেবতার কালদণ্ড, আমার অধর্মে প্রবৃত্ত কলুষিত বুদ্ধিরই শাস্তিস্বরূপ। অ্যাকিলিস জানেন, হেক্টর-বধের পর তাঁরও মৃত্যু নেমে আসবে, অশ্বত্থামা জানেন, সম্মুখসমরে না পেরে তিনি রাতের অন্ধকারে শত্রুবধের পাপাচরণ করতে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের মতো দুই মহাবীরই বলতে পারেন, ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’।
সেই কৃতান্ত পুরুষের কৃপা পাওয়ার জন্য অশ্বত্থামা তাই নিজেকে যজ্ঞবেদিতে আহুতি দিতে গেলেন। তখনই সেই পুরুষ স্বরূপে দর্শন দিলেন, আশুতোষ শিব। কালী রুধিরাক্ত পানের জন্য হা হা করে হেসে উঠলেন। কৃষ্ণ তাঁর বন্ধু, ফলে শিব এত দিন পাণ্ডবদের আগলে রেখেছিলেন। কিন্তু এখন কাল সমাগত, নিয়তির নির্বন্ধই জয়ী হবে, তাই তিনি পাণ্ডবদের আর আগলে রাখবেন না। এর আগে বনপর্বে কিরাতবেশী শিব অর্জুনকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র দিয়েছেন, কাল পূর্ণ হতে তিনি আজ সপুত্র পাণ্ডব শিবির ছেড়ে চলে গেলেন। ‘পুরাণকোষ’-এ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এই নিয়তিকে বিধাতার স্ত্রী হিসাবে জানিয়েছেন। ফলে তাঁর বিধান খণ্ডাবে কে?
গ্রিকদেরও নিয়তি আছে, তিন বোন মিলে সুতো কেটে জন্মের তৃতীয় দিনে মানুষের ভাগ্য, আয়ু ও কর্ম নির্ধারণ করে। নিয়তির বিধান পূর্ণ হলে অ্যাপোলো তাঁর ভক্ত হেক্টরকে ছেড়ে গিয়েছেন, আথেনা ছেড়ে গিয়েছেন অ্যাকিলিসকে। কিন্তু কেউই শিবির বদলাননি। গ্রিক ও ভারতীয় চেতনার তফাত কি এখানেই?
অশ্বত্থামা ছাড়াও মহাভারতে আরও অনেক রাগী যোদ্ধা আছেন। ভীম তো বনবাসের আগে দুর্যোধনকে গদাঘাতে নিহত করবেন, দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করবেন ইত্যাদি প্রতিজ্ঞা করেছেন। অর্জুন জানিয়েছেন, তিনি কর্ণকে বধ করবেন। কর্ণ অস্ত্রগৌরবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, ঠিকই আছে। কিন্তু তিনি নিজ ক্ষমতার বাইরে অনেক গালভারী প্রতিজ্ঞা করেছেন, এক দিনে সব কৌরব সৈন্যকে একাই বধ করবেন বলেছেন, পারেননি।
আর ভীম? তিনি ছোটবেলা থেকে বলশালী, ঔদরিক, কৌরব ভাইদের মাথা ঠোকাঠুকি করে দেন, তারা গাছে উঠলে সেই গাছ ধরে ঝাঁকান। দুর্যোধন ও তিনি দু’জনেই গদাযুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের শিষ্য, বলরাম বরাবরই দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধে এগিয়ে রেখেছেন। দ্রোণাচার্য যে দিন পাণ্ডবদের অস্ত্রপরীক্ষা নিলেন, অর্জুন শুধু পাখির চোখ দেখে পাখিটা তিরবিদ্ধ করলেন, সে দিন ভীম আর দুর্যোধনের গদানৈপুণ্যের পরীক্ষাও হল। কিন্তু ব্যাপারটা সিরিয়াস টার্ন নিল, দুই জনই পরস্পরকে ছাড়তে নারাজ। তখন সন্ধ্যা হব-হব, দ্রোণের আদেশে অশ্বত্থামা দু’জনকেই থামিয়ে দিলেন। ভীম শুরু থেকেই বংশমর্যাদা তুলে গাল দেন। কর্ণ এসে নিজেকে ধনুর্ধর বলে অর্জুনের মতো তিরন্দাজি দেখাতে চাইলেন। দ্রোণ বাধা দিলেন না। কিন্তু তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য পলিটিক্যালি কর্ণকে আটকানোর চেষ্টা করলেন, “রাজপুত্রের সঙ্গে রাজপুত্রই দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে পারেন। তুমি কে হে?” তখন দুর্যোধন কর্ণকে অঙ্গরাজ্যে অভিষেক করলেন। ভীম বললেন, “এই সারথির ছেলে, তুই ঘোড়া চালানোর চাবুক ধর। ওটাই তোর জাতব্যবসা। কুকুর যেমন যজ্ঞের পুরোডাশ খাওয়ার উপযুক্ত নয়, তুইও অঙ্গরাজ্য শাসন করার উপযুক্ত নোস।” রাজ্য দিচ্ছেন দুর্যোধন, গালিগালাজ করছেন ভীম। অশ্বত্থামা বা অ্যাকিলিস ক্রোধান্ধ ঠিকই, কিন্তু তাঁরা রণক্ষেত্র ছাড়া অকারণে এ ভাবে অন্যদের গাল দেননি।
অ্যাকিলিস প্রথম থেকেই বীর এবং গ্রিক বহরের অন্যতম সেনাপতি। দ্রোণপুত্র সেনাপতি হয়েছেন অনেক পরে। দ্বৈপায়ন হ্রদে ভীমের গদাঘাতে ভগ্ন-ঊরু দুর্যোধন রক্তবমি করছেন, তখন রাতের অন্ধকারে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য, কৃতবর্মারা আসেন। অশ্বত্থামা বলেন, “পাঞ্চালরা আমার অস্ত্রহীন বাবাকে বধ করেছে। কিন্তু আজ আপনাকে দেখে আরও বেশি দুঃখ হচ্ছে”— ‘পিতা মে নিহতঃ ক্ষুদ্রৈ সুনৃশংসেন কর্মণা।’ তখন মৃত্যুপথযাত্রী দুর্যোধন অশ্বত্থামাকে সেনাপতির দায়িত্ব দেন, এই ব্রাহ্মণতনয়ই কুরুক্ষেত্রে কৌরবপক্ষের শেষ সেনাপতি। এর আগে ভীষ্ম, দ্রোণ অনেকে সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত হয়েছেন, কর্ণের মৃত্যুর পর অশ্বত্থামাই শল্যকে সেনাপতি করার জন্য দুর্যোধনকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু নিজে সেনাপতি হতে চাননি। অর্জুন তাঁর বন্ধু বলে? এই জায়গাটা ব্যাসদেব পরিষ্কার করেননি।
কিন্তু যেটা পরিষ্কার করে বার বার জানিয়েছেন, তা অশ্বত্থামার বীরত্ব। ভীষ্মপর্বে শিখণ্ডী এক বার অশ্বত্থামার বাণে আহত হয়ে সাত্যকির রথে চড়ে পালিয়ে যান। যুদ্ধের দশম দিনে দ্রুপদ এবং বিরাট দুই রাজাই অশ্বত্থামার বাণে আহত হন, চতুর্দশ দিনে অশ্বত্থামার হাতে ঘটোৎকচ আহত, দ্রুপদ রাজার পাঁচ পুত্রের মৃত্যু। দ্রোণের মৃত্যুর পর রাগের চোটে এক দিনে এক অক্ষৌহিণী পাণ্ডবসৈন্য বিনাশ। আর অ্যাকিলিস? হেক্টর-বধের আগে আইফিটিয়ন, হিপোডামাস, ডেমোলিয়ন, সব ট্রোজান বীরদের একে একে বধ করছেন। তাঁর বল্লমের আঘাতে ডেমোলিয়নের মগজ ও ঘিলু বেরিয়ে আসে, প্যারিসের ছোট ভাই পলিডোরাসের নাড়িভুঁড়ি বার করে দেন। মহাভারত মহারণ্যের মতো জটিল ও বহুধাবিস্তৃত সুবিশাল এক মহাকাব্য, সেখানে রাগী অশ্বত্থামা এক পার্শ্বচরিত্র মাত্র, খুঁড়ে খুঁড়ে বার করতে হয়। কিন্তু ‘ইলিয়াড’-এর প্রথম লাইনেই হোমার বুঝিয়ে দেন, তিনি ক্রোধান্বিত অ্যাকিলিসের বীরত্বের কথাই বলবেন, “ক্রোধ গাও দেবী, পেলিয়ুসের ছেলে অ্যাকিলিসের ক্রোধের কাহিনি, গ্রিকদের জন্য অগণন দুঃখ, পীড়া বয়ে আনার সেই অভিশপ্ত ক্রোধ…” এ ভাবেই ক্রোধ, ক্ষোভ বা রৌদ্ররসের বন্দনায় শুরু সেই মহাকাব্য।
দুই ভাষার দুই নায়কের নামেই লুকিয়ে আছে তাঁদের চরিত্র। অ্যাকিলিস মানে যে ছোট ছোট পায়ে দ্রুত ছুটতে পারে। পায়েই তো তাঁর মৃত্যু। যুদ্ধে ছেলের মৃত্যুর নিয়তি জানতে পেরে থেটিস পাতালপুরীর স্টিক্স নদীর জলে ছেলের গোড়ালি ধরে উল্টো করে চুবিয়েছিলেন। গ্রিক দেবদেবীরা ওই পুণ্যতোয়া নদীর ধারেই শপথ নিতেন। কিন্তু মা ছেলের গোড়ালি ধরে থাকায় সেখানে জল লাগল না, জায়গাটা অরক্ষিতই রয়ে গেল।পরে ট্রয় রাজকুমার প্যারিসের তির সেখানেই বিদ্ধ হবে, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন বীর। গ্রিক মহাকাব্য থেকেই জন্ম নেবে দুর্বলতা বা ‘অ্যাকিলিস হিল’-এর প্রবাদ।
আর, ‘স্থাম’ মানে শব্দ। জন্মের পরই যিনি ঘোড়ার মতো তীব্রস্বরে কাঁদেন, তিনিই অশ্বত্থামা। তাঁর বাবা ও মামা দুজনেই ক্ষত্রিয়-অন্নে পালিত ব্রাহ্মণ, জাতকর্ম ছেড়ে রাজপ্রাসাদে অস্ত্রশিক্ষক। সেখান থেকেই কি এই চরিত্রে জন্ম নেয় প্রাপ্তির দুরাশা? এক বার তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে তাঁর সুদর্শনচক্র চাইলেন, জিনিসটা তুলতেই পারলেন না। শ্রীকৃষ্ণ হাসলেন, “অর্জুনও কোনও দিন এটা চায়নি, আর তুমি চাইলে!”
এই চাহিদা তাঁর চরিত্রে প্রথম থেকে। ছেলেবেলায় দুধ খেতে চাইলে বন্ধুরা পিটুলিগোলা খাইয়েছেন, তিনিও ‘দুধ খেয়েছি’ বলে নাচতে লাগলেন। বাবা দ্রোণাচার্য দুঃখিত মনে ছেলেবেলার বন্ধু ও সতীর্থ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কাছে গেলেন। দ্রুপদ তাঁকে হাঁকিয়ে দিলেন, বন্ধুত্ব সমানে সমানে হয়। ভিক্ষাজীবী ব্রাহ্মণ আর রাজায় নয়। তার পরই তো দ্রোণের হস্তিনাপুরে আসা, কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষক হওয়া। এখান থেকেই কি জন্ম নেয় মনোবিকার? ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণরা যা পারেননি, তিনি সেটাই করে দেখাবেন আহত দুর্যোধনকে? রাতের অন্ধকারে শত্রুবধের পাপ স্বীকার করেও চিরতরে নিকেশ করে আসবেন পাণ্ডবদের?
চিরকাল বেঁচে থাকার অভিশপ্ত নিয়তি জানতেন না তিনি। সে তো ভীম, অর্জুনের মতো পাণ্ডব বীরেরাও জানতেন না মহাপ্রস্থানের পথে মাঝরাস্তায় পড়ে যাওয়ার ভবিতব্য। কিন্তু অ্যাকিলিস জানতেন, স্বল্পস্থায়ী জীবনে কী ভাবে বীরের ধর্ম পালন করতে হয়। হেক্টর-বধের আগে ট্রোজানদের কচুকাটা করছেন, হেক্টরের বৈমাত্রেয় ভাই লাইকাওন আচমকা তাঁর সামনে। প্রাণে বাঁচতে অ্যাকিলিসের হাঁটু জড়িয়ে ধরে সে। রাগী অ্যাকিলিস বলে, “কিন্তু বন্ধু, তোমাকে যে মরতেই হবে। দেখো না, আমার মা এক দেবী। তবু এক দিন আসবে এমন এক ভোর, মধ্যাহ্ন বা অপরাহ্ন, যখন অন্য কেউ এসে যুদ্ধে আমারও জীবন ছিনিয়ে নেবে।” বীরের ধর্ম বুঝতে আজও ‘ইলিয়াড’-এর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দুই বীরের সঙ্গেই পশুপাখির অদ্ভুত সংযোগ। অশ্বত্থামা সেই কালরাত্রিতে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশের বুদ্ধি পান এক পেঁচাকে দেখে। গাছের ডালে সে অন্য পক্ষিশাবকদের মেরে ফেলছে। আর অ্যাকিলিস? হেক্টর-বধের আগে যুদ্ধসাজ পরে তাঁর ঘোড়া জ্যানথাস তাঁকে বলে, “আহ, এর পর তুমিও তো মরবে।” বীর মানে শুধু অস্ত্রচালনা নয়, কর্তার বিরুদ্ধে মুখরতা নয়, পশুপাখির ভাষা এবং মনোভাবের সঙ্গে নীরব সংযোগ। অ্যাকিলিস প্রতিপক্ষের অনেককে যুদ্ধে হারিয়েছেন, কাউকে দাস হিসেবে বেচেও দিয়েছেন কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে কখনও অস্ত্রে শান দেননি। বহু পরে অন্ত্যেষ্টির জন্য হেক্টরের মৃতদেহ তুলে দেন তাঁর শোকার্ত বৃদ্ধ পিতা প্রায়ামের হাতে। আর অশ্বত্থামা? রাজসূয় যজ্ঞের পর যুধিষ্ঠিরই তাঁকে সকলের হাতে উপঢৌকন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব দেন। সেখানেই ভীষ্ম, দ্রোণের মতো মহাবীর থাকতে কৃষ্ণকে কেন অর্ঘ্য দেওয়া হবে, তা নিয়ে চেদিরাজ শিশুপালের ক্রোধ। কৃষ্ণ সুদর্শনচক্রে তাঁকে বিনাশ করেন। কাকে অর্ঘ্য দেওয়া উচিত বা উচিত নয়, তা নিয়ে অশ্বত্থামা একটি শব্দও খরচ করেননি।
বীরেরা যুদ্ধক্ষেত্রেই ক্ষমতা দেখান, যজ্ঞক্ষেত্রে নয়।