Fish

Water pollution: বাঙালির মাছ আর কত দিন

গত কয়েক দশকে হারিয়ে গেছে ২৫০টিরও বেশি দেশি মাছের প্রজাতি। জলদূষণ বাড়ছে। নেই উপযুক্ত সংরক্ষণ কিংবা সতর্কতা।

Advertisement

সুমনা সাহা

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৪০
Share:

শরৎ এসে গেছে। তবু বৃষ্টির বিরাম নেই। গৃহবন্দি দশা ঘোচেনি এখনও। বাঙালির শত দুঃখের মধ্যেও আশার প্রদীপ, “কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে/ইলিশ ভাজার গন্ধ, কেরানির গিন্নির ভাঁড়ার/সরস সর্ষের ঝাঁঝে, এলো বর্ষা ইলিশ উৎসব।” কিন্তু এমন ঘনঘোর বরিষণেও বাজারে পর্যাপ্ত ইলিশ কই? বাংলাদেশ থেকে এই সাম্প্রতিক আমদানির পরের কথা এখনও জানি না, তবে ক’দিন আগেও বাজারে গিয়ে দেখেছি অনেক খদ্দের ইলিশ-বিক্রেতাকে দাম জিজ্ঞেস করছেন, তার পর ৫০০ গ্রাম ‘খোকা ইলিশ’-এর আকাশছোঁয়া দাম শুনে ম্লান মুখে তেলাপিয়া কিনে ফিরছেন।

Advertisement

বাৎসরিক মাছ খাওয়ার পরিমাণে চিন, মায়ানমার, ভিয়েতনাম ও জাপানের পরে পঞ্চম স্থানে ভারত। ভারতে সবচেয়ে বেশি মাছ খায় যে রাজ্যের মানুষরা, সেখানেও বঙ্গের নাম নেই, শীর্ষস্থানে লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান ও ত্রিপুরা। তবু মাছের সঙ্গে বঙ্গসংস্কৃতির নিবিড় আত্মিক যোগ। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, “ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙ্গালী সকল,/ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।” খাল-বিল-নদী-নালার বঙ্গভূমে আদিযুগ থেকেই সহজপাচ্য প্রোটিন হিসেবে মাছ খাওয়া চলত। চন্দ্রকেতুগড়ে পাওয়া চতুর্থ শতকের এবং অষ্টম শতক থেকে বাংলাদেশের পাহাড়পুর ও ময়নামতীতে খননকার্যে উত্থিত পোড়ামাটির ফলকে মাছের নকশা, মন্দিরেও পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ বঁটি দিয়ে মাছ কোটা বাঙালি রমণীর চিত্র থেকে বোঝা যায়, মাছ বাঙালির অতি প্রাচীন জনপ্রিয় আহার্য।

নদীনালার দেশে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ আমিষের প্রধান উৎস হিসেবে মাছের উপরেই নির্ভর করত। মৌরলা, চেলা, টেংরা, পুঁটি, কাচকি প্রভৃতি মাছে প্রচুর প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, মিনারেল, ফসফরাস ও ভিটামিন-এ থাকে, যা বাড়ন্ত শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ভাল রাখে, রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। মাছে থাকা ওমেগা থ্রি ফ্যাটি-অ্যাসিড রক্তের অণুচক্রিকাকে জমাট বাঁধতে দেয় না। বিশেষ করে মৌরলা, ঢেলা, রিটা, শিং, মাগুর, কইমাছ চোখের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। সারদা দেবীর এক শিষ্য মাছ খেতে আপত্তি করায় তিনি বলেছিলেন, “আমিষ খাবে, খুব খাবে। আমি বলছি, খাবে।” আর এক জন ভক্তমহিলাকে বলেছিলেন, “মাছ খাবে মা, মাছের তেলে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। খাওয়ার মধ্যে কী আছে মা?... খেয়ে-দেয়ে মনকে শান্ত করে তাঁর নাম করবে।”

Advertisement

বঙ্গ-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাছ। মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল, পদ্মপুরাণ ও অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি মঙ্গলকাব্যগুলিতে পঞ্চব্যঞ্জন, দক্ষিণব্যঞ্জন, পঞ্চাশব্যঞ্জনের উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে শাকসব্জি রান্নাও মাছযুক্ত। কবি বিজয়গুপ্ত রচিত ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে মধ্যযুগের পূর্ববঙ্গীয় রান্নার একটি চিত্র থেকে মাছের নানা প্রজাতির নাম পাওয়া যায়— “মৎস কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ/ রোহিত মৎস দিয়া রান্ধে নালিতার আগ/ মাগুর মৎস দিয়া রান্ধে গিমা গাছা গাছ/ ঝাঁঝ কটু তৈলে রান্ধে খরশুন মাছ/ ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিয়ে জুড়ায় সুতা/ তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা/ ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল/কৈ মৎস দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।।”

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’ উপন্যাসের আরম্ভেই আছে গ্রামের পুকুরে মাছ ধরার বিশাল বর্ণনা। রাজার গুরুদেব ভাজা, চচ্চড়ি, ছ্যাঁচড়া, ইত্যাদি মাছের নানা পদ খেয়ে শিষ্যকে আশীর্বাদ করলেন, “তোমার ধর্মে মতি হোক।” মাছের এমনই মহিমা। এখন খুব কম দেখা যায়, কিম্বা জেলেদের জালে ধরা পড়ে না দেশীয় এ রকম প্রায় ৪৯ টি মাছের নাম রয়েছে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে— “চিতল ভেকুট কই কাতলা মৃগাল/ বানি লাটা গড়ুই উলকা শৌল শাল/ পাকাল খয়রা চেলা তেচক্ষা এলেঙ্গা/ গুতিয়া ভাঙ্গন রাগি ভোলা ভোলচেঙ্গা/মাগুর গাগর আড়ি বাটা বাচা কই/কালবসু বাঁশপাতা শঙ্কর ফলই/ শিঙ্গী ময়া পাবদা বোয়ালি ডানিকোনা/চিঙ্গরি টেঙ্গরা পুঁটি চান্দাগুঁড়া সোনা/গাঙ্গদাড়া ভেদা চেঙ্গ কুড়িশা খলিশা/খরশুল্বা তপসিয়া গাঙ্গাস ইলিশা॥”

এই সমস্ত মাছ এক সময় বঙ্গদেশে সুলভ ছিল, কিন্তু চাইলেও এখনকার ছেলেমেয়েদের পাতে সে সব মাছ তুলে দিতে আমরা অক্ষম। বিগত কয়েক দশকে ভয়ানক জল-দূষণ ও ঠিকমতো সংরক্ষণের অভাবে ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে অনেক বিলুপ্তপ্রায় মাছ-প্রজাতি। মৎস্য দফতরের সূত্র জানাচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির সংখ্যা আড়াইশোরও বেশি। মিষ্টিজলের সুস্বাদু দেশি মাছের বদলে এখন বাজার দখল করেছে কৃত্রিম ভাবে চাষ করা পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া ও কার্প জাতীয় মাছ।

আমরা যেমন অনুকূল পরিবেশ দেখে বাসস্থান নির্বাচন করি, মাছও তার বাসযোগ্য অঞ্চল বেছে নেয়। সেখানে সমস্যা হলে তারা উদ্বাস্তু হয়ে অন্যত্র চলে যায়। নতুন অঞ্চলে গিয়ে কোনও কোনও মাছ টিকে থাকে, আবার প্রতিকূল আবহাওয়া, জলজ শত্রু, খাদ্যের অভাব এবং জীবাণুর আক্রমণে অনেক মাছ মারাও যায়। দেশীয় বড় কার্পদের কৃত্রিম ভাবে ডিম ফুটিয়ে ধরে রাখা হলেও বিলুপ্তপ্রায় মাছের বংশ ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত নেই।

মাছ সংরক্ষণের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে যাতে জলদূষণের প্রতিরোধ, মাছ ধরার জালের নির্দিষ্ট মাপ, বিস্ফোরক ও বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে মাছ ধরায় ও প্রজনন ঋতুতে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা আছে।

মাছ বাঁচাতে হলে, প্রথমত, স্বল্প খরচে বাস্তুতান্ত্রিক প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা স্বাভাবিক প্রজনন ব্যবস্থা চালু করা এবং দ্বিতীয়ত, উন্নত গবেষণাগারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করা। এক বার কামারপুকুরে প্রবল বৃষ্টিতে একটি মাগুর মাছ রাস্তায় ভেসে আসে। শ্রীরামকৃষ্ণ তখন ওই স্থান দিয়ে ফিরছিলেন। মাগুর মাছটিকে পায়ের কাছে দেখে তাঁর দয়া হয়, তিনি ওটিকে পুকুরে ছেড়ে দেন। চিরতরে না হারিয়ে ফেলতে হলে আমাদেরও মাছের প্রজনন ঋতুতে মাছ ধরা ও খাওয়ার লোভ সামলাতে হবে। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হবে মাছের স্বাদ পাওয়ার তৃপ্তি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement