ছবি: সুমন চৌধুরী
জ্যৈষ্ঠের দুপুরে ঘেমেনেয়ে খেত থেকে বাড়ি ফিরলেন সহদেব বিশ্বাস। বাড়ির দাওয়ায় বসে গলার গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মোছা শেষ না হতেই গিন্নি হাজির। হাতে মাটির কলসি থেকে সদ্য ঢেলে আনা গেলাস ভর্তি ঠান্ডা জল। এক চুমুকে সেটা শেষ করেই সহদেব বললেন, ‘হ্যাঁ গো, বাবাজীবনকে ফোন করেছ?’
‘মরণ! ফোন তো তোমার করার কথা। নতুন জামাই। আমি কী বলতে কী বলব...’
‘থাক, আর অজুহাত দিতে হবে না। ফোনটা দাও!
একটা বিড়ি ধরিয়ে ভরদুপুরে সহদেব ডায়াল করলেন নতুন জামাইয়ের নম্বর। মাথার উপরে ঢিমেতালে পাখা ঘুরছে। কিন্তু সহদেব দরদর করে ঘামছেন। জামাইয়ের ফোনে ঘণ্টি বাজছে। এ দিকে টেনশনও বাড়ছে সহদেবের।
‘হ্যালো বাবা, বলুন। বাড়ির খবর সব ভাল তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ দিকে সব ভাল। তা ষষ্ঠীতে তোমরা আসছো তো?’
‘আজ্ঞে বাবা। নিশ্চয় যাব। আপনার মেয়ে বলছে, প্রথম ষষ্ঠীতে না গেলে নাকি অমঙ্গল হয়।’
‘তা বাবাজীবন, মেয়ে কি আর কিছু বলেছে?’
‘আজ্ঞে না। কেন বলুন তো? কোনও সমস্যা হয়েছে নাকি?’
‘না তেমন কিছু নয়। বোঝোই তো, সীমান্তে বাস, সমস্যা বারো মাস। বলছিলাম, ষষ্ঠীর দিন এখানে আসার সময় ভোটের কার্ডটা মনে করে এনো কিন্তু। এই হতচ্ছাড়া বিএসএফগুলো... সবই তো তুমি বোঝো বাবা।’
‘আজ্ঞে ভোটার কার্ড নিয়েই যাব। বিয়ে যখন কাঁটাতারের ও পারের গ্রামে করেছি, তখন নিয়ম তো মানতেই হবে!’
নতুন জামাই কি একটু খোঁচা দিল? নিভে যাওয়া অভিমানী বিড়ি ফের ধরাতে ধরাতে সহদেব ভাবলেন, ‘দিনরাত তো তারকাঁটার খোঁচায় রক্তাক্ত হচ্ছি। এ আর এমন কী!’ গিন্নিকে বললেন, ‘যা বলার বললুম। পরে তুমি এক বার মেয়েকে মনে করিও দিও। উফ্, আর পারি না বাপু!’
সাকিন চরমেঘনা। জিলা নদিয়া। ছিটমহল নয়, সরকারি খাতায় যে গ্রামের স্টেটাস ‘এপিএল’ বা ‘অ্যাডভার্স পজেশন ল্যান্ড’। জমি বাংলাদেশের। বাস করেন ভারতীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দারা জমিতে ফসল ফলালেও সে জমি বিক্রি করতে পারেন না। মেলে না ইন্দিরা আবাস যোজনার ঘরও। গ্রামের শেষ প্রান্তে বয়ে চলেছে মাথাভাঙা নদী। ও পারে জামালপুর ভারতীয় জমি। সেখানে বাস করেন বাংলাদেশের লোকজন।
অতএব, ভারতীয় নাগরিক হয়েও বিএসএফ-এর মর্জিমাফিক পরাধীন জীবন কাটান চরমেঘনার মানুষ। নিত্যসঙ্গী অভাব আর ভোটার কার্ড। করিমপুর-১ ব্লকের হোগলবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত কাঁটাতারের ও পারের গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল, বিএসএফ ক্যাম্প, বছর কয়েক আগে আসা বিদ্যুৎ ও সদ্য-হওয়া পাকা রাস্তা ছাড়া ‘নেই’-এর তালিকা দীর্ঘ। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল সবই কাঁটাতারের এ পারে। ফলে নিজের গ্রামে ঢুকতে-বেরোতে ভরসা ভোটার কার্ড। এমন গ্রামে বিয়েও আটকে যায় কাঁটাতারে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অনেকেই এ গ্রামে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিতে চান না। বিয়ের পরেও ফ্যাসাদ, জামাইকে ভোটার কার্ড নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে ষষ্ঠী করতে!
বিএসএফ-এর অকাট্য যুক্তি— আন্তর্জাতিক সীমান্ত, দেশের নিরাপত্তার মতো বিষয় এটা। আর আইন আইনই। জামাইয়ের বেলাতেও তার ব্যতিক্রম হওয়ার প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া, জামাইষষ্ঠীর নাম করে কেউ যদি চরমেঘনায় ঢুকে মাথাভাঙা পেরিয়ে সটান বাংলাদেশে চলে যান, সে ঝুঁকি কে নেবে?
ফলে জামাইষষ্ঠীর আগে মেয়ে-জামাইকে নিমন্ত্রণ করে চরমেঘনার মানুষ অনুরোধ করেন, ভোটার কার্ডটা এনো বাবা!
জামাইষষ্ঠীর সকাল থেকে হইহই ব্যাপার। যেন অকাল ভোট! কাঁটাতারের এ পারে লাইন দিয়ে দাঁড়ান বাবাজীবনেরা। সকলের হাতে চকচকে ভোটার কার্ড (কারণ, সেগুলো তো তোলা থাকে আলমারিতে। ভোট কিংবা জরুরি প্রয়োজনে সেগুলো কালেভদ্রে বাইরে বেরোয়। সীমান্তের লোকজনের ভোটার কার্ড বহু ব্যবহারে জীর্ণ ও মলিন)। কাঁটাতারের ও পারে একরাশ উদ্বেগে অপেক্ষায় থাকেন শ্বশুরমশাই বা শ্যালকেরা। তাঁদেরই কেউ চিনিয়ে দেন, ‘ওই যে, হলদে রঙের জামা... উনিই আমাদের জামাই হ্যায়।’ জলপাইরঙা উর্দি নতুন জামাইয়ের কাঁধে হাত রাখে, ‘ইয়ে ওয়ালা?’ ও পার থেকে বিগলিত গলায় উত্তর আসে, ‘আজ্ঞে, ওইডাই!’ তার পর কাঁটাতারের পাশে নজরদারি চৌকিতে জামাইয়ের ভোটার কার্ড দেখে, খাতায় লেখাজোখা সেরে মেলে জামাইষষ্ঠীর ছাড়পত্র। আপাতত হাঁপ ছেড়ে বাঁচে দু’পক্ষই।
আপাতত কেন? গ্রামের অনিমেষ মাহাতো বলছেন, ‘জামাইকে বিএসএফ-এর খাতায় লিখে আসতে হয়েছে, তিনি এই গ্রামে ক’দিন থাকবেন। এক দিন পেরিয়ে গেলেই বিএসএফ ক্যাম্প থেকে জামাইয়ের ডাক পড়বে। তখন আবার জবাবদিহি করতে হবে, ঠিক কী কারণে তিনি নির্দিষ্ট দিনে ফিরে যাননি। ভাবুন, কী লজ্জার ব্যাপার!’
এর পরেও গ্রামে জামাইরা ষষ্ঠী করতে আসেন?
পোড়-খাওয়া জামাই রামপ্রসাদ মাহাতো বলছেন, ‘না এসে উপায় কী? আমি নিজেও সেনা বিভাগে কাজ করি। সীমান্তের সমস্যাটা আমিও বুঝি যে!’ এ বার প্রথম বার চরমেঘনায় ষষ্ঠী করতে আসবেন বর্ধমানের কৌশিক মাহাতো, বাপন মাহাতো। তাঁদের কথায়, ‘সীমান্তের নিয়মের থেকেও স্ত্রীর মান ভাঙানো আরও কঠিন কাজ। ফলে আগে থেকেই ব্যাগে ভোটার কার্ডটা ঢুকিয়ে রেখেছি। আম-কাঁঠালের সময় অশান্তির থেকে রসেবশে থাকা ঢের ভাল!’